শাহ এমরান, স্বপ্ন ডেইরী এন্ড ফিশারিজ
(একজন ডেইরী বিশেষজ্ঞের জবানবন্দি )
আমি সব জানি বা অনেক অনেক বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথাগুলো বলছি তা কিন্তু নয়।তবে কিছুটা লেখাপড়া এবং বাস্তব জ্ঞ্যান হাতে কলমে হয়েছে এটা সত্য। সেই থেকেই লেখা আর বলতে পারেন আমার সময়ের একটা সুন্দর ব্যবহার। অনেক ভাই বলেন ৩-৪ বছর হয়েছে তারপর গরু মোটাতাজাকরণ করে লোকসান হচ্ছে। কিন্তু এটা হবার কথা না। আমাদের অবস্থার সাথে বিবেচনা করে ব্যবসার কৌশলগত কোন ত্রুটি আছে বলে আমার মনে হয়। যে বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ন, যে প্রশ্নের উত্তর গুলো আপনাকে বলে দেবে কেন আপনার ফার্ম লোকসান হচ্ছে তা হলো:
১) আপনার ফার্ম কি আপনি নিজে দেখেন নাকি পুরোটাই কর্মচারী নির্ভর?
ফার্মকে লাভবান করার প্রথম এবং সব থেকে গুরুত্তপুর্ন হলো ফার্মে সব সময় নিজের উপস্থিতি এবং নিজে কাজ করা। আমি জানি আমাদের ফেসবুক বন্ধুদের অনেকেই হয়তো নিজে কাজ করেন না, কর্মচারী নির্ভর। তারপর ও আমি বলবো নিজে কাজ না করলেও নিজের সব সময় উপস্থিতি ভীষন দরকার। আমার পাশের গরীব খামারী ফটিক, দুলাল, জামাল এরা কেন লোকসান করেনা? আমরা কেন করি? আপনার আশে পাশে গরীব খামারী দেখেন উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন। হা আপনি বলছেন এখন, ওরা তো নিজেরা করে, তাই পারছে। আমিও বলছি আপনাকে নিজেকে করতে বা গরুর সং্খ্যা বাড়াতে যদি কর্মচারী রেখে করেন। যেটাই করেন আপনার উপস্থিতি খুব জরুরী। নিজে কাজ করলে একটা ছোট ফার্ম খুব দ্রুত লাভবান হবেই, আর নিজের উপস্থিতি আছে কিন্তু কর্মচারী নির্ভর হলে গরুর সং্খ্যা বাড়াতে হবে। কম গরু দিয়ে অধিক বেতন দিয়ে ফার্ম লাভবান হবেনা। যেমন : ডেইরীর জন্য ৭-৮ টা গরুর জন্য ১ জন্য কর্মচারী, আর মোটাতাজার জন্য ১৫-১৮ টা গরুর জন্য ১ জন কর্মচারী। ফার্মের এই পরিচালনা খরচ যতটুকু সম্ভব কমিয়ে ফেলতে হবে তাহলেই লাভবান হবেন।
২) আপনি কি হিসাব করে দেখেছেন গরু প্রতি প্রতিদিন কত টাকা খাবার খরচ আসে আপনার?
নিউট্রিশন আর খাদ্যের গুনগত মান কি হবে এটা নিয়ে অস্থির সবাই। আমি কিন্তু সত্যি অস্থির না। আমি শুধু ভাবি খরচ কি করে কমিয়ে আনা যায়। আমি ভাবি ফটিক, জামাল, দুলাল কি খাওয়ায়। ওদের গরু যদি ভালো মোটাতাজা হয় কোন রকম মেডিসিন ইঞ্জেকসন ছাড়া তো আমাদের কেন হয়না। প্রশ্নটা এখানেই। এই বছর গ্রামের লোকদের দেখলাম খাবার পিলেট করে বানিয়ে খাওয়াতে। এরপর ই আমার মাথা নস্ট। আমি সব সময় ভাবি ওরা টাকার খরচ হিসাব আমার থেকে অনেক ভালো রাখে এবং ওরা বোঝে। কারন আমার থেকে ওরা অনেক কস্ট করে টাকা ইনকাম করে। ওদের দেখেই আমি হিসাব করে দেখলাম হা ওরাই ঠিক করছে এখন, অথচ এই ওরাই কিন্তু এতদিন পুরোন পদ্ধতিতে ভুষি কুড়া খাইয়ে এসেছিল। ওদের এই পিলেট খাবার দেখেই একটা আর্টিকেল লিখলাম ফেসবুকে কিছুদিন আগে যেখানে সত্যি খাবার খরচ এবং ঝামেলা অনেক কমে যায়। পিলেট করে খাবার বানালে কেজি প্রতি খুব ভালো মানের খাবারের দাম আসবে পিক সময়ে সর্বচ্চ ২০ টাকা, আর অফ সিজনে ১৬ টাকা। কি করে ভালমানের পিলেট বানাবেন তা আমার ফেসবুকে বিস্তারিত লেখা আছে।
৩) আপনি কি কখনও ভেবেছেন কি করে খাবার খরচ আরো কমিয়ে আনা যায়?
