টার্কি চাষে সফল নওগাঁর খামারি জিল্লুর রহমান চৌধুরী

আবুলটার্কি পালন কালাম মুহম্মদ আজাদ: টার্কি বড় আকারের গৃহপালিত পাখি। এদের উৎপত্তি উত্তর আমেরিকায়, কিন্তু ইউরোপসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পালন করা হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্যতালিকায় অন্যতম উপাদান। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে ওঠার ছয় মাসের মধ্যে টার্কি ডিম দেয়। ছয় মাসের মেয়ে টার্কির ওজন হয় পাঁচ থেকে ছয় কেজি। আর পুরুষগুলো প্রায় আট কেজি। আমেরিকায় টার্কির রোস্ট অভিজাত খাবার। আমাদের দেশে মুরগির মাংসের মতো করেই টার্কি রান্না করা হয়। রোস্ট ও কাবাব করা যায়।
নওগাঁর খামারি জিল্লুর রহমান চৌধুরী দুই বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে টার্কি চাষ শুরু করেছেন। জিল্লুর রহমানের বাড়ি নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার সালুকা গ্রামে। জানামতে, দেশে বাণিজ্যিকভাবে এত বড় পরিসরে আর কোনো টার্কির খামার নেই। তিনি ৩০ কাঠা জমির ওপরে নিজের বাসগৃহের সঙ্গে তিনতলা বিশিষ্ট এই খামার গড়ে তুলেছেন।
এই খামার থেকে পাইকারি ক্রেতারা কিনে নিয়ে দোকানে দোকানে বিক্রি করেন। সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় এখনো দাম একটু বেশি। সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে টার্কি খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়নি। সালুকা গ্রামের ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম জানান, জিল্লুর রহমান চৌধুরী এলাকার মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁর কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে অনেক শৌখিন খামারি ছোট আকারে টার্কি পালন শুরু করেছেন। তিনি নিজে এর মাংস খেয়েছেন। খেতে সুস্বাদু।
টার্কির একজন পাইকারি ক্রেতা আবদুর নূর তুষার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জিল্লুর রহমান চৌধুরীর খামার সবচেয়ে বড়। তাঁর কাছ থেকে সাশ্রয়ী দামে কেনা যায়। এই টার্কি তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নাটোর ও কুমিল্লায় সরবরাহ করেন। এর মধ্যে সিলেট এবং চট্টগ্রামে টার্কির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। খাসির মাংসের মতো স্বাদ।
জিল্লুর রহমান এইচএসসি পাস করার পর দিল্লির রামজেস কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন। চার মাস ক্লাস করার পরে মন টেকেনি। পরের বছর আমেরিকার নর্থ ডালাস হাইস্কুলে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। কিন্তু পড়াশোনা আর শেষ করতে পারেননি। এরই মধ্যে টুইন টাওয়ার হামলা। ২০০২ সালের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
গ্রামে এসে তিনি চালকলের ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি গরু ও ভেড়ার খামার করেন। এর মুনাফা দিয়ে ৩০ কাঠা জমি কিনে বর্তমান খামারটি শুরু করেন। পরে মুরগির খামার করেন। চার-পাঁচ বছর বেশ মুনাফা হয়। কিন্তু শেষের দিকে লোকসান হতে থাকে। মুরগির মড়ক ঠেকাতে পারেন না।
জিল্লুর রহমান এর বিকল্প খুঁজতে থাকেন। আমেরিকায় থাকার সময় টার্কির খামার দেখে এসেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়ায় টার্কি বাঁচে কি না, তাঁর ধারণা ছিল না। খোঁজ নিতে থাকেন। জানতে পারেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই বাণিজ্যিকভাবে টার্কির চাষ হয়ে থাকে। এখন থেকে দুই বছর আগে ঢাকার এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ভারত থেকে ২২টি বাড়ন্ত টার্কির বাচ্চা আমদানি করেন, যার প্রতি জোড়ার দাম পড়ে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। এই ২২টি টার্কির মধ্যে মোরগ ১৪টি এবং মুরগি ৮টি। তিনি টার্কি পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। সেভাবেই কাজ শুরু করলেন।
