Site icon

ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ কৃষিতে নয়া দিগন্তের সূচনা

কৃষিবিদ মোঃ নূরুল হুদা আল মামুনঃ Soil Test

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি কৃষি। কিন্তু এই কৃষি আজ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে , অন্যদিকে আবাদি জমি কমছে প্রতিনিয়ত। ১৯৭০-৭১ সালে মাথা পিছু জমি ছিল ০.১২ হেক্টর, সেখানে বর্তমানে নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.০৬ হেক্টরে। এ অবস্থায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ক্ষয়িষ্ঞ এ জমি থেকেই। বর্তমান এ চ্যালেঞ্জ থেকেই আমাদের দেশের কৃষকরা এক ফসলি জমি থেকে দুই বা ততোধিক ফসল ঘরে তুলতে জমিতে ব্যাপক হারে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে দিয়ে যাচ্ছেন অনুমান নির্ভর রাসয়নিক সার। অন্যদিকে কতিপয় অত্যাবশ্যকীয় সার আদৌ ব্যবহার করছেন না। এতে মাটির র্উবরা শক্তি যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি অপচয় হচেছ মূল্যবান রাসয়নিক সার। মাটির অনুজীবের কার্যকারীতা হারাচ্ছে। অতিরিক্ত রাসয়নিক সার মাটির নিচে চুয়ে, নদী-নালায় মিশে যাচ্ছে। আবার গ্যাস হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশে পরিবেশ দূষিত করছে।মাটি হতে গাছ তার বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য ১৭টি অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানের মধ্যে ১৪টি উপাদান পেয়ে থাকে। কিন্তু অসমহারে ও যথেচ্ছভাবে সার ব্যবহার ও নিবিড় চাষাবাদের কারণে মাটিতে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় ১৪ টি পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি আশংকাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে ।
এজন্য সার প্রয়োগের পূর্বে অবশ্যই ফসলি জমির মাটি পরীক্ষা করে পরিমিত মাত্রায় সুষম সার দিতে হবে। এতে যেমন মাটির উর্বরতা রক্ষা করা সম্ভব হয় তেমনি সারের অপচয় রোধ করাও সম্ভব হয়। বলা বাহুল্য যে, গত ২০০৮-০৯ সালে দেশে মোট ৩০ লক্ষ ৫ হাজার মেট্রিক টন রাসয়নিক সার ব্যবহার হয়। এর মধ্যে শুধুমাত্র ইউরিয়া সার ব্যবহার হয় ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন। অথচ ইউরিয়া সারের মাত্র একতৃতীয়াংশ ফসলের কাজে আসে। এই বিপুল পরিমান সারে, সরকারের ভর্তূকি গুনতে হয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। অথচ মাটি পরীক্ষা করে পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তূকি বাচাঁনো সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে ফসলের উৎপাদন খরচ হ্রাস পায় এবং ধানের ফলন গড়ে ২০-২৫% এবং অন্যান্য ফসলে ১০-১৫% পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি পায়।
তথ্য প্রযুক্তির এই বিশ্বে অন্যান্য খাতের মতো কৃষি খাতকেও বেগবান করতে তথ্য প্রযুক্তির (আইসিটি) হাওয়া বাংলাদেশের কৃষিতেও লেগেছে। সরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এআইসিসি (এগ্রিকালচার ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন সেন্টার) এবং এফআইসিসি (ফিশারীজ ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন সেন্টার) কৃষকদের জন্য কৃষিতথ্যের পাশাপাশি নানান ডকুমেন্টারী, ছবি, ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদিও সংযোজন করেছে। তথ্য প্রযুক্তি যেনো কৃষকদের কাছে সহজবোধ্য হয় এজন্যই সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে এই প্রচেষ্টা। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে দেশে খাদ্য শস্যের উৎপাদন ২০ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ২৪ মিলিয়ন টনে উন্নীত হবে। তথ্য প্রযুক্তির সুফল কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট হাতে নিয়েছে নানা পদক্ষেপ। এর মধ্যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ কার্যক্রম অন্যতম।
প্রথমতঃ গবেষণাগারের মাধ্যমে ডিজিটাল সার সুপারিশ কার্যক্রম ঃ মাটির নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে ফসলের চাহিদা মাফিক ফসল বিন্যাস অনুযায়ী ডিজিটাল উপায়ে সার সুপারিশ প্রনয়ণ করা হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশের এ সফট ওয়্যারটি বেসরকারি সংস্থা ক্যাটালিস্ট এর সহযোগীতায় প্রনয়ণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে মাটি পরীক্ষার জন্য সরকারীভাবে ১৬(ষোল) টি স্থায়ী গবেষণাগার রয়েছে যা দেশের বৃহত্তর জেলা সমুহে অবস্থিত। কৃষক, গবেষক সহ যেকোন কৃষিজীবী বছরের যে কোন সময়ে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে নিকটস্থ এসব গবেষণাগার থেকে মাটি পরীক্ষা করতে পারেন। গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা মাটির নমুনা পরীক্ষা করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ কার্ড প্রনয়ণ করে থাকেন।
দ্বিতীয়তঃ অনলাইনের মাধ্যমে সার সুপারিশ কার্যক্রম ঃ
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মাটি পরীক্ষার জন্য তৈরি করেছে ‘সারের প্রয়োগমাত্রা নিরূপণের সফটওয়্যার’। মাটিতে কি কি উপাদান আছে তা মাটি পরীক্ষা করে বের করে, এই সফটওয়্যারে বসিয়ে, সেইসাথে জমির পরিমাণটুকু বসিয়ে দিলেই কৃষক বা কৃষিবিদ জেনে যাবেন, তার জমিতে কি পরিমাণ সার লাগবে। তথ্য প্রযুক্তির এই সুফলটিও মাঠ পর্যায়ে অনেক কৃষক এখন গ্রহণ করছে। ত্রিশটি এলাকার প্রায় ২৪০০ জন কৃষক এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে তাদের জমিতে সার প্রয়োগ করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এর ফলে সারের পিছনে কৃষকদের ব্যয় কমে এসেছে, কৃষকের উৎপাদন ভালো হয়েছে এবং মাটির গুণাগুণ উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে এই প্রযুক্তিটি একশটি এলাকায় ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