খাবার খরচ বাড়া কমার পিছনে অবস্থানগত একটা বিষয় যেমন আছে, তেমনি নিজের জ্ঞ্যান, কলা কৌশলগত কিছু বিষয়ও প্রধান বিবেচ্য। কিছু বন্ধু আছে যাদের আশেপাশে গরুর খাবার সহজে পাওয়া যায়না, পিলেট বানানোর মেশিন নাই, বন্যায় পানি ওঠে যখন গরুকে শুধু দানা খাবার দিতে হয় ইত্যাদি কারনে খাবার খরচ অনেক বেশী হয়ে যায়। আপনি কি ভেবেছেন কিভাবে কি করলে এই খাবার খরচকে কমিয়ে আনা যায়? প্রতি নিয়ত আপনাকে এটা ভাবতে হবে এবং সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকেও মানিয়ে নিতে হবে। খাবার খরচ কমানোর জন্য সব থেকে জরুরী ঘাস চাষ করা। এটা যে কতটা জরুরী তা বলে প্রকাশ করা যাবেনা। ধরুন, আপনার হাতে কোন টাকা নাই, গরুর দুধ দেয়া ও বন্ধ। কোন খাবার কিনে খাওয়ানোর মত টাকা হাতে নেই আপনার। এই অবস্থায় কি করবেন!!!! শুধু ঘাস খাইয়ে আপনি গরুকে শুধু বাচিয়ে নয়, বড় করে ফেলতে পারবেন। এরপর হাতে টাকা আসলে আবার দানা খাবার কিনে খাওয়াবেন। কোন বাকীতে বা টাকা ধার করে আপনাকে চলতে হবে না। তো বুঝতেই পারছেন এটা কতটা জরুরী।
যাদের এলাকাতে বন্যা হয় বা বর্ষায় পানি ওঠে তারা এই কাচা ঘাস ১২ মাস খাওয়াতে পারেনা। লোকসানটা তখনই হয়। গরীবরা দুর থেকে কচুরিপানা ঘাস পাতা এনে খাওয়ায়, কিন্তু আমরা তা পারিনা। আমরা দোকান থেকে দানা খাবার বাকী আনি। কি ঠিক বললাম কিনা? এই অবস্থায় আপনি যদি বন্যা শুরু হবার আগে বা ঈদের আগে খাদ্যের দাম বেড়ে যাবার আগে যদি সাইলেজ করে রাখেন তাহলে সব একেবারে নিশ্চিন্ত। ১ কেজি সাইলেজ বানাতে ১ টাকাও খরচ হবেনা। যারা ঘাস করতে পারেনা, কিন্তু পুকুর আছে… আমি বলবো আপনি কচুরিপানা চাষ করেন। কি করে সাইলেজ করবেন তা আমার ফেসবুকে বিস্তারিত লেখা আছে।
৪) আপনি কি একবারো ও ভেবে দেখেছেন কি করে পুরো ফার্মের পরিচালন খরচ বা অপারেসন খরচ কমিয়ে ফেলা যায়?
২-৪ জন কর্মচারী ঘাস কাটা বা ছোট ছোট পিস পিস করার জন্য না রেখে যদি ঘাস কাটার মেশিন, ঘাস ছোট ছোট টুকরা করার মেশিন কিনে নেন আমার ধারনা যে কাজ আপনি ৪-৫ জনকে দিয়ে করাচ্ছেন তা ২ জনকে দিয়ে করানো যাবে। যারা এখনও লাকড়ী দিয়ে চুলা জালিয়ে ভুট্টা খুদ সিদ্ধ দিয়ে খাওয়ান তাদের বলবো পিলেট করে খাবার বানিয়ে খাওয়াতে, খরচ ঝামেলা অনেক কমে যাবে। এই ক্ষেত্রে যত বেশী আধুনিক যন্ত্রাতির সাথে পরিচিত হবেন খরচ তত কমে যাবে। গরুকে যদি ছেড়ে পালতে পারেন খরচ আরো কমে যাবে এবং গরু সুস্থ ও থাকবে আগের থেকে অনেক ভালো। ঢাকার আশেপাশে যারা ফার্ম করছেন এবং ঘাস করতে পারছেন না, আপনারা যদি ৩ মাস পর পর সাইলেজ করেন খরচ অনেক কমে যাবে।
৫) আপনি কি একবারো ভেবে দেখেছেন কি করে ফার্মের আয় আরো বাড়ানো যায়?
খরচ কমালে আয় এমনিতেই বাড়বে সেটা ঠিক কিন্তু কিছু কলাকৌশল আছে যেগুলো ফলো করে বর্তমান অবস্থানে থেকে আয় বাড়ানো যাবে। যারা ডেইরী করছেন তাদের বলবো আপনি বাছুরকে মিল্ক রিপ্লেসার দিন। প্রতি কেজি তরল মিল্ক রিপ্লেসার এর দাম পড়বে ৩০ টাকা, কিন্তু আপনি হয়তো প্রতি কেজি দুধ বিক্রি করছেন ৫০ টাকায়। তাহলে লাভ থাকছে ২০ টাকা কেজি প্রতি। গরুর গোবর ফেলে না দিয়ে চুলা জালাবার কাজে ব্যবহারের জন্য বিক্রি করতে পারেন। অনেকে গরুর গোবরকে ইউরিয়া খৈলের সাথে মিশিয়ে ৫-৬ দিন পরে মাছকে খাওয়ায়, বেশ ভালই মাছের খাদ্য হয়ে যায়। গোবর দিয়ে জৈব সার বানাতে পারেন। যার প্রতি কেজির দাম পড়বে ৮-১০ টাকা।
৬) দুধ এবং মাংসের বাজারজাত করন ভাল দামে কিভাবে নিশ্চিত করা যায় তা কি ভেবেছেন?
ফার্ম শুরু করার আগে দুধ বা মাংস কোথায় বিক্রি করবো বা কিভাবে বিক্রি করবো আমরা অনেকেই তা ভাবিনা। বাজারে বাজারে বোতলে করে রাস্তার পাশে দুধ বিক্রি করা কোন স্থায়ী সমাধান নয়। আপনাকে আমাকে স্থায়ী সমাধান খুজে বের করতে হবে। আমি বলবো ছোট ব্যবসায়ীদের, দাম ২ টাকা কম হলেও বাসায় বাসায় প্রতিদিন সাপ্লাই দিন। এরপর দেখুন আশেপাশের ডিপার্টমেন্ট স্টোর বা মিষ্টির দোকানে দেয়া যায় কিনা, তাও না হলে একটু দুরে শহরে নিয়ে যান। তাও না হলে নিজে মিস্টি ঘি ছানা তৈরী করুন। এগুলো আপনাকে স্থায়ী সমাধান দেবে। গরু মোটাতাজা করার জন্য দেখুন আপনার এরিয়াতে কি ধরনের গরুর চাহিদা বেশী। যদি ছোট গরু হয় তাহলে ছোট গরু ফ্যাটেনিং করেন ৩-৬ মেয়াদী, প্রতিগরু থেকে অল্প লাভ আসবে, কিন্তু আসবে। যত বিক্রি তত লাভ। শুধু কোরবানীর জন্য নির্ভরশীল না হওয়াই ভালো। কিছু রাখতে পারেন। তবে মাস জুড়ে বিক্রি করাটাই ভালো, ঝুকি কম।
৭) আপনি কি ভেবে দেখেছেন কাল ৩ জন শ্রমিক চলে গেলে ফার্ম চলবে কি করে?
খুব জটিল একটা বিষয়। প্রতিনিয়ত মালিকের দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অধিক বেতন, ধর্মঘট, কাজ না করার হুমকী, চাকরী ছেড়ে দেবার হুমকী আসতেই থাকে। এই ক্ষেত্রে আমি বলবো, যে ফার্মে মালিক নিজে কাজ করতে পারছেন না তারা একজন শিক্ষিত ছেলেকে বেশী বেতন দিন। এরপর অন্যদের বেতন কম দিয়ে এবং লেবার সংখ্যা বেশী রাখুন। তাদের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিন যেমন চিকিতসা, মাঝে মাঝে ভালো কিছু খাবার ব্যবস্থা করা, পরিবারের জন্য ঈদে জামা কাপড় দেয়া, বড় ফার্মে বোনাস দেয়া, প্রোভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি। যে এরিরিয়াতে ফার্ম সব লেবার সেই এরিয়ার না নিয়ে অন্য লোকেসন থেকেও নিতে হবে। যদি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর কর্মচারী পাওয়া যায় তাহলে আরো ভালো। ঈদে ছুটি ভাগাভাগি করে নিতে পারবে। আর যত বেশী আধুনিক যন্ত্রপাতির সাথে পরিচিত হবেন, শ্রমিক নির্ভরতা তত কমে যাবে।
সর্বশেষ আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা, বাছুর লালন পালন কলা কৌশল, ভাল উন্নতমানের বীজ, শ্রমিক মালিক সম্পর্ক, দক্ষ শ্রমিক এসব ও অনেক গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখতে হবে। আরো বিস্তারিত জানার জন্য যোগাযোগ করতে পারেনঃ স্বপ্ন ডেইরী এন্ড ফিশারিজ