জান্নাত ঝুমাঃ
নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ট্যাংরার কৃত্রিম প্রজনন ও রেণুপোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর বিলুপ্ত প্রায় গুতুম মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনেও সফলতা লাভ করেছে। উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষনার ফলে এই সফলতা অর্জন হয়েছে। এই গবেষণা পরিচালনা করেন উপকেন্দ্রের প্রধান ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শওকত আহম্মেদ। এছাড়া প্রায় ৬৫ প্রজাতির বিলুপ্ত মাছের মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কথিত বউ/রানী মাছ, খলিশা, চেঙ, শোল, টাকিসহ অন্যান্য মাছ নিয়ে উপকেন্দ্রটিতে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখ্য যে ইতোপূর্বে উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীবৃন্দ গবেষনা করে বিলুপ্ত প্রজাতির ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সাফল্যের জন্য স্বীকৃতি স্বরুপ জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ/১৭ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক রৌপ্য পদক অর্জন করেন। পুরস্কার লাভের পর উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে গুতুম মাছসহ বিলুপ্ত প্রজাতির মাছগুলো নিয়ে গবেষণার কাজ জোরেশোরে শুরু করেন।
গুতুম মাছ বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তানে নদী অববাহিকায়, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদিতে এদের দেখা পাওয়া যায় । আমাদের দেশে চলন বিল, ছোট যমুনা নদী, হালতি বিলে এ মাছ পাওয়ার তথ্য নথিভূক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও ময়মনসিংহ, সিলেট, দিনাজপুর এবং রংপুরের ছোট ছোট নদী থেকে সামান্য পরিমাণে মিলছে। মাছটি বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ হিসাবে বিবেচিত না হলেও নদী, খাল-বিল, জলাশয়ে আর আগের মত মিলছে না। ফলে মাছে ভাতে বাঙালি শব্দটিও হারিয়ে যাচ্ছে। মাছটির দেহ পার্শ্বীয়ভাবে সামান্য চাপা। আইশ ছোট ও সুস্পষ্ট এবং মিউকাসে আবৃত। গুচ্ছ পাখনা ও পৃষ্ঠ পাখনায় রেখার ন্যায় দাগ দেখতে। দেহ সাধারণত গাঢ় হলুদ বর্ণের। সাধারণত গুতুম, গুটিয়া, গোরকুন, পোয়া, পুইয়া নামে পরিচিত হলেও এই জনপদে গোতরা বা পুয়া মাছ নামে বেশি পরিচিত। মাছটির সর্বোচ্চ ১৫ সেন্টেমিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে যার বৈজ্ঞানিক নাম Lepidocephalus guntea । গুতুম মাছ পরিণত পুরুষদের দীর্ঘ বক্ষ পাখনার ৭তম ও ৮ম পাখনা রশ্মি একীভূত হয়ে ল্যামিনা সার্কুলারিস নামক গঠন দেখতে পাওয়া যায় যা স্ত্রী মাছে অনুপস্থিত। বক্ষ পাখনা স্ত্রীদের চেয়ে পুরুষদের অধিক হয়ে থাকে একই বয়সের পরিণত স্ত্রীরা পুরুষের চেয়ে স্ফীত, সামান্য লম্বা হয়ে থাকে। যাদের উদরের সম্মুখে দাগ দেখতে পাওয়া যায়। এরা প্রকৃতিতে একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে প্রজনন করে থাকে।
প্রথমে ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে ছোট আকারের গুতুম মাছ সংগ্রহ করে স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রস্তুতকৃত পুকুরে পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য মজুদ করা হয়। এসময় চলে নিবিঢ় পর্যবেক্ষনসহ গবেষণার কাজ। এভাবে মে-জুন মাসের মধ্যেই গুতুম মাছগুলো প্রজননক্ষম হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় এদের পরিপক্ক স্ত্রী মাছের ডিম ধারন ক্ষমতা প্রতি গ্রাম দেহের ওজনে ১৭০০ থেকে ৪৫০০ পর্যন্ত এবং প্রজননকাল এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাস। এসময় পুকুর থেকে মাছগুলোকে সংগ্রহ করে হ্যাচারীতে পুরুষ ও স্ত্রী মাছ পৃথক করে হ্যাচারীর সিমেন্টের ট্যাংকে পানি প্রবাহ দিয়ে ৫-৬ ঘন্টা রাখা হয়। পরবর্তীতে হরমোন ইনজেকশান প্রয়োগ করে ট্রেতে স্থানান্তর করা হয় এবং পানির ঝর্না প্রবাহিত করা হয়। হরমোন প্রয়োগের ৮-৯ ঘন্টা পর স্ত্রী মাছ গুলো ডিম ছাড়ে। এরপর ১২-১৫ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে রেনু বাহির হয়। উক্ত রেনু পরিচর্যার পর ৮ দিন বয়স হলে নার্সারী পুকুরে ছাড়া হয় এবং সেখানে ২ মাসের মধ্যেই পোনাগুলো পুকুরে মজুদের উপযুক্ত হয়। ৮ থেকে ১০ মাসের মধ্যে খাবার উপযোগি হয়ে ওঠে গুতুম। উপকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রায় ১০ সেন্টিমিটার আকারের গুতুম মাছ পাওয়া গেছে।
বর্তমানে এ উপকেন্দ্রে ৩ জন কর্মকর্তাসহ মোট ২০ জন কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। বৈজ্ঞানিকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কর্মচারীদের আন্তরিকতায় একের পর এক বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ গবেষণা করে সুফল বয়ে আনায় সকলের দৃষ্টিতে এসেছে স্বাদুপানি উপকেন্দ্রটি। বাংলাদেশে এই মাছটিকে মুলত খাবারের মাছ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাহারী মাছ হিসাবে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গুতুম মাছের ব্রুড প্রতিপালন, কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা মেলায় প্রাকৃতিতে সংরক্ষণ হবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং সে সংগে দেশের পুষ্টি ও অর্থনিতিতে সাফল্য বয়ে আনবে।
সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রধান ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান জানান, রংপুর অঞ্চলে বেশিরভাগ জলাশয়ে ৬-৮ মাস পানি থাকে বিধায় বিলুপ্ত প্রায় ৬৫ প্রজাতির মধ্যে উক্ত জলাশয়গুলোতে ঐ সময়ের মধ্যেই খাবার উপযোগী হয় এমন প্রজাতির মাছগুলো নিয়ে উপকেন্দ্রে নিরন্তর গবেষণা চলছে যার ফলশ্রুতিতে ট্যাংরার পর গুতুম মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনেও সফলতা এসেছে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বন্যায় স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং পুকুরগুলোর মাছ এলোমেলো হয়ে গেছে। ইনশাল্লাহ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে সব ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়ে গুতুম মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের প্রযুক্তিটি আগামি বছরেই ইনস্টিটিউটের নিকট হস্তান্তরের আশা করছেন তিনি। ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টার ফলে উক্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং খুব শিঘ্রই মৎস্য অধিদপ্তরের নিকট গুতুম মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও রেনুপোনা উৎপাদন প্রযুক্তিটি হস্তান্তর করার পর সারাদেশে তা ছড়িয়ে পড়বে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।