কৃষিবিদ নূরুল হুদা আল মামুন, ঝালকাঠী থেকে ফিরেঃ স্মরণাতীত কাল থেকে ধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল । কৃষির কথা বলতে গেলে চোখের সামনে সবার আগে ভেসে ওঠে সোনালী ধান ক্ষেতের ছবি। আজ দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পুর্নতা অর্জনের পেছনে ধানের অবদান সিংহভাগ। কিন্তু ধান উৎপাদনের সাথে জড়িত চাষীরা ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে আজ নিদারুন কষ্ট আর অসহায় দিনযাপন করছে । যেন দেখার কেউ নাই,শোনার কেউ নাই।
দৃশ্যপট-১ঃ পটুয়াখালী জেলার দুমকী উপজেলার ধান চাষী আনোয়ার হোসেনের সাথে কথা হয় গত ১০ এপ্রিল । তিনি জানান, ধানের দাম নেই একেবারেই। আমন ধানের দাম ৩৫০/- টাকা থেকে ৪০০/- টাকা প্রতিমন। আমন মৌসুমে যে ধান পেয়েছেন তা এখন তার কাছে বিরাট বোঝা মনে হচ্ছে। তিনি প্রতি বছর অন্যের জমি নগদ টাকায় লিজ নিয়ে চাষাবাদ করেন।একদিকে ধান বিক্রি না করলে,টাকা আসবে না আবার টাকা না পেলে নতুন করে জমি লিজ নিতে পারছেন না । এই দামে ধান বিক্রি করলে মজুরি খরচ পর্যন্ত তুলতে পারছেন না। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এভাবে চলতে থাকলে সামনের মৌসুমে ধান আবাদ করবেন কিনা ভাবতে হবে, বলে জানান।
দৃশ্যপট-২ঃ কথা হয় ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠী গ্রামের চাষী আব্দুস সাত্তারের সাথে। তিনি জানান, ‘মোগো এলাকায় ধানই অইল মেইন ফসল। হেই ধানের দাম নাই। পাইকাররা আগে যে গরজ (আগ্রহ) করে ধান কিনতো এখন আর কিনতে চায় না। মন প্রতি আমন ধানের দাম ৪৩০/- টাকা কি বড় জোর ৪৪০/- টাকা । একটা বদলা (মজুরি) খরচ ৪৫০/- টাকা। ধান চাষে খরচার টাকাটা উঠেনা।’ একটু থেমে আবার ক্ষোভের সাথে বলেন,’ আগামিতে খাওনের জন্য যা লাগে হেইটু (সেই টুকু) জমি চাষ ক্রুম। নাইলে খামু কি? আর পোলাপানেরে খুলনা মিলে কাম করনের জন্য পাঠামু।আর কৃষি করুম না।’
দৃশ্যপট-৩ঃ কথা হয় ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠী গ্রামের আলী আহম্মদ তালুকদারের সাথে। তিনি জানান, আগে জমি চাষ করাতাম, কাজের লোক ছিল। এখন ঝামেলা আর খরচ বেড়ে যাওয়ায় জমি – জমা বর্গা দেই বা নগদ টাকায় জমি অন্যের কাছে লিজ দেই। কিন্তু এবার ধানের একেবারেই দাম নেই তাই বর্গাদার জমি বর্গা নিতে চান না। আর নগদ টাকায় যারা লিজ নিয়ে জমি চাষ করত, তারা ধানের দাম পায় না বলে ধান বিক্রি করতে পারছে না । এ কারণে লিজ ওলারাও জমি লিজ নিতে চায় না। মনে হচ্ছে এবার অনেকের জমি খিল (অনাবাদি) থাকবে।’ এটা কোন খন্ড চিত্র নয় বরং এটা সারা দেশের ধানের হাল চিত্র।
বরিশাল : ধানের দেশ বরিশালে এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলনে কৃষকের মুখে হাসি থাকলেও হতাশায় বিলীন হচ্ছে সে হাসি। ধান বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় পড়ছেন। মাঠ তৈরি করা থেকে শুরু করে ধান মাড়াই পর্যন্ত খরচ বাদ দিলে বোরো মৌসুমে লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা একেবারে কম বলে জানিয়েছেন কৃষক। ফলে তারা হতাশায় ভুগছেন। সরকার প্রকৃত অবস্থা বিবেচনা করে ধানের নতুন দাম নির্ধারণ না করলে আগামীতে ধান রোপণে কৃষক নিরুৎসাহিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নোয়াখালী : চলতি বোরো মৌসুমে ধান বিক্রি করে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন এখানকার চাষিরা। বাজারে দেখা গেছে, কৃষক বোরো, বিআর-৪০সহ বিভিন্ন জাতের প্রতি মণ ধান বিক্রি করছেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। অথচ একজন কৃষিশ্রমিককে দৈনিক মজুরি দিতে হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। এক মণ ধান বিক্রি করে একজন শ্রমিক পাওয়া যায় না। অনেক কৃষক মহাজনের ঋণের বোঝা নিয়ে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। খাদ্য বিভাগের সরকারি মূল্যে এক মণ ধান ৮৮০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও খাদ্য বিভাগ ধান কিনছে না।
কুমিল্লা : ধান চাষ করে কৃষক বিপাকে পড়েছেন কুমিল্লার চাষিরা। লাকসাম উপজেলার কৃষক সোনা মিয়া জানান, প্রতি কানি (১২০ শতক) জমি চাষ করতে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। প্রতি কানিতে ধান পেয়েছেন ২০ মণ। ৫০০ টাকা হিসেবে ২০ মণের দাম ১০ হাজার টাকা। এবার ব্রি-২৮ ধানে রোগ হওয়ায় ফসল কম হয়েছে। অন্যদিকে বাজারেও ধানের ধান কম। একজন ধান কাটার শ্রমিকের মূল্য ৪৫০ টাকা। তারপর তার দুই বেলা ভাত ও এক বেলা নাস্তার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ১ কানি জমিতে যে ধান পাচ্ছেন, তার অর্ধেক ধান কাটা শ্রমিকের পেছনে চলে যাচ্ছে।
বগুড়া : বগুড়ার হাটবাজারে উঠতে শুরু করেছে বোরোর নতুন ধান। তবে দাম না থাকায় বোরো চাষিরা ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছেন। বগুড়ার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ থেকে ৫২০ টাকায়। কৃষক বলছেন, এ দামে ধান বিক্রি করলে আবাদের খরচই উঠবে না।
শেরপুর : ধানের জেলা নামে পরিচিত শেরপুর। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ধান কাটা। কৃষি বিভাগ মনে করে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ধান উৎপাদন হবে। তবে জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলনেও দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক। পাকুরিয়ার কৃষক কালু মিয়া জানান, জমির ব্যবহারমূল্য ছাড়াই এক মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ৭০০ টাকার ওপরে আর বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫২০ টাকায়।
নওগাঁ : জেলায় ধানের বাম্পার ফলন হলেও দাম কমে যাওয়ায় হতাশ কৃষকরা। পত্নীতলা উপজেলার মনজুর এলাহী জানান, ‘এবার প্রতি বিঘা জমির ভাড়াসহ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘায় শুধু ধান উৎপাদনে খরচ পড়েছে মণপ্রতি ৭৫০ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে ধানের মূল্য ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। যদি ধানের মূল্য বৃদ্ধি করা না হয় তাহলে ধান বিক্রি করে কৃষক লাভের পরিবর্তে লোকসানে পড়বেন।’
কিশোরগঞ্জ : ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় কিশোরগঞ্জের কৃষক চরম বিপদে পড়েছেন। এলাকায় কোনো ক্রেতা নেই। ফড়িয়া-বেপারিরা অসহায় কৃষকের কাছ থেকে বর্তমানে প্রতি মণ ধান ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে খরিদ করছেন। কিন্তু উৎপাদন খরচ আরও অনেক বেশি।
দিনাজপুর : উত্তরাঞ্চলরের শস্যভাণ্ডার দিনাজপুরে আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। আমন ধান কাটা, মাড়াই শেষে প্রতি মণ ধান ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন বলে জানালেন জেলার কৃষকরা। দিনাজপুরে চাষি নজ্রুল জানান, প্রতি বিঘা জমি আবাদ করতে সার-বীজ, কীটনাশক এবং বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণসহ অন্যান্য খরচ পড়ে ৭ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি জমির মালিককে দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। সর্বমোট খরচ পড়ে ১৩ হাজার টাকা। জমিতে ধানের ফলন হয়েছে ২০ মণ। ৫০০ টাকা মণ দরে বিঘাপ্রতি ধানের মূল্য ১০ হাজার টাকা। খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। তাহলে কৃষক চলবে কীভাবে?
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম