আকাশের তারার মত পৃথিবীর বুকে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা জোনাকির আলো রহস্য

জোনাকি পোকা
মো. আব্দুর রহমান, বাকৃবি:
রাতের আকাশের তারার মত পৃথিবীর বুকে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা ছোট্ট পোকাটির নাম জোনাকি। শহরের আলোয় এই সুন্দর পোকাটি নজরে না পড়লেও গ্রামে রাতের বেলা অসংখ্য জোনাকি পোকা দেখা যায়। মনে হয় রাতের আকাশের তারা মাঠের ওপর নেমে এসেছে। এর তলপেটে স্বয়ংপ্রভ নীলাভ-সবুজ দ্যুতি থাকে। রাতের অন্ধকারে এদের তারার মত মিটমিট করতে দেখা যায়। এরা সমবেতভাবে এক ছন্দে মিটমিট করতে পারে। জোনাকির বিজ্ঞানসম্মত নাম(Lampyris noctiluca)| আমাদের বাঙলা সাহিত্যে অদ্ভুত সুন্দর এই পোকাটিকে রচিত হয়েছে অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি এই আলো ওরা পেল কোথায়? কীভাবেই বা জ্বলে ওই আলো? আলো মানেই তাপ, জোনাকি কীভাবে সেই তাপ সহ্য করে? কিংবা আলো জ্বালাতে গিয়ে জোনাকি জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যায় না কেন?
বিজ্ঞানীদের মতে, জোনাকি পোকার দেহ থেকে আলো বিচ্ছুরণের মূল মাধ্যম হলো লুসিফেরিন (luciferin) নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ। জোনাকি পোকার দেহে এই কেমিক্যালটি উৎপাদন হয়, যা বাতাসের অক্সিজেনের সাথে মিশে আলো তৈরি করে। এর থেকেই আমাদের মনে হয় জোনাকি পোকা আলো বিচ্ছুরণ করে। আমাদের দেশে শুধুমাত্র সবুজ আলোর জোনাকি পোকা দেখা যায়। কিন্তু অন্যান্য অনেক দেশে লাল আলো বিচ্ছুরণকারী জোনাকি পোকারও দেখা মেলে।
যখন কোনও বস্তু থেকে আলো উৎপন্ন হয়, সেখানে তাপ উৎপন্ন হয়। বৈদ্যুতিক বাল্বের জ্বালানোর আধ ঘণ্টার মধ্যে বাল্বটা ভীষণ গরম হয় ওঠে। সাধারণ বৈদ্যুতিক বাল্ব যে পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি নেয়, তার নব্বই ভাগ তাপ উৎপাদনে ব্যয় হয়। বাকি দশভাগ থেকে আসে আলো। এনার্জি সেভার তাপ উৎপন্ন করে। জোনাকি পোকার ক্ষেত্রেও অ্যানার্জি সেভের ঘটনা ঘটে। আসলে জোনাকির আলো একেবারে ঠান্ডা। তাই নিজের আলোয় জোনাকি জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যায় না। লুসিফেরাসের কাজ হচ্ছে জোনাকি পোকার খাদ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আলো ও তাপশক্তি উৎপন্ন করা। লুসিফেরিন উৎপন্ন তাপকে ঠান্ডা করে সেগুলোকেও আলোতে পরিণত করে।
আবার উৎপন্ন আলোর বিচ্ছুরণ ঘটানো কাজটাও করে লুসিফেরিন। সুতরাং জোনাকি পোকা হলো পৃথিবীর সর্বোকৃষ্ট আলো উৎপাদনকারী প্রাণি। অন্ধকারে পথ দেখার জন্য জোনাকি আলো জ্বালে না। জোনাকির আলো আসলে তার ভাষা। মানুষ ভাব বিনিময়ের জন্য কথা বলে। কথা বলে নিজের মনের কথা আরেক জনকে বোঝাতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ কীট-পতঙ্গই মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারে না। কেউ ডানা ঝাপটে, কেউ পা দিয়ে শব্দ করে ভাবের আদান-প্রদান করে। জোনাকি সেটাও করতে পারে না। তার ভাব বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম হলো তার আলো। জোনাকির আলো একটানা জ্বলে না। একবার জ্বলে এবং নেভে।
সাধারণত সমুদ্রের সিগন্যাল লাইটগুলোও এভাবে জ্বলে আর নেভে। তাই বলাই যায় জোনাকি এভাবে আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে অন্যদের কাছে সিগন্যাল পাঠায়। মানে ভাব বিনিময় করে। প্রজননের জন্যই জোনাকি মূলত আলো জ্বালায়। পুরুষ জোনাকিগুলো উড়তে উড়তে আলো জ্বালে। সঙ্কেত পাঠায় স্ত্রী জোনাকির উদ্দেশ্যে। স্ত্রী জোনাকিরা তখন ঝোপের আগায় কিংবা ঘাসের ওপর বসে থাকে। পুরুষ জোনাকির সঙ্কেত এসে ধরা পড়ে তাদের মস্তিষ্কে। স্ত্রী জোনাকিরা তখন সেই সঙ্কেতে সাড়া দেয়। নিজেরাও সঙ্কেত পাঠায়। সঙ্কেত লক্ষ করে ছুটে যায় পুরুষ জোনাকির কাছে। তারপর তাদের বন্ধুত্ব হয়। তারপর মিলন। এভাবে স্বাভাবিক কার্যক্রম চললেও মাঝে মাঝে এ আলো তাদের জন্য ফাঁদ হয়ে ধরা দেয়। কারণ অনেক জোনাকি আবার এ আলো দেখে আকর্ষিত হয়ে গিয়ে দেখে, ডেটিংয়ের বদলে সেখানে অপেক্ষা করছে মৃত্যু। অনেক জোনাকি তাদের উদরপূর্তির জন্যও এ কৌশল কাজে লাগায়।
শত শত জোনাকির সঙ্কেত থেকে সঠিক সঙ্কেতটা স্ত্রী জোনাকি চিনতে পারে কীভাবে? আসলে প্রত্যেক জোনাকির সঙ্কেতের ধরণ আলাদা আলাদা। স্ত্রী জোনাকির যে সঙ্কেতটা পছন্দ হয়, ঠিক সেই পুরুষটাকে খুঁজে বের করে। পৃথিবীতে নানা প্রজাতির জোনাকি আছে। শুধু মাত্র নিজের প্রজাতির মধ্যেই জোড়া বাঁধে জোনাকিরা। প্রত্যেক জোনাকিই আলোর সঙ্কেতের ধরণ দেখে বুঝতে পারে সেটা তার স্বজাতির না অন্য প্রজাতির। কোন স্ত্রী বা পুরুষ জোনাকি অন্য প্রজাতির আলোর সঙ্কেতে সাড়া দেয় না।

কৃষির আরো খবরাখবর জানতে আমাদের পেইজে লাইকদিনঃ facebook.com/krishisongbad.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *