কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
মাল্টার চাষাবাদ
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ মাল্টা একটি সুস্বাদু ফল। স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। তাই আমাদের দেশে মাল্টা অন্যতম জনপ্রিয় ফল। কিন্তু চাহিদার পুরোটাই আমদানী নির্ভর। তবে দেশের দুই জেলা চাঁপাইনাবগঞ্জ ও নরসিংদী থেকে এসেছে মাল্টা আবাদের সুখবর।
মাটি ও আবহাওয়ার কারণে সুস্বাদু ও রসালো আমের জন্য চাঁপাইনাবগঞ্জের খ্যাতি প্রাচীন কাল থেকেই। অধিক আবাদ ও উৎপাদনের জন্য আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত দেশের উত্তর জনপদের চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার মাল্টার বিপ্লব ঘটেছে। পরীক্ষামূলক আবাদেই বাম্পার ফলন এ অঞ্চলে মাল্টার আবাদ নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে। পুষ্টি চাহিদার পাশাপাশি অর্থনীতিতেও দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। ২০১৩ সালে আবাদ, ২০১৬ সালেই সফলতা। এমন ফলাফলের প্রেক্ষিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে আবাদের সম্প্রসারণ দেখে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, একদিন দেশের ফল রপ্তানীতেও যুক্ত হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাল্টা।
যেভাবে শুরু: প্রায় ১০ বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের চাঁপাইনবাবগঞ্জ-আমনুরা সড়কের পাশে জামতলা এলাকায় ১০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা, আম, কুল, বেদানা আবাদ শুরু করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়ক ও যোগাযোগ বিভাগের গাড়ি চালক মতিউর রহমান। বরেন্দ্র অঞ্চলের রুক্ষ মাটিতে পেয়ারা, আম, কুল, বেদানা রকমারি ফল আবাদের মাঝে কয়েক বছর আগে তিনি লাগিয়েছিলেন স্থানীয় জাতের বেশ কিছু মাল্টার চারা। পেয়ার গাছে পেয়ার হয়, বেদানা গাছে বেদানা কিন্তু স্থানীয় জাতের ওই মাল্টা গাছে ফলন আসেনা। দেড় বছরের মাথায় ওই গাছ থেকে ফল এলেও তা সন্তোষজনক ছিল না। ধরা ফলগুলোর পাকার পর স্বাদ গ্রহণে দেখা যায় সেগুলো পানসে। তখন মাল্টা চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন মতিউর। কিন্ত মাল্টা আবাদের সুপ্ত বাসনা থেকে যায় মনের ভেতরেই। এরই মাঝে যোগাযোগ ঘটে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বছর তিনেক আগে হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মকর্তারা মাল্টা চাষে উৎসাহ যোগাতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ‘বারি মাল্টা-১’ চাষের প্রস্তাব দিলে মতিউরের মনে জেগে উঠে সেই সুপ্ত বাসনা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের (এসসিডিপি)’র আওতায় ২ শ চারা এনে রোপন করেন ২ বিঘা জমিতে। ‘একদিন সুস্বাদু মাল্টা হবেই’ এমন বাসনা নিয়ে শুরু হয় রোপন করা মাল্টার চারার সেবা যতœ। স্ত্রীসহ দু’সন্তানকে নিয়ে নিবিরভাবে বাগান পরিচর্যায় মাত্র দুই বছরের মাথায় সাফল্য ধরা দেয় মতিউরের হাতে। মতিউরের বাগানজুড়ে এখন থোকায় থোকায় মাল্টা।
মতিউরের কথা: চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের মল্লিকপুর খলসি গ্রামের জš§ নেওয়া মতিউর রহমান কাজ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের গাড়ি চালক হিসেবে। বিনয়ী ও উদ্যোমী মানুষ মতিউর রহমান সড়ক ও জনপথ বিভাগে ৩০ বছরের চাকরী জীবনে নিজকে পরিচিত করেছেন একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবেও। শহরের রেহায়চরস্থ কর্মস্থলে শ্রমিক কর্মচারীদের প্রিয়ভাজন মতিউর বহু বছর ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদককের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করছেন ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও। উদ্যোমী মতিউরের গাছের প্রতি টান ছিল তার ছোটবেলা থেকেই। খলসী গ্রামের পৈত্রিক বসত বাড়ির গলিতে আর বাড়ির পেছনের বাগানে গাছ লাগাতেন বিশেষ করে ফলের গাছ লাগাতেন শৈশব থেকেই। সেই গাছের প্রতিটান থেকে গড়ে তোলেন ফলের বাগান। স্বীকৃতি স্বরূপ জেলা পর্যায়ের পুরস্কার লাভের পাশাপাশি এবছর ‘বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার’ পেয়েছেন মতিউর রহমান।
