কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
নড়াইলের মাঠে মাঠে এখন হাওয়ায় দুলছে জিরা গাছের ক্ষেত। ফুলের গন্ধে মৌমাছি ভিড় করেছে, হলুদ জিরা গাছে সোনালী ফসল। কোথাওবা চলছে ফসল কেটে তা মাড়াইয়ের কাজ। চাষীরা অনেক আশা নিয়ে বুনেছেন বিদেশী দামী মসলা জিরা। পাঁচ শতক থেকে শুরু করে দেড় একর পর্যন্ত জমিতে কৃষকরা আসল জিরা মনে করে এই বীজ বপন করেছিলেন। এখন ফল পেকে যাওয়ার পরে বুঝতে পারছেন এটা আসলে জিরা নয়। এভাবে আসল জিরা মনে করে জিরা সদৃশ ‘শলুক’ চাষ করে ঠকেছেন নড়াইলের অন্তত ২০০ কৃষক। অনেকে এখনও আশা করে আছেন লাগানো ক্ষেতে জিরা হবে আর তার বীজ বিক্রি করবেন চড়া দামে। কৃষি বিভাগ বলছেন এটা জিরা জাতীয় একটি মসলা যার নাম ‘শলুক’।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানা যায়, এ বছর নড়াইলে জিরার মতো দেখতে শলুক চাষ হয়েছে প্রায় ১২ একর জমিতে। কৃষি বিভাগ থেকে ইতিমধ্যে শলুক চাষীদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করা হয়েছে। তবে কৃষকদের তথ্য অনুযায়ী জেলায় কমপক্ষে ২০ একর জমিতে এই ভেজাল জিরার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে প্রায় ২০০ কৃষক এবং পাশের ফরিদপুর থেকে শলুকের বীজ সংগ্রহ করেছেন অর্ধশতাধিক কৃষক।
গত বছর নড়াইল শহরের ভাটিয়া গ্রামের কৃষক জিয়াউর রহমান তার এক আতœীয়ের মাধ্যমে ইরান থেকে বীজ এনে জিরা চাষ করেছেন বলে ঘোষনা দেন। সেই ক্ষেতে জিরা বড় হলে তা দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভীড় করেন। মেলা জমে যায় মাঠের মধ্যে। একপর্যায়ে ভীড় সামাল দিতে ওই ক্ষেতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ খবর পেয়ে কৃষি বিভাগ মাঠ পরিদর্শন করেন। স্থানীয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশনে জিরা চাষের সাফল্যের খবর প্রচারিত হলে তা সরেজমিন দেখতে আসেন বগুড়া মসলা গবেষনা কেন্দ্রের দুই কৃষিবিজ্ঞানী। স্থানীয় কৃষি বিভাগ এবং বগুড়ার মসলা গবেষনা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে এই ফসলকে ‘শলুক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে সে সময় জিরাচাষী জিয়াউর রহমান কৃষি বিভাগের তথ্য কে ভুল বলে উড়িয়ে দেন। তিনি শলুককে জিরা হিসেবে প্রচার করতে থাকেন।
জিয়াউর রহমান ছয় শতক জমিতে চাষ করে এক মন পনের কেজি বীজ উৎপন্ন হয়। পরবর্তীতে তার ( জিয়াউর রহমান) সাফল্য দেখে এলাকার কৃষকেরা জিরা মনে করে তার কাছ ১০ হাজার টাকা কেজি দরে বীজ সংগ্রহ করেন। উৎপাদিত জিরা নামের শলুক বীজ কেজি প্রতি ১০ হাজার টাকা বিক্রি করে তিনি প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা বানিজ্য করেছেন বলে জানা গেছে। জিরা চাষের খবর নড়াইলের পাশের মাগুরা ও যশোর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে সেখারকার চাষীরাও জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করেন। এভাবে জেলায় কমপক্ষে ২০০ কৃষক এবং জেলার বাইরে প্রায় ৫০ জন কৃষক জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে বীজ কিনে ঠকেছেন বলে স্থানীয়দের ধারনা।
নড়াইল সদরের নাকশী গ্রামের সৌখিন কৃষক সেলিম মল্লিক। তিনি অর্ডার দিয়ে ভাটিয়া গ্রামের জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে এক কেজি জিরার বীজ কিনেছিলেন ১০ হাজার টাকায়। অনেক আশা করে বুনেছিলেন প্রায় এক একর জমিতে। চার বার চাষ এবং চার বার সেচ দিয়ে ফসল তৈরী করেছেন। কিন্তু গাছে ফল আসার পর থেকে তার মনের সন্দেহ বাড়তে থাকে। এলাকার নানা জন নানা কথা বলতে থাকে। একসময়ে নিজে ভালো করে ফসল দেখে এবং গন্ধ শুকে বুঝতে পারেন এটা আসলে জিরা নয়। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ফসল পেকে এ পর্যন্ত আসতে তার খরচ হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। এই ফসল করতে ট্রাকট্ররের কিস্তি ও মার খেয়েছি, কাকে অভিযোগ করবো। এখন তার সবই মার গেলো। জিয়াউর রহমানের ক্ষেতে যে রকম মানুষ ভীড় করেছিলো তাতে মনে হয়েছে ওটা আসল জিরা। তাছাড়া কৃষি বিভাগ ও কোন ঘোষনা দেয়নি, আমাদের কিই বা করার আছে।
ভান্ডারীপাড়া গ্রামের প্রবীণ কৃষক নওশের কাজী ভাটিয়ার জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে ২শ গ্রাম বীজ কিনেছিলেন ১৯’শ টাকা দিয়ে। সবচাইতে উচু জমিতে আশা করে বুনেছিলেন জিরার বীজ। ফসল কেটে মাড়াই এর সময় তিনি বুঝতে পারলেন এটা জিরা নয়।এখন জিরা না পেয়ে তিনি হতাশ এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। কৃষি বিভাগের লোকেরা মাঠে এসেও তাকে কোনদিন সতর্ক করেনি। তার দাবী, তাকে জিরার বীজ হিসেবে দিয়ে ঠকিয়েছেন ভাটিয়ার জিয়াউর রহমান। তিনি ও পাশ্ববর্তী আরো ৭জন কৃষক প্রতারনার জন্য জিয়াউর রহমানের নামে মামলা করতে চান। তিনি জানান বিশ শতক জমিতে এই ৪ মাসে আমি প্রায় ১৫ হাজার টাকার মুশুড়ী পেতাম এখন কৃষানের টাকা সহ আরো ২০ হাজার টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে।
একইভাবে মুলিয়ার ননীক্ষীর গ্রামের প্রদোৎ বিশ্বাস,দিলীপ রায়,বাগডাঙ্গা গ্রামের হোসাইন কবীর,শাহাদত,আকব্বর লোহাগড়া উপজেলার শালনগরের যাদু আলী, ওসমান মুন্সীসহ কৃষকেরা আশা করে জিরার বীজ বপন করে ঠকবার আশংকায় রয়েছেন। জিয়াউর রহমান ছাড়াও ফরিদপুরের কোন এক এলাকা থেকে জিরা এনে বুনেছেন অনেকে। এদের অধিকাংশের দাবী যদি জিরা না হয়ে শলুক হবে তাহলে কৃষি বিভাগ থেকে কেন এই ঘোষনা দিচ্ছেন না।
কৃষকদের অভিযোগের ব্যাপারে কৃষক জিয়াউর রহমান বলেন, তিনি কাউকেই জিরার বীজ হিসেবে এটা দেননি। তিনি জানান, আমি সবাইকে বলেছি এটা জিরা তবে সরকারীভাবে তারা এটাকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাছাড়া সব বীজ তো আর দশ হাজার টাকা বিক্রি হয়নি ৮হাজার বা তার কমও বিক্রি হয়েছে। এ বছরও জিরা বীজ বিক্রির আশায় আছেন তিনি।
জিরা মনে করে শলুক চাষ করে কৃষকদের সঙ্গে এই প্রতারনার জন্য কৃষি বিভাগের উদাসীনতাকেই দায়ী করলেন স্থানীয় কৃষক নেতা ও ভোক্তা অধিকার সংশ্লিষ্ট লোকেরা।
জাতীয় কৃষক সমিতি নড়াইল জেলার নেতা কাজী কাজী খায়রুজ্জামান জানান, কৃষকরা জিরার বীজ মনে করেই তা বপন করেছেন। আর কৃষি বিভাগ বলছে, এটা জিরা সদৃশ শলুক নামের একটি মসলা। এটা আদৌ মসলা কিনা এবং এটা আমাদের স্বাস্থ্যগত ঝুকি আছে কিনা তা পরিস্কার করেনি। এটা প্রচলিত ফসল নয়, তাই কৃষি বিভাগের উদ্যোগেই কৃৃষকরা সঠিক পথে যেতে পারবে।
সমাজকর্মী মো. রেজাউল করীম জানান, আমাদের দেশে জিরা প্রধানত ইরান থেকে আসে। তবে ভারতে এই শলুকের ব্যাপক চাষ হয়। তা আবার জিরার মধ্যে ভেজাল দিয়ে বিক্রি হয়। ফলে আমাদের দেশে এই ভেজাল জিরার চাষ বাড়লে তা এক ধরনের ফন্দিবাজ লোকের জন্য সুবিধা হবে। সাধারন মানুষ ও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটির নড়াইলের সাধারন সম্পাদক কাজী হাফিজুর রহমান জানান,শলুক এখনো চাষের পর্যায়ে আছে। এখন কৃষকের দাম দিয়ে জিরা মনে করে একদিকে যেমন ঠকছে অন্যদিকে এটি বাজারে আসলে একশ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ীরা এটি জিরায় ভেজাল দিয়ে ভোক্তাদের ঠকাবে। এখনই এই ভেজার জিরার চাষ বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগ তেমন কোন পদক্ষেপ না নিলে ও কৃষকের অভিযোগের অপেক্ষায় আছেন তারা।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের উপপরিচালক মোঃ আমিনুল ইসলাম জানান, গতবছরই জিয়াউর রহমানের ক্ষেত পরীক্ষা করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি এটা জিরা নয়, শলুক। জিরা ও শলুক একই গোত্রের তবে আলাদা ফসল। তবে শলুক ভারতে ব্যাপক চাষ হয়। একশ্রেনীর অসাধূ ব্যবসায়ীরা এটিকে জিরার সঙ্গে ভেজাল দিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করে।
কৃষি বিভাগের উদাসীনতার কারনে চাষীরা জিরা মনে করে শলুক চাষ করে ঠকছেন এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের অগোচরে জিয়াউর রহমান জিরা বলে এটাকে চালাচ্ছেন, তবে তাকে বলা হয়েছে এটা শলুক হিসেবেই বিক্রি করতে। এছাড়া কোন কৃষক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক
কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
মফস্বল সম্পাদক, কালের কণ্ঠ
বসুন্ধরা, বারিধারা,ঢাকা। মুঠোফোন: ০১৭১১-৩৬৪৪৮৫