অনলাইনে  সার সুপারিশ প্রক্রিয়া ঃ
প্রথমে অনলাইন সংযোগ নিয়ে www.frs-bd.com অথবা ww.srdi.gov.bd এই লিংকে প্রবেশ করতে হবে। তারপর ব্যবহার কারী ও পাসওয়ার্ড  হিসেবে উভয় স্থানে ”ঝজউও” দিতে হবে। এরপর এন্টার (ঊঘঞঊজ) চাপতে হবে। নতুন পেজ আসবে, সেখানে কৃষকের নাম,গ্রাম,জেলা,উপজেলা,ইউনিয়ন,মাটির ধরণ,ফসলের ক্যাটাগরি (শস্য /আঁশ/ডাল/মশলা), ফসলের নাম, জমির পরিমাণ (শতাংশে), ভূমির শ্রেণী (উঁচু/মাঝারি উঁচু/ মাঝারি নিঁচু/নিচু/অতি নিচু) এবং টিএসপি/ডিএপি ঈষরপশ করতে হবে। এগুলো ঠিকঠিক ঈষরপশ করার পর  র্সাচ দিতে হবে। কাংখিত সার সুপারিশ র্কাড প্রনয়ণ করে দেবে সফট ওয়ার। এবার প্রিন্ট অপশনে গিয়ে প্রিন্ট দিয়ে সংরক্ষণ করা যাবে।

তৃতীয়তঃ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সার সুপারিশ কার্যক্রম ঃ
বাংলাদেশের বৃহৎ দুটি মোবাইল কোম্পানী গ্রামীণ ফোন এবং বাংলালিংক মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এর চ্যানেল পার্টনার হিসেবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল কোম্পানী- ‘বাংলালিংক’ তাদের জিজ্ঞাসা ‘৭৬৭৬’ নম্বরটি কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলের সেবাদানের জন্য উš§ুক্ত রেখেছে।  যেকোন কৃষক এই নম্বরে ফোন করে মাটির স্বাস্থ্য তথ্য তথা ফসল চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সার সুপারিশ মাত্রা জেনে নিতে পারেন। বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য এটি তথ্য প্রযুক্তির একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। মোবাইলে কৃষিতথ্য পাবার সাথে সাথে কৃষকরা তার গ্রামের টেলিসেন্টারটিতেও (তথ্যকেন্দ্রে ) যাওয়া-আসা করেন। বাংলাদেশে এখন সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে প্রায় ৩০০০ এরও বেশি টেলিসেন্টার রয়েছে। গ্রামীণ ফোনের কমিউনিটি তথ্য কেন্দ্র (ঈওঈ)) থেকে ও কৃষক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ তথ্য পেতে পারেন।এ তথ্যকেন্দ্র গুলো থেকে কৃষি, স্বাস্থ্য, নাগরিক সেবা, আইনী সহায়তা, ব্যবসায়িক তথ্যাবলীসহ নানান তথ্য পাওয়া যায়।

মোবাইলে সার সুপারিশ প্রক্রিয়া:
কৃষক সহজেই তার জমির প্রকার,কি ফসল ফলাতে চান,ইউনিয়নের নাম,উপজেলা ও জেলার নাম এসব তথ্য দিলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে  মোবাইলের মাধ্যমে সার সুপারিশ বিষয়ক তথ্য দেওয়া হয়।
পরিশেষে,প্রযুক্তিবিদরা আশাবাদী, কৃষিবিদদের সাথে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তারা তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুফল পৌঁছে দিতে পারবেন বাংলাদেশের কৃষকদের দোরগোড়ায়। কৃষকদের আগ্রহ এবং নতুন প্রযুক্তির প্রতি আকৃষ্টতা সত্যিই প্রশংসনীয়। হয়তো এমন কৃষকের সংখ্যা মুষ্টিমেয়, তবুও আমরা আশা রাখতে পারি, সহজলভ্য ও স্বল্প সময়ে প্রাপ্ত তথ্যের জন্যই কৃষক ‘তথ্য প্রযুক্তি’ কে সহজভাবে গ্রহণ করবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ সত্যিই কৃষিতে বয়ে আনবে নয়া দিগন্ত।

কৃষির আরো খবরাখবর জানতে আমাদের পেইজে লাইকদিনঃ facebook.com/krishisongbad.com

 

Exit mobile version