মতিউর রহমান বলেন, ‘ আমাদের গ্রামের বাড়িটা পুরোটাই আম বাগানের ভেতরে। শিশুকাল থেকেই আমার মাঝে জš§ নেয় গাছের প্রতি ভালবাসা। আম বাগানের ভেতরে ভেতরে গাছ লাগাতাম। বিশেষ করে ফলের গাছ লাগানো প্রতি ঝোঁক ছিল সেই শৈশব থেকেই। বড় হয়ে সেই ঝোঁক থেকেই গড়ে তুলি ফলের বাগান’। তিনি বলেন, ‘ বাগান করার প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও ফলের বাগানের প্রতি মনের টানের কারণে দেশের যে কোন স্থানে যাওয়ার সুযোগে হলে সেসব যায়গার বাগানগুলো, নার্সারিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতাম। এ থেকে মনের বহু বছরের ইচ্ছে বাস্তবায়নের সুযোগ খুজতাম। অবশেষে স্ত্রী নাসিমা রহমানের সহযোগিতায় বরেন্দ্র অঞ্চলের আমনুরার জামতলা এলাকায় ১০ বিঘা অন্যের জমি লিজ নিয়ে শুরু করি মনামিনা নার্সারি। বাহারী ফলের সমাহার ঘটানোর লক্ষেই ওই বাগানটি করা। মাল্টা, পেয়ারা, আম, বেদানা, বরইসহ নানান ধরণের ফলের গাছ রয়েছে আমার বাগানে’।
বরেন্দ্রের লাল, শক্ত ও রুক্ষ মাটিতে মাল্টা আবাদের ‘ঝুঁকি’ নিলেন কেন এমন প্রশ্নের জবাবে মতিউর বলেন, ‘ পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে এবং সিলেটের মাল্টা বাগানে দেখেছি সেসব বাগানের মাটিগুলোয় কুচি পাথর বা মোটা বালি থাকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতেও আঁখড়ির মত মাটির শক্ত শক্ত দানা আছে। তখনই ভেবেছিলাম বরেন্দ্রের মাটিতেও মাল্টা আবাদ সম্ভব। নিজে নিজেই মনামিনায় লাগিয়েও ছিলাম স্থানীয় জাতের কিছু মাল্টা গাছ। তবে স্বাদ ভাল না পাওয়ায় আশাহত হয়েছিলাম। অবশেষে হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মকর্তাদের পরামর্শে বারি মাল্টা-১ লাগিয়ে দারুন সাফল্য পেয়েছি। ২০১৩ সালে বারি মাল্টা-১ লাগানোর পর ২০১৫ সালে গাছ প্রতি ফলন পাওয়া গেছিল ২৫-৩০টি করে। আর এবছর একটি গাছে সর্বোচ্চ মাল্টা ধরেছে ২১৯টি। গোটা বাগানে গাছপ্রতি গড়ে মাল্টা ধরেছে ৮০টিরও বেশি করে। এখন আমার মাল্টার বাগানও হাসছে। হাসছি আমি, আমার পরিবারও’।
সাফল্য ও সম্প্রসারণ: মতিউরের ফল বাগানে মাল্টার ফলন দেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় মাল্টা আবাদের হিড়িক পড়েছে। মতিউরের দুই বিঘার মধ্যদিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্রভুমিতে যে মাল্টার যাত্রা শুরু তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় দেড় শ বিঘা জমিতে। ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষকসহ নানা শ্রেণীর পেশার মানুষ গড়ে তুলছেন নতুন নতুন বাগান।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বাচ্চু নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের টকটইক্যা এলাকায় ৩২ বিঘা জমিতে মাল্টার চাষ করেছেন। ওই একই এলাকায় তিনি ৬০ বিঘা জমিতে মাল্টার বাগান গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার নতুনহাটের মাসুদ রানা সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের পাওয়েল এলাকায় চার বিঘা জমিতে মাল্টার বাগান করেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার শাহীবাগ গ্রামের প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মার্কেটপাড়ায় চার বিঘা জমিতে মাল্টার বাগান গড়ে তুলেছেন। রামকৃষ্টপুর মাঝপাড়ার শামীম আহম্মেদ মাল্টা বাগান করেছে আমনুরা ধীনগর এলাকায় ৪ বিঘা জমিতে। মতিউর রহমান জানান, মোনামিনা নার্সারীর মাতৃগাছ থেকে এবছর ২৫ হাজার নতুন চারা তৈরী করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৫ হাজার চারা বিক্রি হয়ে গেছে। তৈরী হয়েছে আরো ১০ হাজার চারা। বরেন্দ্র অঞ্চলে গড়ে উঠা বাগানগুলোর বাইরে সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাল্টা চারা গেছে মতিউরের নার্সারি থেকে।
এদিকে, মাল্টা আবাদে ব্যাপক চাহিদার মূখে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারেও প্রায় ১০ হাজার মাল্টা চারা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
দর্শনীয় বাগান দেখতে ফলপ্রেমীদের ভিড়: চাঁপাইনবাবগঞ্জ-আমনুরা আঞ্চলিক সড়কের কোলঘেসেই গড়ে উঠা মোনামিনা নার্সারিতে এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয় ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি। আমাদানী করা এক ধরণে এই কাগজের ব্যাগ পরানোর ফলে মাল্টা গুলো ধারণ করেছে আকর্ষণীয় হলুদ রং। সবুজ পাতার বুকে হলুদ মাল্টা এক অভাবনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। দৃষ্টিনন্দন মতিউরের বাগান দেখতে এসেছেন উচ্চ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাসহ নানান শ্রেণী পেশার মানুষ। প্রতিদিনই যাচ্ছেন ফলপ্রেমীরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার মিস্ত্রিপাড়ার বাসিন্দা জহুরুল ইসলাম মাখন বলেন, ‘ মতিউরের ফলের বাগানের কথা অনেক শুনেছি। আজ পরিবার পরিজন নিয়ে মাল্টা বাগান পরখ করলাম স্বাদও গ্রহণ করলাম। এককথায় দারুন’। মতিউরের স্ত্রী নাসিমা রহমান বলেন, ‘ স্বামী, সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে অনেক কষ্টে এই বাগান গড়া। এখন মানুষজন বাগান দেখতে আসছে, মাল্টা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তাই খুব ভাল লাগছে। আরো ভাল লাগছে আমাদের দেখে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন নতুন বাগান করছে’।
মাল্টা আবাদ পদ্ধতি: চাঁপাইনবাবগঞ্জ কল্যাণপুর হার্টিকালচার সেন্টারের এসসিডিপি প্রকল্পের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘সারা দিন রোদ পড়ে এবং বৃষ্টির পানি জমে না এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি মাল্টা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচিত জমিটি কয়েকবার চাষ ও মই দিয়ে সমান করে নিতে হবে। জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করে আশপাশে উঁচু গাছ থাকলে কেটে ফেলতে হবে। সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা ষড়ভূজি পদ্ধতিতে চারা রোপণ করতে হবে। সাধারণত মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য ভাদ্র (মে-আগস্ট) মাসের মধ্যে মাল্টার চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে পানির সেচ নিশ্চিত করা গেলে চারা বছরের যেকোনো সময় লাগানো যায়।
চারা রোপণের জন্য গর্তের আকার ৭৫ সেন্টিমিটার বাই ৭৫ সেন্টিমিটার হবে। একটি চারা থেকে অন্যটির দূরত্ব হবে চার মিটার। তবে তিন মিটার দূরত্বেও চারা লাগানো যেতে পারে। গর্তের মধ্যে ১৫ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার দিয়ে তিন থেকে পাঁচ কেজি ছাই, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি সার ও ২৫০ গ্রাম চুন ওপরের মাটির সঙ্গে মেশাতে হবে। গর্তগুলো ১৫-২০ দিন ভরাট করে রেখে তারপর চারা লাগাতে হবে।
বাণিজ্যিক সম্ভাবনা:কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে শীতকালে লেবুজাতীয় দেশী ফল তেমন থাকেনা। তাছাড়া লেবুজাতীয় ফলের সিংহভাগই আমাদের আমদানী করতে হয়। এতে করে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা ব্যয় হয়। এক্ষেত্রে বারী মাল্টা-১ লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। মাল্টা চাষে কারিগরি সহায়তা প্রদানকারী চাঁপাইনবাবগঞ্জ কল্যাণপুর হার্টিকালচার সেন্টারের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে সাধারণত ধান ছাড়া অন্য কিছু হয়না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের আওতায় চাষ করা মাল্টা বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে সুন্দরভাবে খাপ খায়িছে। ফলনও ভাল হয়েছে’।
মনামিনা নার্সারীর মতিউর রহমান জানান, তার বাগানে গতবছর গাছ প্রতি গড় ফলন এসেছিল ২৫টি করে। এবছর সেখানে পাওয়া গেছে গাছ প্রতি ৮০টিরও বেশী করে। সেহিসেবে দু’ বিঘার মাল্টা থেকেই আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা। আর উৎপাদিত চারা থেকে আয় হয়েছে ৫ লাখেরও বেশী টাকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, ‘ বরেন্দ্র অঞ্চলের উৎপাদিত মাল্টা আমদানী করা মাল্টার চেয়েও ভাল। ইতোমধ্যে পরীক্ষা করে করে দেখা গেছে বাজারে আমদানী করা মাল্টায় যেখানে মিষ্টতার পরিমাণ পাওয়া গেছে ৯ শতাংশ সেখানে বারি মাল্টা-১ এর মিষ্টতা পাওয়া গেছে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ’। তিনি বলেন, ‘ বরেন্দ্র অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে মাল্টা আবাদে যে সাফল্য পাওয়া গেছে তাতে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন বাগান গড়ে উঠছে। এতে করে মাল্টা আমদানীর নির্ভরতা কমবে। পুষ্টি চাহিদাও পুরণ হবে’। মাল্টা চাষে মানুষের উৎসাহ ও আগ্রহ দেখে তিনি মন্তব্য করে বলেন, ‘ চাঁপাইনবাবগঞ্জকে মানুষ আমের জেলা হিসেবে চিনে থাকেন। যে হারে এখানে মাল্টার চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে। তাতে হয়তো ৫/৭ বছর পর মানুষ চাঁপাইনবাবগঞ্জকে চিনবে মাল্টার রাজ্য হিসেবে।
নরসিংদীর শিবপুরে মাল্টা চাষে সম্ভাবনার বার্তা
এদিকে মাল্টা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন নরসিংদীর শিবপুরের কৃষকরাও। লটকন আর লেবুর জন্য খ্যাত শিবপুরের কৃষকরা ঝুকছে মাল্টা চাষে। আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুন ভালো হওয়ায় ফলনও হয়েছে বেশ। এতে আশাবাদী হয়ে উঠেছে কৃষকরা। তারা জানায়, আমদানী যোগ্য এই ফল চাষ প্রসারে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া হলে অল্পদিনের ব্যাবধানে দেশের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ২০০৩ সালে বারি মাল্টা উদ্ভাবন করেন। এর বীজ বারি মাল্টা-১ নামে জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদন লাভ করেছে। বারি মাল্টা-১ ফলের গায়ে পয়সার মতো ছাপ থাকে। তাই স্থানীয়রা একে পয়সা মাল্টা বলে। উচ্চ ফলনশীল ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এ ফল দেখতে আকর্ষনীয় সবুজ এবং খেতে সুস্বাদু। জানুয়ারী থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে গাছে ফুল আসে এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে ফল আহরণের উপযোগী হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিবপুরের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র ২০১১ সালে বারি মাল্টা-১ জাতের পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করে। প্রায় আড়াই বছর নিবির পরিচর্যা ও গবেষনার পর গবেষকরা সফলতা পায়। গবেষকরা পাহাড়ী এলাকা হিসেবে পরিচিত শিবপুর অঞ্চলে উষ্ণ জলবায়ু, মাটি অম্ল ও ক্ষারীয় হওয়ায় মাল্টা চাষে অফার সম্ভাবনা তুলে ধরেন।
এরই প্রেক্ষিতে মাল্টা চাষ সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয় শিবপুর উপজেলা প্রশাসন। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে সিলেট জেলার জৈন্তাপুরের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র থেকে সংগৃহিত বারি মাল্টা-১ জাতের প্রায় ১৫ হাজার মাল্টা গাছের চারা বিতরণ করা হয়। উপজেলার ৩০০ বাগানের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে এক হাজার মানুষকে এসব চারা দেওয়া হয়। এতে সহযোগীতা করেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ। প্রায় দুই বছর নিবির পরিচর্যার পর সাফল্য পেয়েছে কৃষক। গাছগুলোতে থোকা থোকা মাল্টা দেখে চাষিদের মুখে ফুটেছে হাসি। আকারে বড় ও খেতে সুস্বাধু হওয়ায় মাল্টা চাষে গর্বিত করে তুলেছে তাদের।
সম্প্রতি শিবপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সবজি, লেবু ও লটকনের বাগানের পাশাপাশি নতুন করে কৃষকরা ঝুকছে মাল্টা চাষে। উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই কৃষকরা মাল্টা চাষ করেছে। অধিকাংশ বাগানেই গিয়ে দেখা যায়, গাছে ফল নেই। এর কারণ জানতে চাইলে কৃষকরা জানায়, কৃষি বিভাগের পরামর্শে গাছ থেকে ফল ফেলে দেয়া হয়েছে। এতে গাছ বড় ও পরিপূর্ণ হবে। আগামী বছর থেকে গাছগুলো থেকে মাল্টা সংগ্রহ করা হবে।
তবে উপজেলার ইটাখোলা মুনসেফেরচরের জাহাঙ্গীর আলমের মাল্টা বাগানে গিয়ে অভিভূত না হওয়ার উপায় নেই। বাগানটি এই উপজেলায় মাল্টা চাষের ভবিষ্যত সম্ভাবনার টেলার। ছোট ছোট গাছে ঝুলছে থোকা থোকা মাল্টা। মাল্টা ফলে ঢেকে গেছে সারি সারি গাছের পাতা। সঙ্গে লাগানো কমলাগাছেও ফল ধরেছে।
বাগানে দেখাতে দেখাতে কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উপজেলা পরিষদের দেয়া চারায় আমি এক বিঘা জমিতে মাল্টা বাগান করেছি। মাল্টার ফলন এমন হবে, এটা ভাবতেও পারিনি। প্রতিটি গাছে ১৫০ থেকে ২০০টি পর্যন্ত ফল ধরেছে। সামনে আশা করি আরও ভাল ফলন হবে।
তিনি জানান, মাল্টা চাষে তেমন খবর নেই। কীটনাশক, খুটি ও শ্রমিকের খরচ বাবদ প্রায় ৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। বাগানের ফলনে আমার আশা ৪ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবো। আগামীতে ফলনের সঙ্গে সঙ্গে লাভও বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস।
একই উপজেলার আইয়ুবপুর ইউনিয়নের গোড়ারগাঁও গ্রামের মাল্টা চাষী আফজালুল হক বলেন, শিবপুরের মাল্টার স্বাদ ও গন্ধ বাজারের সাধারণ মাল্টার চেয়ে ভাল। এতে আমরা আশাবাদী এই এলাকার সবজি, লেবু ও লটকনের পাশাপাশি মাল্টাও দেশের মানুষের মন জয় করবে।
শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম মৃধা বলেন, আমাদের দেশের মাল্টার চাহিদার পুরোটাই বিদেশী আমদানী নির্ভর। একই সঙ্গে মাল্টাকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে ফরমালিনের মতো ক্ষতিকারণ পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। অপরদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মাল্টা বাগানের ফলন ভাল খেতেও সুস্বাধু। তাই আমরা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মাল্টা চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেই। ইতিমধ্যে মাল্টার ফললে কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। এতে মাল্টা চাষের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন শিবপুরের কৃষকরা। চলতি বছরে আরও ২০ হাজার মাল্টা ও ৫ হাজার কমলা গাছের চারা বিতরণের পরিকল্পনার কথা জানান উপজেলা চেয়ারম্যান।
উপজেলা পরিষদের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে মাল্টা, কমলা ও লেবুর মিশ্র বাগানের প্রদশর্নী করেছে। প্রথম বছরের ফলনে উজ্জীবিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক লতাফত হোসেন বলেন, মাল্টার চাষে যে রকম সাড়া পড়েছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই তা হয়তো লটকন আর কলম্বো লেবুকে ছাড়িয়ে যাবে। মাল্টা চাষ নরসিংদীতে একটি বিল্পব আনবে। এবং তা সারা দেশে সাড়া জাগাবে। বাণিজ্যিকভাবে মাল্টা চাষ হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি কৃষকরা লাভবান হবেন। মাল্টা চাষ সম্প্রসারণে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।
লেখক:মফস্বল সম্পাদক, কালের কণ্ঠ
বসুন্ধরা, বারিধারা, ঢাকা।