নিতাই চন্দ্র রায়
এখন আষাঢ় মাস। সারা দেশে চলছে আমন ধানের বীজতলা তৈরির কাজ। কৃষককূল ও সরকার যখন ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আসন্ন আমন মৌসুমে ফলন বাড়ানোর নানা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ব্যস্ত, ঠিক তখন এক শ্রেণির অতিলোভী বীজ ডিলার ও ব্যবসায়ী বাজারে আমন বীজের কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে সরকার নির্ধারিত দামের দ্বিগুণ মূল্যে আমন ধানের বীজ বিক্রি করে সাধারণ কৃষকদের প্রতারিত করছেন।বিএডিসির আমন ধানের ১০ কেজি ওজনের প্রতি প্যাকেট ভিত্তি বীজের সরকার নির্ধারিত মূল্য ৪০০ টাকা এবং প্রত্যায়িত ও মানঘোষিত বীজের দাম যথাক্রমে ৩৫০ ও ৩৪০ টাকা।অথচ বিএডিসির সেই ভিত্তি, প্রত্যায়িত ও মানঘোষিত বীজ স্থান, ব্যবসায়ী ও ডিলার ভেদে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা । এভাবে প্রতি কেজি বীজে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন ২৫ টাকা। অর্থাৎ ১০ কেজি ওজনের প্রতি প্যাকেট বীজ থেকে ব্যবসায়ীরা কমিশন বাদে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।দেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে নিয়োগকৃত বিএডিসির হাজার হাজার ডিলার উত্তোলনকৃত আমন ধানের বীজ ন্যায্য মূল্যে কৃষকদের নিকট বিক্রি না করে কালো বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন অথবা নিজেরাই কৃষকদের নিকট দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন।এভাবে আমন বীজ থেকে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা করছেন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা।
বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নরসিংদী জেলার মনোহরদীতে আমন মৌসুমে ধান বীজের কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে প্রকাশ্যে দ্বিগুণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ডিলাররা।কৃষকরা হাটে-বাজারে সরকার অনুমোদিত বিএডিসির ডিলারদের দোকানেদোকানে ঘুরে সরকার নির্ধারিত দামে বীজ পাচ্ছেন না। ডিলাররা এসব বীজ কালো বজারে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন।ফলে বীজের অভাবে চাষাবাদ ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশংকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। কৃষকদের কথা মনোহরদী উপজেলার শেখের বাজার, চালাকচর বাজার বীরগঞ্জ বাজারের বিভিন্ন বীজ ভাণ্ডারের মালিকগণ ধান বীজ গোদামে মজুদ রেখে কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে দ্বিগুণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।ওই একই এলাকার কচিকাটা গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ শেখের বাজারের এক ডিলারের নিকট থেকে ১০ কেজি ওজনের ২ প্যাকেট ব্রিধান৪৯ জাতের বীজ ১ হাজার ২০০ টাকায় ক্রয় করেন,অথচ যার সরকার নির্ধারিত মূল্য হলো৬৮০ টাকা। ডিলাররা সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি না করার কারণে কৃষক অতিরিক্ত দামে বীজ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। জানা যায় চলতি মৌসুমে মনোহরদী উপজেলায় আমন ধানের চাষ হবে ৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এ জন্য ১৮ জন ডিলারের মাধ্যমে ব্রিধান ৩০, ব্রিধান ১২, ব্রিধান ৪৯, ব্রিধান ৫১, ব্রিধান ৩০, ব্রিধান ২২, বিআর ১১ও বিণা ৭ জাতের প্রায় ৭৭ মেট্রিকটন বীজ বরাদ্দ দেওয়া হয়।কিন্তু কোনো ডিলারই সরকার নির্ধারিত দামে বীজ বিক্রি করছেন না। ফলে অনেক কৃষক হতাশ হয়ে খোলা বাজার থেকে নিম্নমানের বীজ কিনে বীজতলা স্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।ফলে আমন মৌসুমে ফলন বৃদ্ধির সম্ভাবনা শূণ্যেই মিলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সম্প্রতি নেত্রকোনার কমলাকান্দা সদরে আমন ধানের বীজ কালো বাজারে বিক্রির দায়ে বীজ ব্যবসায়ী মোঃ মানিক মিয়াকে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিএডিসির আমন বীজ অবৈধভাবে মজুদ করে সরকারি মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রির অভিযোগে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মোঃ হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে আদালত অভিযুক্ত মানিককে গ্রেফতারসহ তার দোকান থেকে ৪৫ বস্তা ব্রিধান ৩২ জাতের আমন বীজ জব্দ করে।