নিতাই চন্দ্র রায়
আগে চৈত্র মাসে বৃষ্টির জন্য উন্মুক্ত মাঠে নামাজ পড়া হতো। হাজার হাজার মানুষ অংশ গ্রহণ করতেন সেই নামাজে। পল্লিগ্রামে এক সময় বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ারও প্রচলন ছিল। এ ধরনের ব্যাঙের বিয়ের বিবরণ পল্লিকবি জসিমউদ্দিনের নক্সী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থে পাওয়া যায় । গত ৬০ থেকে ৭০ বছরেও চৈত্র মাসে এমন ভারি বৃষ্টিপাত হতে কেউ দেখেনি। বিজ্ঞানীদের মতে,পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণেই অসময়ে হচ্ছে ধরনের ভারি বৃষ্টিপাত। বাড়ছে ঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা।ঘটছে সিডর এবং আইলার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাচ্ছে কৃষকের কষ্টের ফসল । চৈত্র মাসে একটু আধটু বৃষ্টি হবে। ঝড়-বাতাস হবে- এটাইত স্বাভাবিক। কিন্তু অতিবৃষ্টিতে পেঁয়াজ, মরিচ ,রসুন, আলু, মসুর, ধনে, শসা, করলা, বেগুন , ডাঁটা, করলা, চালকুমড়া, ঢ়েঁড়স, চিচিঙ্গা , বাঙ্গি ও তরমুজের মতো অর্থকরী ফসল বিনষ্ট হবে। হাজার হাজার হেক্টর জমির আধাপাকা রোরো ধান তলিয়ে যাবে- এটা এদেশের কৃষককূল স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। গত বছর এপ্রিল মাসে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে চলন বিল এলাকার অনেক কৃষক পরিপক্ক রসুন ঘরে তুলতে পারেন নি। ফলে সারা বছরই রসুনের দাম ছিল বেশি। ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজির রসুন বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কেজিতে। এবছর পেঁয়াজের জন্য প্রসিদ্ধ পাবনা জেলার সাঁথিয়া ও সুজানগর এলাকায় গত কয়েক দিনের অতিবৃষ্টির কারণে শত শত হেক্টর জমির পেঁয়াজ সম্পূর্ণ পচে নষ্ট হয়ে গেছে। বিনষ্ট পেঁয়াজ কৃষক বিক্রি করে ভ্যান ভাড়ার টাকাও তুলতে পারছেন না। সুজানগরের একজন কৃষক বাড়ি থেকে আধাপচা ৬ মন পেঁয়াজ হাটে এনে ১০০ টাকায় বিক্রি করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেন। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কোনাবাড়ি, গন্ডখোলা, সেনবাড়ি, বীররামপুর, চকরামপুর, রসুলপুরসহ বহু গ্রামের গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ওই সব শাক-সবজি বিক্রি করে কৃষক আসল টাকাও তুলতে পারবেন না।কৃষক আবাদ করে যদি আসল টাকাটাও ঘরে তুলতে না পারেন, তা হলে ফসল উৎপাদনে তাঁর আগ্রহ হ্রাস পাবে। পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। এজন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষদেরকে সরকারিভাবে সহায়তা করতে হবে। বিপদের সময়ে উপসহকারী কৃষিকর্মকর্তাদেরকে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাহস যোগাতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে আবার পরবর্তী ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় কৃষি ঋণ ও উপকরণ দিয়ে সহায়তা করতে হবে।যাতে কৃষক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষতি কাটিয়ে আবার মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেন। এ কারণে অনেক দেশে শস্য বীমার প্রচলন আছে। আমাদের দেশেও অবিলম্বে শস্য বীমার প্রচলন করতে হবে।
ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানীখোলা দক্ষিণ ভাটিপাড়া গ্রামের আবুল কালাম বেপারী, মোঃ আইয়ুব আলী, মোঃ হাসেন বেপারী, মোঃ আব্দুল হাই প্রত্যেকেই এক বিঘা করে সুতিয়া নদীর তীরে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বোরো ধানের চাষ করে ছিলেন। তাদের ধান ক্ষেত টানা ছয় দিন পানিতে ডুবে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ধান-ত দূরের কথা গরুকে খাওয়ানোর মতো এক মুঠু খড়ও বাড়িতে আনতে পারবেন না । আজ থেকে সাতদিন আগেও সুতিয়া নদীর দু’ধারে ছিল হাজার হাজার হেক্টর বোরো ধানের সবুজের সমারোহ। অধিকাংশ খেতের ধানের শীষ বের হয়ে ছিল।কৃষক ছিল সোনালী ধান কাটার স্বপ্নে বিভোর। অনেকে ধান কাটার জন্য কাস্তেও কিনে রেখে ছিল বাড়িতে।মাত্র ক’দিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে কৃষকের সব স্বপ্নের সমাধি রচিত হলো।সুতিয়া নদী ছাড়াও ময়মনসিংহ জেলার অনেক বিলের নিচু এলাকার ধানও পানিতে ঢুবে নষ্ট হয়ে গেছে।
অধিকাংশ কৃষক বাকিতে মহাজনের নিকট থেকে সার, বালাইনাশক কিনে বোরো ধানের আবাদ করেন এবং ধান কেটে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করেন। হাওড় ও বিল এলাকায় সারা বছরে মাত্র একটি ধানের চাষ হয়। বোরো ধানই তাঁদের বেঁচে থাকার ও সংসার চালানোর একমাত্র অবলম্বন । ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-সাদী, পড়া-শোনার খরচ, জামা-কাপড় ক্রয়, বাড়ি-ঘর মেরামত সব কিছুই করতে হয় বোরো ধানের টাকায়। কোনো কারণে বোরো ধান নষ্ট হলে হাওড়বাসীর কষ্টের সীমা থাকে না। তাঁরা হয়ে যান সর্বস্বান্ত।অনাহারে অর্ধাহারে কাটে দিন।
বাঁধ তৈরি ও সংস্কারের নামে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থের নয়চয় হলেও হাওড় রক্ষার বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয়না।এক শ্রেণির ঠিকাদার এবং পানিউন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের কর্তব্যকর্মে অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে প্রায় প্রতি বছরই বাঁধ ভেঙ্গে পাহাড়ি ঢলের অনুপ্রবেশের ফলে হাওড় এলাকার হাজার হাজার হেক্টর জমির পাকা , আধাপাকা বোরো ধান তলিয়ে যায়। অসহায় হাওড় বাসীর বুকফাটা আর্তনাদ ও চোখের লোনাজল মিশে যায় পাহাড়ি ঢলের পানিতে।অনেকের মতে এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সময় মতো বাঁধগুলির সংস্কার ও মেরমতি কাজ সম্পন্ন করা হলে হাওড়বাসীর এ সর্বনাশ হতোনা। দেশের উত্তর-পূর্বঞ্চলে অবস্থিত সাতটি জেলা জুড়ে বিস্তৃত হাওড় এলাকার মোট আয়তন ৫ হাজার বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ২কোটি। আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতিপুরণ ও হাওড় নির্মাণে দুর্নীতিগ্রস্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের শান্তির দাবিতে সম্প্রতি সিলেটে একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশ ও হাওড় উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এই মানব বন্ধনে বক্তরা বলেন, আগাম বন্যায় সিলেটের চার জেলার ৭৩ হাজার ৮৪৫ হেক্টর বোরো ও সবজির জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এর মধ্যে সুনামগঞ্জেই ৪৩ হাজার ৩১৫ হেক্টর বোরো ধানের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। আগাম বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতিপূণর দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে ছয় দফা দাবি জানানো হয় ওই মানববন্ধন থেকে। দাবিগুলি হলো- ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতি পূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন , দশ টাকা কেজি দরে চাল প্রদান, বিনা মূল্যে কৃষি উপকরণ প্রদান, ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যাংক ও এনজিও ঋণ মওকুফ, সহজ শর্তে কৃষি ঋণ প্রদান এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি। সুনামগঞ্জে একের পর এক হাওড়ে ফসল ডুবি ও ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদে সেখানেও আর একটি বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে ‘হাওড় বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ ।
