Site icon

চিনি শিল্পে সংকট ও উত্তরণের উপায়

চিনি শিল্পে সংকট

নিতাই চন্দ্র রায়
চিনি শিল্পে সংকট ঃ সময় মতো আখ বিক্রির টাকা না পেয়ে ক্ষোভে-দুঃখে জমি থেকে আখ উপড়ে ফেলেছেন জয়পুরহাট চিনি কলের কৃষক।আখের বদলে আবাদ করেছেন অন্য ফসল। চাষিদের কথা- তিন মাস আগে তাঁরা আখ বিক্রি করেছেন। কিন্তু এখনও টাকা পাননি। তাহলে তাঁদের সংসরা চলে কীভাবে? ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচই আসে কোত্থেতে? যে ফসল বিক্রি করে দিনের পর দিন পাওনা টাকার জন্য ধরনা দিতে হয়, সেই ফসল আবাদ না করাই ভালো।জয়পুর হাট চিনি কলের ইবনে আল মাসুদ এবছর নিজের ৬বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছিলেন এবং মামার সাথে যৌথভাবে করেছিলেন আরও ১৬ বিঘা জমিতে আখের চাষ। চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে তার পাওনা ছিল ছয় লাখ টাকা। সেই টাকা সময় মতো না পাওয়াতে অভিমানে তিনি ১৬ বিঘা জমির আখ উপড়ে ফেলেন। তাঁর মতো জয়পুরহাট সদর উপজেলার গাড়িয়াকান্ত গ্রামের আর একজন চাষি হাফিজার রহমান আখ বিক্রি করে সময় মতো আখের মূল্য আড়াই লাখ টাকা না পেয়ে দুই একর জমির আখ তুলে ফেলে ওই জমিতে কলার চাষ করেন। এভাবে জংপুরহাট চিনি কলের বিভিন্ন সাবজোন থেকে ৩০০ থেকে ৩৫০ একর জমির আখ তুলে ছেলেন কৃষক। এটা শুধু জয়পুরহাট চিনি কলে নয়; অন্যান্য চিনিকলেও এধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে।

আখ একটি দীর্ঘ মেয়াদী ফসল। রোপণ থেকে কাটা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়ে আমন ধান, আলু ও ভুট্টার মতো তিনটি ফসলের চাষ করে আখের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আয় করা যায় অনায়াসে। তারপরও সেই আখ বিক্রি করে যদি সময় মতো মূল্য না পাওয়া যায়, তাহলে আখের আবাদ করবে কেন কৃষক? আজ থেকে প্রায় তিন মাস আগে দেশের ১৫ টি রাষ্ট্রায়াত্ত চিনিকলে আখ সরবরাহ করেন কৃষক। চিনি বিক্রি না হওয়ার কারণে আখ বিক্রির টাকা না পেয়ে মহা বিপদে পড়েছেন কৃষক। সরকারি ১৫ টি চিনিকলের কাছে আখ চাষিদের পাওনা রয়েছে ১৫০ কোটি টাকা।এর মধ্যে আখের মূল্য ১১৯ কোটি টাকা এবং বীজের মূল্য ৩১ কোটি টাকা। আখ চাষিদের পাওনা ১৫০ কোটি টাকা আসন্ন ঈদের আগে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে পরিশোধের পরামর্শ দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির এই উদ্যোগকে আমার অভিনন্দন জানাই।
এরকমতো ছিলো না দেশের কৃষি ভিত্তিক একমাত্র ভারি প্রতিষ্ঠান; চিনিশিল্প। আখ বিক্রির সাথে সাথেই কৃষক আখের মুল্য পেতেন। মনের আনন্দে নতুন আখ রোপণ করতেন। মুড়ি আখের যতœ নিতেন। সময় মতো সারও কীটনাশক প্রয়োগ করে আখের ফলন বাড়নোর চেষ্ঠা করতেন।বেশি দিনের কথা না , ১৯৮৯-৯০ মাড়াই মৌসুমে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ২০ লাখ ৯৬ হাজার ২০৩ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করে। সে সময় চিনি আহরণের হার ছিল ৮. ৭৭%। পরবর্তীতে ২০০০-২০০১ মাড়াই মৌসুমে ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৬ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৯৮ হাজার ৩৫৫ মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন করে বিএসএফআইসি। ওই মাড়াই মৌসুমে চিনি আহরণ হার ছিল ৭.১১ %। এরপর জলবায়ু পরিবর্তন, তুলনামূলক কম সূর্যালোক ঘণ্টা, আগাম আখ চাষের জমির পরিমাণ হ্রাস, নিচু জমিতে আখ চাষ, উচ্চ চিনি আহরণযুক্ত ইক্ষু জাতের অভাব, অপরিপক্ক আখ মাড়াই, পুরাতন যন্ত্রপাতি ও মিলের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কমতে থাকে চিনি আহরণ হার ও মোট চিনি উৎপাদন।

বাংলাদেশে আখই একমাত্র ফসল, যা কৃষক সরকার নির্ধারিত দামে সরাসরি মিলে সরবরাহ করতে পারেন। আখের মূল্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কৃষককে প্রদান করা হয়।আখকে বলা হয় বীমাকৃত ফসল। কারণ খরা, অতিবৃষ্টি, ঝড়, বন্যা এবং রোগও পোকা মাকড়ের আক্রমণেও আখ ফসল একেবারে নষ্ট হয়না। বঞ্চিত করেনা কৃষককে। অর্থ সংকটের কারণে চিনিকলগুলি এখনও আখের জমিতে উপরি প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সার ও কীটনাশক সংগ্রহ করতে পারেনি।উপরি সার ও কীট নাশক প্রয়োগের সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। সময় মতো উপরি সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে না পারলে আখের ফলন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ হ্রাস পাবে -এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই। গত ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমে ১৫টি চিনিকলের আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ও ১ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। ওই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১১ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৬৮ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করা হয়।জুন মাসের পর বর্ষা শুরু হলে আখের জমিতে আর উপরি সার ও কীটাশক প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। একারণে আগামী মাড়াই মৌসুমে আখের স্বল্পতার কারণে চিনিকলগুলিতে চিনি উৎপাদনের পরিমাণ আরো হ্রাস পাবে এবং লোকসানের পরিমাণও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।তাই সার ও কীটনাশক ক্রয়ের জন্য মিলগুলিকে যত শিগগির সম্ভব প্রয়োজনীয় অর্থ সররাহ করতে হবে।

জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে চিনিকলগুরি লোকসান ছিল ৩১৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৪১ কোটি টাকায়। আর গত অর্থ বছরে ১৪ টি চিনিকলের লোকসান হয় ৮৩৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ চিনি ও শিল্প করপোরেশন( বিএসএফআইসি)এর অধীনে থাকা ১৬ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে মধ্য লাভ করেছে শুধু দুটি প্রতিষ্ঠান। দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি ও কুষ্টিয়ার রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি।লাভে থাকা কেরুর চিনি কারখানা ছাড়াও আছে ডিস্টিলারি ইউনিট, বাণিজ্যিক খামার পরীক্ষামূলক খামার ও জৈব সার কারখানা। সব মিলিয়ে কেরু গত অর্থ বছরে লাভ করেছে ৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অবশ্য ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের কেরুর লাভ ছিল ৯ কোটির টাকার বেশি। কুষ্টিয়ার রেনউইক অ্যান্ড যজ্ঞেশ্বর কোম্পানি গত বছর লাভ করেছে ৬ কোটি টাকা।
১৫টি চিনি কলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন হলেও বর্তমানে বছরে চিনি উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৭০ লাখ টনের মতো অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ। আখের স্বল্পতাই উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন না হওয়ার অন্যতম কারণ।বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আখ চাষিদের দাবির প্রেক্ষিতে তিনবার আখের দাম বৃদ্ধির পরও মিল এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক হচ্ছে না আখ চাষ । বর্তমানে মিলস্গেটে প্রতি মণ(৪০) আখের দাম ১৪০ টাকা। সে হিসেবে ১০০ কেজি আখের দাম ৩৫০ টাকা। সদ্যসমাপ্ত মাড়াই মৌসুমে করপোরেশনের গড় চিনি আহরণ হার ছিল ৫.৮৩%। সে অনুযায়ী ১০০ কেজি আখ থেকে চিনি পাওয়া যায় ৫ কেজি ৮৩০ গ্রাম। ৫০ টাকা কেজি হিসেবে যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৯১ দশমিক ৫০ টাকা। অর্থাৎ ১০০ কেজি আখ থেকে যে চিনি পাওয়া যায় তা বিক্রি করে আখের দামই উঠেনা। তারপরতো রয়েছে উৎপাদন উপকরণ- চুন, সালফারের দাম , জ্বালানি খরচ, শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতনÑভাতা, আখ পরিবহণ খরচ এবং যন্ত্রপাতি মেরামতসহ অন্যান্য ব্যয়।এ অবস্থাতে চিনি কলগুলি লাভ করবে কীভাবে? সম্প্রতি (১৫ মে বুধবার ) জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটিতে বিএসএফআইসির প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। তাতে সংস্থাটি চিনিকলের লোকসানের কিছু কারণ উল্লেখ করে। কারণগুলো হলো- উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয় মূল্য কম, পুঞ্জিভূত ঋণ ও সুদ, আখের উন্নত জাতের উদ্ভাবন না হওয়া, কারখানার আধুনিকায়ন না হওয়া ও দক্ষ জনবলের অভাব। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে কম দামে বাজারজাত করা। লোকসানের পাশাপাশি করপোরেশনের ব্যাংক ঋণ ও দায় দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। করপোরেশনের দাবি লোকসান কমাতে ব্যাংকঋণ সুদসহ এককালীন মওকুফ করা হোক। এ ছাড়া বিএসএফআইসি না লাভ না ক্ষতি পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত সরকারি রাজস্ব খাত থেকে বেতন প্রদান।

দেখা গেছে সরকারিভাবে চিনির দাম ৬০ টাকা নির্ধারণ করলে বেসরকারি পরিশোধন কারখানগুলো তাদের পরিশোধিত চিনি ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে । আবার চিনির দাম কমিয়ে সরকার প্রতি কেজির দাম ৫০ টাকা নির্ধারণ করলে পরিশোধন কোম্পানিগুলো বিক্রি করে ৪৮ টাকা কেজিতে। অন্যদিকে পরিশোধন কারখানা গুলোর উৎপাদিত চিনির রং ধবধবে সাদা। এসব কারণে সরকারি চিনি কলে উৎপাদিত চিনি বিক্রি হয় না। দেশে বর্তমানে ৬ টি চিনি পরিশোধন কারখানা রয়েছে। এসব কারখানাগুলো ব্রাজিলও থাইল্যান্ড থেকে র-সুগার আমদানি করে পরিশোধন করে বাজারজাত করছে। এসব পরিশোধন কারখানাগুলোর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৩২ লাখ মেট্রিক টন। আর দেশের বার্ষিক চিনির চাহিদা ১৪ লাখ টন। শর্ত ছিল পরিশোধন কারখানাগুলো তাদের উৎপাদিত চিনির ৫০% বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। কিন্তু তারা সে শর্ত ভঙ্গ করে বিদেশে রপ্তানি না করে উৎপাদিত সমুদয় চিনিই দেশে বাজারজাত করছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কৃষি ভিত্তিক চিনি শিল্প ও আখ চাষিগণ।
কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা ছাড়া দেশের কোটি কোটি কৃষকের ভাগ্য উন্নয়ন সম্ভব নয়। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পই পারে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে। সে লক্ষ্যেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে স্থাপন করা হয় কৃষি ভিত্তিক চিনি শিল্প। চিনি শিল্পগুলি শুধু চিনি উৎপাদনই করেনা।স্বল্প সুদে আখ চাষিদের মধ্যে বীজ ,সার ও কীটনাশক বিতরণ করে। প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়। আখ চাষিদের প্রশিক্ষণদেয়। আখের সাথে সাথি ফসল হিসেবে আলু, পিঁয়াজ , রসুন, শীতকালীন সবজি, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল উৎপাদনে আখ চাষিদের উদ্বুদ্ধ করে। আখ চাষিদের মেধাবী ছেলে-মেয়েদের এককালীন বৃত্তি প্রদান করে। মিলজোন এলাকায় রাস্তা-ঘাট ও ব্রিজ-কালভার্ট মেরামত করে।আখ চাষিদের উৎপাদিত সমুদয় আখ সরকার নির্ধারিত দামে ক্রয় করে। আখের মূল্য হিসেবে চিনিকলগুলি আখ চাষিদের মধ্যে কোটি টাকা বিতরণ করে, যা গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে এবং এই শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় অর্ধকোটি মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখে। চিনিকল এলাকায় অনেক কৃষক আছেন যাদের পাকা বাড়ি নির্মাণ হয়েছে আখের টাকায়। যাদের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ব বিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছেন আখ বিক্রির অর্থে। চিনিকলগুলি চিনি উৎপাদনের সাথে অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করে, তাতে লাভবান হচ্ছেন দেশের ক্ষুদ্র – প্রান্তিক কৃষক ও ভোক্তা সাধারণ। সে হিসেবে চিনি পরিশোধন কারখানাগুলি দ্বারা এদেশের কৃষকের কোনো উপকারই হচ্ছে না। উপকার হচ্ছে ব্রাজিল ও থাইল্যান্ডের কৃষকের । আমরা সবাই বলি- কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। সেটা যদি সত্য হয়, তা হলে আর দেরি না করে অনতিবিলম্বে আখ চাষিদের পাওনা আখের মূল্য পরিশোধে সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সাথে চিনিকলগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারেও সঠিক ও বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সরকারকেই ।অন্যথায় সরকারি চিনিকলগুলি বন্ধ হলে বেসরকারি পরিশোধন কারখানাগুলোর একচেটিয়া ব্যবসার কারণে দেশবাসীকে বর্তমানের দ্বিগুণ দামে চিনির স্বাদ ভোগ করতে হবে-এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

Exit mobile version