Site icon

জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ ২০১৯: ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম

জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ ২০১৯

ড.ইয়াহিয়া মাহমুদ

জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ ২০১৯ ঃ “কোনো জাল ফেলবো না, জাটকা ইলিশ ধরবো না” এ প্রতিপাদ্যকে উপজীব্য করে গত ১৬ মার্চ হতে ২২ মার্চ ২০১৯ দেশব্যাপী জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করে। এরমধ্যে ছিল ক্রোড়পত্র প্রকাশ, সংবাদ সম্মেলন, কর্মশালা, ভিডিও প্রদর্শনী ইত্যাদি। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাটকা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে বিষয়টিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়াই ছিল এ সপ্তাহের মূল উদ্দেশ্য। জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের এবারকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
(১০ইঞ্চি/২৫সেন্টিমিটার এর নীচে) বলা হয়। আজকের জাটকাই আগামী দিনের ইলিশ। জাটকা নদ-নদীতে বিচরণ করে। তখন জেলেরা নির্বিচারে জাটকা আহরণ করতে চায়। নির্বিচারে জাটকা ধরা হলে ইলিশ উৎপাদন ও আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা জাটকা মাছ ইলিশ মাছের নতুন প্রজন্মের প্রবেশন স্তর। পহেলা নভেম্বর থেকে ৩১ জুন মাস পর্যন্ত জাটকা ধরা, বিপনন, পরিবহন ও মজুত বন্ধ থাকে। আইন অমান্যকারী কমপক্ষে ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদন্ড অথবা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।


ইলিশের জীবন চক্র বৈচিত্রময়। এরা সাগরের লোনাপানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরবর্তীতে আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে অভিপ্রায়ন করে। ইলিশ মাছ সারা বছরই কম বেশী ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের ১ম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে এরা প্রধানত: ডিম ছাড়ে। এজন্য গত বছর (২০১৮) মা ইলিশ সুরক্ষায় আশ্বিনের বড় পূণির্মার পূর্বের ৪ দিন এবং পরের ১৭ দিন (৪+১+১৭) অর্থাৎ ২২ দিন (০৭-২৮ অক্টোবর) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখা হয়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে এসময় প্রজননক্ষম মা ইলিশের শতকরা হার ছিল ৯৩ ভাগ এবং এর মধ্যে ৪৮ ভাগ পরিপক্ক মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে । ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী গত বছর ২২ দিন মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকরণের ফলে ৭ লক্ষ ৬ হাজার কেজি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। এতে ৫০ ভাগ ডিমের সাফল্যজনক পরিস্ফুটন হলে এবং এর ১০ ভাগ বেঁচে থাকলে ৩৫ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে গবেষকগণ মনে করছেন।


ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে দেশে ইলিশের ৬টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরমধ্যে নিম্ম মেঘনা নদী, শাহাবাজপুর চ্যানেল, তেতুলিয়া নদী, নি¤œ পদ্মা নদী এবং বরিশাল জেলার সদর, হিজলা এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার কালাবদর নদী, গজারিয়া ও মেঘনা নদীতে (৮২ কিলোমিটার) মার্চ-এপ্রিল মাসে মাছ ধরা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইলিশের মোট আয়ুস্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারাজীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠাপানি ও লোনাপানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ ¯্রােতের বিপরীতে দৈনিক ৭০ কিলোমিটার অভিপ্রায়ন করতে পারে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের ৭০-৭৫ ভাগ বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার এবং ৩য় অবস্থানে ভারত। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া অপর ১০টি দেশেই ইলিশ উৎপাদন কমেছে। সুষ্ঠু ও সঠিক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল বাস্তবায়নের কারণে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উৎপাদন ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫ লক্ষ ১৭ হাজার মে.টনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য মতে ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড় এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মেদির হাওড়েও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লক্ষ ৯০ হাজার মে.টন। ২০১৭-১৮ সালে তা ৫.১৭ লক্ষ মে.টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ১০ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ-যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। গত ২০১৬ সালে ইলিশ ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশের স্বত্ত্ব এখন শুধুই বাংলাদেশের।


ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি জেলে পরিবারকে ভিজিএফ কর্মসূচীর আওতায় জাটকা ধরা বন্ধকালীন সময় বিনামূল্যে ৪০ কেজি করে চাল প্রদান করা হবে। বর্তমান সরকারের যুগোপযোগী এসব সমাজবান্ধব কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং জাটকা ও মা ইলিশ সুরক্ষার ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেছেন। ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। উক্ত ফ্যাটি এসিড়ের প্রায় ২% ওমেগা-৩ ফ্যাটি এডিসড-যা মানবদেহের কোলেস্টরেলের পরিমাণ হ্রাস করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া, ইলিশ মাছের আমিষে ৯ ধরণের এ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়- যা মানুষের পাকস্থলী তৈরী করতে পারেনা। ইলিশের চর্বিতে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন এ এবং ডি থাকে। এজন্য ইলিশ স্বাস্থ্যবান্ধব মাছ হিসেবে অধিক পরিচিত।

(লেখক: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানী)

Exit mobile version