অপর দিকে বৈরি আবহাওয়ার কারণে যশোর জেলায় প্রায় ১৩২ একর বোরো ধানের জমিতে ছত্রাক জনিত ব্লাষ্ট রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত ক্ষেতের ধানের শীষ শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। এতে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। যশোহর জেলার ব্লাস্ট আক্রান্ত উপজেলাগুলো হলো- কেশবপুর, যশোর সদর, শার্শা, ঝিকরগাছা, অভয়নগর, বাঘার পাড়া, মনিরামপুর এবং চৌগাছা।
এছাড়া এ বছর মার্চ মাসের ২য় সপ্তাহে অতিবৃষ্টির কারণে মুন্সিগঞ্জ, জয়পুরহাট , রংপুর ও দিনাজপুরে আলু ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় আলু উৎপাদনের শীর্ষ জেলা মুন্সিগঞ্জে। মুন্সিগঞ্জে এবার ৩৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছিল। ১০ হাজার হেক্টর আলু উত্তোলনের পরই এক নাগারে তিন থেকে চার দিনের ভারি বৃষ্টিতে আলু ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। কৃষক কষ্ট করে বৃষ্টি ভেজা আলু উঠালেও ওই আলু কতদিন সংরক্ষণ করা যাবে তা সঠিকভাবে বলা যাবেনা। হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা স¤ব¢ না হলে আগামী বছর বীজ আলুর সংকট দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে গত ১০ থেকে ১২ মার্চ এই তিন দিনের ভারি বৃষ্টিতে ভোলা, পটুয়াখালি, বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলার জমি প্লাবিত হয়। জমিতে পানি জমে থাকার কারণে বেশির ভাগ গাছ মারা যায়। তরমুজ পচে নষ্ট হয়ে যায়। অনেকে বৃষ্টির কারণে জমি থেকে পাকা তরমুজ তুলতে পারেননি। আবার কেউ কেউ বৃষ্টির আশঙ্কায় অপরিপক্ক তরমুজ তাড়াতাড়ি তুলে পানির দামে বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবে চলতি মৌসুমে সারা দেশে প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদের লক্ষমাত্রা ছিল । এর মধ্যে শুধু বরিশাল অঞ্চলে ৩৫ হাজার ২৯১ হেক্টর জমিতে এই রসালো ফলের আবাদ হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক অতি বৃষ্টিতে প্রায় অর্ধেক জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত চালের সিংহভাগ আসে বোরো মৌসুম থেকে।দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন বোরো চাল উৎপাদিত হয়। কোনো কারণে বোরো ধানের উৎপাদন কম হলে চালের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হুহু করে বেড়ে যায় দাম। সুযোগ নেয় মিল মালিকও চাল ব্যবসায়ীরা।ইতোমধ্যে চালের মূল্য বৃদ্ধির যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা দেশের স্বল্প আয়ের মানুষকে চিন্তিত করে তুলছে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি কষ্টের শিকার হয় অল্প আয়ের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। তাই বোরো ধানের ক্ষয়-ক্ষতি , সম্ভাব্য উৎপাদন, মজুদ ও ব্যবহার সংক্রান্ত সঠিক তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহ করে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে এখন থেকেই সংশ্লিষ্ট সকলকে তৎপর হতে হবে।এ ব্যাপারে কোনো প্রকার দায়িত্ব এড়ানো , অবহেলার বা শিথিলতার কোনো অবকাশ নেই।
—-
লেখকঃ কৃষিবিদ ও কলাম লেখক।
সাবেক মহাব্যবস্থাপক(কৃষি)
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ
ৃ