একইসঙ্গে আদালত ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে একমাস সশ্রম করাদণ্ড প্রদান করেছেন। কৃষক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান কথিত মানিকের দোকান থেকে সরকার নির্ধারিত ৩৪০ টাকা মূল্যের আমন ধানের বীজ ৬০০ টাকা দামে ক্রয় করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট লিখিত অভিযোগ করেন এবং উক্ত অভিযোগের ভিত্তিতেই ভাম্যমাণ আদালত অনুষ্ঠিত হয়। শুধু কমলাকান্দা ও মনোহরদী উপজেলাতেই নয়; হাওড় অঞ্চলের কয়েকটি উপজেলা বাদে সারা দেশেই আমনধানের বীজ নিয়ে চলছে এরকম রমরমা ব্যবসা।ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর , রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, জয়পুরহাট , পাবনা ও নাটোরসহ সারা দেশেই নির্ধারিত দামের দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে আমন ধানের বীজ।এব্যাপারে উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান হচ্ছেনা। গত বছরও ১০ কেজি ওজনের প্রতি প্যাকেট আমন ধানের বীজ এ সময়ে বিক্রি হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। তখন ধানের দাম কম থাকায় বীজের চাহিদাও কমছিল এবং এসিআই, অটোক্রপ কেয়ার, ব্র্যাক, ইয়েন, ম্যাগডোনাল্ড প্রভৃতি কোম্পানীর ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বিক্রি হয়েছে নির্ধারিত দামে।আর এবছর আমন ধানের বীজ নিয়ে চলছে সারা দেশে এক তুগলকী কাণ্ড। মযমনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার জয়দা গ্রামের রফিকুল ইসলাম নামের একজন কৃষক তাঁর ৪০ শতক জমিতে আমন ধান রোপণের জন্য ব্রিধান৪৫ জাতের বীজ খুঁজছেন।তার কাছে ১০ কেজি ওজনের এক প্যাকেট বীজের দাম চাওয়া হচ্ছে সাড়ে ছয়শত টাকা।তিনি গত আমন মৌসুমে নিজের ব্যবহারের জন্য বাড়িতে ধানের বীজ সংগ্রহ করে রাখতে পারেননি।একই উপজেলার কাঁঠাল ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া পাড়া গ্রামের দেবেন সরকার দু’দিন আগে ৬৩০ টাকা দিয়ে বিএডিসির ব্রিধান৪৯ জাতের ১০ কেজি বীজ সংগ্রহ করেন।কৃষকের অভিযোগ, সরকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসির ডিলার ছাড়াও এসিআই, অটোক্রপ কেয়ার, ইয়েনসহ বিভিন্ন বেসরকারী কোম্পানীর ডিরারগণ আমন বীজের কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে কোম্পানীর নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বীজ বিক্রি করে অসহায় কৃষকদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।ফলন বৃদ্ধির জন্য ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ২২ জন ডিলারের মাধ্যমে আনুমানিক শতাধিক টন আমন ধানের বীজ বরাদ্দ দেয় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন।যতদূর জানা যায়, কোনো ডিলারই সরকার নির্ধারিত দামে আমন ধানের বীজ কৃষকদের মধ্যে বিক্রি করেননি।
এ বছর অতিবৃষ্টি ও, পাহাড়ী ঢল ও ব্লাষ্ট রোগের কারণে বোরো ধানের উৎপাদন অনেক কম হয়েছে এবং সম্প্রতি মাত্রতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে কৃষকের খরিপ মৌসুমে রোপণকৃত সবজি ও মসলা ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও তাঁদেরকে যদি আমন ধানের বীজ সংগ্রহ করতে গিয়ে এভাবে হয়রানীর শিকার হতে হয়, দ্বিগুণ মূল্য দিতে হয়, তাহলে আমাদের খাদ্য যোগানদাতা কৃষক কোথায় দাঁড়াবেন?আর কেনই বা তাঁরা ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমন ধানের চাষ করে প্রতারণা ও বিড়াম্বনার শিকার হবেন ? কৃষক ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলকে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় এর জন্য সমগ্র জাতিকে বিরাট মাশুল দিতে হবে ।