জিল্লুর রহমান দেখলেন, টার্কির খাবার নিয়ে মুরগির চেয়ে দুর্ভাবনা কম। এরা ঠান্ডা-গরম সব সহ্য করতে পারে। দানাদার খাবারের চেয়ে কলমির শাক, বাঁধাকপি বেশি পছন্দ করে। এগুলো জোগাড় করা সহজ।
টার্কিগুলো শুরু থেকেই ডিম দিতে থাকে। ডিম ফোটানোর জন্য জিল্লুর রহমান ৪০০ দেশি মুরগি জোগাড় করলেন। এরই মধ্যে শুরু হলো মড়ক। একটা-দুইটা করে মুরগি মরতে শুরু করল। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি টার্কি এই মুরগির মধ্যে ছেড়ে দিলেন। পাশাপাশি তিনি তিতির পাখিও পুষতে শুরু করেছিলেন। কয়েকটি তিতিরও ছেড়ে দিলেন এই আক্রান্ত মুরগির ঘরে। একে একে ৪০০ মুরগি মরে গেল, কিন্তু একটি টার্কিরও কিছু হলো না। একটি তিতিরও মরল না। তিতির ও টার্কি পালন নিয়ে একটা আস্থা তৈরি হলো তাঁর। গত দুই বছরে তিনি ২২টি টার্কি থেকে প্রায় ৭০০ টার্কি বিক্রি করেছেন। বর্তমানে খামারে রয়েছে ৬০০ টার্কি। বাচ্চা ফোটার অপেক্ষায় রয়েছে ৫০০ ডিম। এখন ডিম দেওয়ার উপযোগী প্রতি জোড়া টার্কি বিক্রি করছেন আট হাজার টাকায়।
জিল্লুর রহমান বলেন, প্রথমে তিনি ডিম ফোটানো নিয়ে একটু বিপাকে পড়েন। তারপর নিজেই একটি ‘ইনকিউবেটর’ যন্ত্র তৈরি করে ফেলেন। এতে একসঙ্গে এক হাজার ডিম ফোটানো যায়। কিন্তু যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয় না। এ জন্য দিনে কয়েকবার ডিম উল্টে দিতে হয়। আর আর্দ্রতা ঠিক রাখার জন্য যন্ত্রের বাইরে পানি ছিটাতে হয়। ভেতরেও পানি রাখতে হয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে ২৭ দিনে টার্কির ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। আর তিতিরের ২৪ দিন লাগে।
সম্প্রতি জিল্লুর রহমানের খামারে গিয়ে দেখা যায়, এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘নাফি পাখি সংগ্রহশালা’। শুধু টার্কি নয়, তিতির, লাভ বার্ড, হরেক রকমের কবুতর ও ফেনসি বার্ডসহ প্রায় ৪০ জাতের পাখিতে বাড়িটা যেন একটা চিড়িয়াখানা হয়ে গেছে।
টার্কি রাখা হয়েছে তৃতীয় তলায়। টার্কির ঘরে ঢুকতেই দলবেঁধে একদিকে দৌড়ে পালাচ্ছে। এ সময় ময়ূরের মতো লেজ ফুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আর ডাকাডাকিতে ঘর মাথায় তুলছে। দ্বিতীয় ও নিচতলায় রাখা হয়েছে তিতির ও অন্যান্য পাখি। জিল্লুর রহমান বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য হলো বাণিজ্যিকভাবে মাংস উৎপাদন ও ব্রিডিং করে এ প্রজাতির বংশ বৃদ্ধি করা এবং বাচ্চাগুলো আগ্রহী খামারিদের মাঝে বিতরণ করা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি অ্যান্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটির সভাপতি জালাল উদ্দিন সরদার টার্কি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি জিল্লুর রহমানের খামার পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, মাংস উৎপাদনের জন্য টার্কির সাতটি আদর্শ জাত রয়েছে। পাখিজাতীয় মাংস উৎসের মধ্যে মুরগি, হাঁস, তিতির, কোয়েলের পর টার্কি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। টার্কির মাংস অন্যান্য পাখির মাংস থেকে কম চর্বিযুক্ত, তাই অন্যান্য পাখির চেয়ে টার্কির মাংস অধিক পুষ্টিকর। পশ্চিমা দেশগুলোতে টার্কি অধিক জনপ্রিয়। সবচেয়ে বেশি টার্কি পালন করা হয় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্যসহ প্রভৃতি দেশে। জালাল উদ্দিন সরদার বলেন, তাঁর জানামতে বাংলাদেশে জিল্লুর রহমানই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে টার্কি চাষ শুরু করেছেন।

কৃষির আরো খবরাখবর জানতে আমাদের পেইজে লাইকদিনঃ facebook.com/krishisongbad.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *