মোঃ মোশারফ হোসেন (শেরপুর থেকে) :
ঝারশিম চাষে লাভ বেশি । নামে মাত্র শ্রমে ও উৎপাদন খরচ কমে, লাভ বেশি হওয়ায় শেরপুরের নকলা উপজেলার উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে বেলে বা বেলে-দোআঁশ মাটিতে ঝারশীম চাষ করে কৃষকরা আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন। বিভিন্ন পুষ্টি গুণ সমৃদ্ধ এই শীম (ঝারশীম) চাষে কৃষকরা নতুন আশার আলো খোঁজে পেয়েছেন। খরচের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ লাভের এই সবজি চাষে নকলার কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।
কয়েক বছর ধরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ও রাজস্ব খাতের অর্থায়নে সামান্য পরিমান জমিতে পরীক্ষা মূলক ভাবে বারি ঝারশীম-৩ জাতের এই সবজি চাষ করা হচ্ছে। গত বছর যেটুকু জমিতে চাষ হয়েছিল, এবছর পরিমানে বেড়ে প্রায় তিন গুণে উন্নিত হয়েছে। এবার ফলনও খুব ভালো হয়েছে। এই সবজির চাষ বাড়াতে পারলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ পাশ্ববর্তী জেলা ও উপজেলাতে সরবরাহ করা সম্ভব বলে মনে করছেন অনেক কৃষক।
বাড়ইকান্দি গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা নান্নূ জানান, তিনি এবছর ৫০ শতাংশ জমিতে ঝারশীম চাষ করেছেন। এই সবজি চাষে শুধুই লাভ। এটি খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। চাষে বাড়তি সেচ, সার, তেল ও কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়না। দুই কি একবার সেচ দিয়ে এবং সামান্য জৈব সার ও ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারেই পোকা মাকড় ধ্বংস করা সম্ভব। বানেশ্বরদী ইউনিয়নের কায়দা গ্রামের ঝারশীম চাষী রহুল আমীন জানান, প্রতি কাঠা (৫ শতাংশ) জমির জন্য দেড় থেকে ২ কেজি বীজসহ সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়, তবে বীজের জন্য প্রস্তুত করতে গেলে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার টাকায়। তবে এই সবজি (ঝারশীম) চাষ যে পরিমাণ লাভ পাওয়া যায়, তা অন্য কোন শাক-সবজি চাষে অসম্ভব।
উপজেলার খারজান গ্রামের ঝারশীম চাষী রফিক মিয়া জানান, বীজ বপনের পরে ৪৫ দিন থেকে ৫০ দিনের মধ্যে এই শীমের উৎপাদন শুরু হয় এবং প্রতি গাছ হতে ৩ থেকে ৪ বার তোলা যায়। এতে করে প্রতি ৫ শতাংশ জমির শীম ক্ষেত হতে কাঁচা অবস্থায় ৬০০ কেজি থেকে ৬৫০ কেজি শীম পাওয়া যায়। প্রতি কেজি কাঁচা শীম সবজি হিসেবে স্থানীয় বাজারে ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা করে এবং শুকনা বীজ ডাল হিসেবে প্রতিকেজি ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা করে বিক্রি করা সম্ভব। ফলে কাঁচা অবস্থায় ৫ শতাংশ জমি হতে ১৫ হাজার টাকা হতে ১৯ হাজার ৫০০ টাকার এবং ২০০ কেজি থেকে ২৫০ কেজি শুকনা বীজ পাওয়া যায়। ফলে প্রতি ৫ শতাংশ জমি হতে কাঁচা অবস্থায় ১১ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা এবং বীজ তৈরী করে বিক্রি করলে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পাওয়া সম্ভব। কৃষকের দেওয়া হিসাব মতে এক একর জমিতে ঝারশীম চাষ করে দুই থেকে তিন মাসেই যে কেউ লাখপতি হতে পারেন।
উপজেলার গনপদ্দী, বানেশ্বরদী, টালকী, চন্দ্রকোণা ও নকলা ইউনিয়নসহ গৌড়দ্বার, পাঠাকাটা, চরঅষ্টধর ইউনিয়ন, পৌরসভার ধুকুড়িয়া, লাভা, গড়ের গাঁও, জালালপুর ও কায়দা এলাকার জমি অপেক্ষাকৃত উঁচু এবং দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ হওয়ায় ওইসব এলাকা ঝারশীম চাষ করার উপযোগী। বানেশ্বরদী ইউনিয়নের কায়দা গ্রামের রহুল আমীন, ‘ভূরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থা’র ছায়েদুল হক, আমীর আলী, ইব্রাহীম, হেলাল উদ্দিন, ঈসমাইল হোসেন, শাখাওয়াত হোসেন ও জব্দুল মিয়া; বাড়ইকান্দি এলাকার মিন্টু মিয়া, লূৎফর রহমান ও হেলাল মিয়া, দুধেরচরের লিটন, চন্দ্রকোণার মোকসেদ আলী, মোক্তার হোসেন ও জাফর আলী; নকলা এলাকার মোশারফ, কব্দুল ও লিটন মিয়া; ধুকুড়িয়ার হাফেজ উদ্দিন, হাসেম, নজরুল ও ইসলাম, মধ্যলাভার শহিদুল, পূর্ব লাভার শাহাদত ও আক্তারসহ অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ধানসহ অন্য যেকোন ফসল বা শাক-সবজি চাষে উৎপাদন খরচের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় লাভ কম থাকে। কিন্তু ঝারশীম চাষে লাভ বেশি হওয়ার কথা শুনে তারা এই সবজি চাষে আগ্রহী হয়েছেন। আগামীতে তারা সবাই ঝারশীম চাষ করবেন বলে জানান।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, ঝারশীম চাষ অধিক লাভজনক। এই শীম সাধারণত আড়াই থেকে তিন মাসের ফসল, তাই একই জমিতে একইবছর অন্য আবাদ করা যায়। তাছাড়া ঝারশীমের সাথী ফসল হিসেবে পিয়াঁজ, রসুন, পুঁইশাক ও স্বল্প কালীন অন্য শাক সবজিও চাষ করা যায়। তবে এইক্ষেত্রে শীমের ফলন কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর বলেন, উঁচু ও মাঝারি উঁচু এবং বেলে ও বেলে-দোআঁশ মাটিতে বিশেষ করে বাড়ির আঙ্গীনায় এই সবজি চাষ করা সম্ভব। এই সবজির আবাদ বাড়াতে পাড়লে আমিষের চাহিদা অনেকাংশে মিটবে বলে তিনি আশা করেন। এই সবজির আবাদ বাড়াতে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।