চাল রপ্তানির দাবি কতটুকু যৌক্তিক

বোরো ধানের ব্লাস্ট রোগ

নিতাই চন্দ্র রায়
চাল রপ্তানির দাবি ঃ কৃষকের উৎপাদিত চালের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে বিদেশে সরু ও লম্বা চাল রপ্তানি করতে চান বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি।বাংলাদেশ হতে এক থেকে দুই লাখ টন চাল রপ্তানির জন্য অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন তাঁরা।মিল মালিকদের দাবি- দেশে দেড় কোটি টন চাল উদ্বৃত্ত আছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বাংলাদেশে ১ কোটি ১৬ লাখ ১ হাজার ৩৯০হেক্টর জমি থেকে মোট ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭ হাজার ৯৩০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। এর আগের বছর; ২১৬-১৭ অর্থবছরে ১ কোটি ১০ লাখ ৭ হাজার ২৩০ হেক্টর জমি থেকে ৩ কোটি ৪২ লাখ ১৪০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়।
চাল রপ্তানির ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনসির কথা- দেশে যদি উদ্বৃত্ত চাল থাকে তা হলে রপ্তানি হতেই পার। তবে এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মতামত নিতে হবে। দেশে রপ্তানিযোগ্য চালের পরিমাণ সঠিকভাবে খতিয়ে দেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ চালের দামের উত্থান-পতনের সাথে দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। বছরে ৩ কোটি ৬২ লাখ টন উৎপাদিত চাল থেকে ১ থেকে ২ লাখ টন সরুও চিকন চাল রপ্তানি করলে কৃষক কতটুকু ন্যায্য মূল্য পাবেন? বজারেইবা তার কতটুকু প্রভাব পড়বে তা এমুহূর্তে বলা মুশকিল।
২০১০ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ এক লাখ টন চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ৫০ হাজার টন রপ্তানির পর বাংলাদেশ আর চাল রপ্তানি করেনি। ২০১৭ সালে হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যা ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও ব্লাস্ট রোগের কারণে ১০ লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হয়। ওই সময়ে শুল্ক হ্রাসের সুযোগ গ্রহণ করে চাহিদার প্রায় চার গুণ অর্থাত ৩৭ লাখ মেট্রিক টন চাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। তখন থেকেই ধানের দাম কমতে শুরু হয়।কপাল পুড়ে দুর্ভাগা কৃষকের। কৃষক ধান বিক্রি করে আসল টাকাও ঘরে তুলতে পারছেন না।কুমিল্লার একজন কৃষক দুঃখ করে বলেন, দেড় মণ ধান বিক্রি করে যদি একজন কৃষি শ্রমিকের এক দিনের ধান কাটার মজুরি দিতে হয়, তা হলে ধান করার চেয়ে জমি পতিত রাখাই ভাল। বর্তমানে তিন বেলা খাওয়াসহ ধান কাটতে একজন কৃষি শ্রমিকে মজুরি দিতে হয় ৭০০ টাকা। আর বাজারে নতুন ধানের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। প্রতিকেজি বোরো ধানের সরকারি নির্ধারিত দাম ২৬ টাকা হলেও কৃষকতো সে দাম পাচ্ছেন না। কৃষকে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ টাকা কেজি দরে। তাহলে সরকার নির্ধারিত মূল্য কৃষকের কাছে অর্থহীন । দেশে বোরো চাল উৎপাদিত হয় প্রায় ১ কোটি ৯৫ লাখ মেট্রিক টন। এবছর সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনবে দেড় লাখ মেট্রিক টন। এতে কৃষক কতটুকু লাভবান হবেন- তা বোধগম্য নয়। সরকার এ বারের বোরো মৌসুমে ১০ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল কিনবে প্রতিকেজি ৩৬ টাকা দামে এবং দেড় লাখ টন আতপ চাল কিনবে প্রতিকেজি ৩৫ টাকা দামে।এতে লাভবান হবেন মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীগণ।বিদ্যমান ব্যবস্থায় যে সব মিলমালিক সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করবেন তারা যদি কৃষকের কাছ থেকে সরকারি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ২/৩ টাকা কম দামেও ধান কিনতেন, তা হলেও কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পেতেন। অথবা সরকার যদি চাল না কিনে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতো তাহলেও কৃষক এত বঞ্চিত হতো না।
বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন হাট বাজারে প্রতিমন ব্রি-৪৯ জাতের আমন ধান ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণে নতুন বোরো ধান উঠেনি। সামান্য পরিমাণে আগাম জাতের যে বোরো ধান বাজারে উঠছে , তা বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চাল ৩২ থেকে ৩৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ২৬ থেকে ২৭ টাকা দরে। আবার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ(টিসিবি)-এর হিসেব অনুযায়ী রাজধানী ও তার আশেপাশের এলাকায় গত এক মাসে চালের দাম আড়াই শতাংশ হ্রাস পেয়েছে । আগাম জাতের বোরো ধান কাটা শুরু হওয়াতে সারা দেশে ধানের দাম কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে হাওর এরাকায় প্রতিমণ বোরো ধান ৫৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। রংপুর ও দিনাজপুরের হাট-বাজারগুলোতে প্রতিমণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা মন দরে, যার উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রতিমণ ৭০০ টাকা।
এবছর শিলাবৃষ্টি, কোল্ড ইনজুরিও নেক ব্লাস্টের আক্রমণে সারা দেশে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নেত্রকেনা হাওর এলাকার ৪টি উপজেলাতে কোল্ড ইনজুরির কারণে ৬ হাজার হেক্টর বোরো ধান চিটা হয়ে গেছে। কৃষকদের মতে কোল্ড ইনজুরিতে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ আরও বেশি। কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলি উপজেলায় নেক ব্লাস্টের আক্রমণে ব্রিধান-২৮ জাতের চিটা হয়ে গেছে। শুধু নিকলি নয়, নেক ব্লাস্টের আক্রমণে ময়মনসিংহ , জামালপুর ,নেত্রকোনা ও কুমিল্লা জেলার অনেক এলাকায় ধান চিটা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ বছর ব্রিধান-২৮, ব্রিধান-২৯, ব্রিধান-৫৮ ও হাইব্রিড জাত ছক্কা জাতে নেক ব্লাস্টের আক্রমণ পরিলক্ষিত হচ্ছে বেশি। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা দক্ষিণ ভাটিপাড়া গ্রামের আব্দুস সালামের ২৫ শতক ব্রিধান-২৮ জাতে নেক ব্লাস্টের আক্রমণে শতভাগ বিনষ্ট হয়ে গেছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ২৫ শতক জমিতে বোরো ধানের আবাদ করতে খরচ হয়েছে ৫ হাজার টাকা । ব্রিধান-২৮ জাতের ভিত্তি বীজের চারা রোপণ এবং মাত্রা মোতাবেক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করার পরও ধান ক্ষেতটি একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। তাই সরকারের উচিত নেক ব্লাস্টে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। অন্যথার কৃষক বাঁচবে না। এবছর চলনবিল এলাকার বোরো ধানে গত বছরের চেয়ে বিঘা প্রতি ৫ থেকে৭ মণ করে ফলন কম হচ্ছে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী স্বাক্ষরিত চাল আমদানির ওই চিঠিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে দেশে মোট ধান উৎপাদিত হয় ১ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন। দু‘বার বাম্পার ফলনের পর দেশে প্রায় চার কোটি টন চাল উৎপাদিতহয়েছে। পাশাপাশি প্রয়োজনের তুলনায় বিগত দিনে অতিরিক্ত চাল আমদানি করা হয়েছে। বছরে চালের প্রয়োজন হয় সাড়ে তিন কোটি মেট্রিক টন। ফলে এখন প্রায় দেড় কোটি মেট্রিকটন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। চলতি মৌসুমে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান( বিআইডিএস)-এর কে এ এস মুরশিদের মতে, দেশে উদ্বৃত্ত চাল থাকলে তা রপ্তানি করাই যেতেই পারে। তবে সামনে ঈদের বাজার। তখন সুগন্ধি চালের চাহিদা বেড়ে যাবে। আর ওই সুগন্ধি ও সরু চাল রপ্তানি শুরু হলে বাজারে সংকট তৈরি হয়ে দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যেতে পারে। তাই সরকারকে বুঝেÑশুনে হিসাব করে রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। আভ্যন্তরিন বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে সরকার ২০০৮ সালের মে মাসে কিছু জাতের চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করে।এর আগে ২০০৭ সালে বন্যার কারণে চালের দাম বৃদ্ধি এবং সরকারি মজুদে টান পড়ায় বাংলাদেশ সরকার বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করে।তবে এর কয়েক বছরে সরকারের কৃষক বান্ধব নীতির কারণে বাম্পার ফলনের ফলে চালের মজুদও উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
জাতি সংঘের জনসংখ্যা তহবিল( ইউ এন এফপিএ)-এর মতে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮১ লাখ। কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি আছে আরও ১৩ লাখ। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলিতে বাংলাদেশকে ১৬ কোটি ৯৪ লাখ মানুষের অন্ন জোগাতে হবে।পৃথিবীতে বার্ষিক জনপ্রতি সবচেয়ে বেশি চাল গ্রহণ করে মায়ানমারের মানুষ। দেশটিতে বছরে জনপ্রতি চাল পরিভোগের পরিমাণ ৩০৬ কেজি। এরপর বেশি চাল পরিভোগ করে ভিয়েতনামও থাইল্যান্ডের মানুষ। তাদের জনপ্রতি বার্ষিক চাল গ্রহণের পরিমাণ যথাক্রমে ২৮৫ ও ২৩৩ কেজি। আর বাংলাদেশে জনপ্রতি বার্ষিক চাল ভোগের পরিমাণ হলো ২২৯ কেজি।বর্তমানে হাওর এলাকায় বোরো ধান কাটা চলছে। আমন চাল পেতে আরও ৮ মাস সময়ের প্রযোজন হবে। জনপ্রতি বার্ষিক ২২৯ কেজি হিসেবে আগামী ৮ মাসে ১৬ কোটি ৯৪ লাখ লোকের জন্য চালের প্রয়োজন হবে প্রায় ২ কোটি ৫৯ লাখ টন।এবারের বোরো মৌসুমে যদি গত বছরের সমপরিমাণ, ১ কোটি ৯৫ লাখ মেট্রিক টন চালও উৎপাদিত হয় এবং এর সাথে সরকারি গুদামে মজুদ ১৩ লাখ টন যোগ করা হলেও চালের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৮ লাখ টন। কথার কথা- মিল মালিক, ব্যবসায়ী ও কৃষকের ঘরে যদি আরও ৫০ লাখ টন চাল মজুদ থাকে, তা হলেও আমাদের রপ্তানির মতো কোনো উদ্বৃত্ত চাল নেই।এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞগণ আরও ভাল করে বলতে পারবেন। কৃষকের সাথে কথা বলে, বোরো ধানক্ষেত সরজমিনে পরিদর্শন করে এবং পত্রপত্রিকা পাঠ করে আমার কাছে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে তা হলো- এবছর শিলাবৃষ্টি, কোল্ড ইনজুরি ও নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে বোরো ধানের কাক্সিক্ষত ফলন নাও হতে পারে।তাই চাল রফতানির মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে ঝুঁকি নেয়া সরকারের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই উচিত হবেনা।

লেখকঃ সাবেক মহাব্যস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ
গোপাল পুর , নাটোর

Advisory Editor

Advisory Editor of http://www.krishisongbad.com/

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *