মো. মোশারফ হোসেন, নকলা (শেরপুর) প্রতিনিধি:
কৃষিতে নারীর অংশ গ্রহন : শেরপুরের নকলা উপজেলায় কৃষিকাজে নারীদের অংশ গ্রহন দিন দিন বাড়ছে। পুরুষের পাশাপাশি ফসলের মাঠেও নারী সমাজ পুরোদমে কাজ করছেন। উৎপাদন খরচ কমাতে, ফসল বোনা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত সব ধরনের কাজেই নারীদের অংশ গ্রহন চোখে পড়ার মত। এতে ওইসব পরিবার গুলোতেও ফিরে আসছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। পাশাপাশি নিজ শ্রমের বিনিময়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীনরা, বিশেষ করে নকলার প্রান্তিক পরিবারের নারীরা এক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে রয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকেই।
নকলা উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, উপজেলার ১৭ হাজার ৪৮৯ হেক্টর জমির মধ্যে ১৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে। এই সাড়েচৌদ্দ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদনে ৩২ সহ¯্রাধিক পরিবার জড়িত। এসব পরিবারের পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি নারীদের অংশ গ্রহন চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের চর এলাকা ও উত্তর এলাকার নারীদের কৃষিতে অংশ গ্রহন প্রসংশনীয়। তবে নারীরা বেতনসহ বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন বলে সরজমিনে দেখা গেছে। এবিষয়ে নারী শ্রমিক মালেকা, ছখিনা, ফুলভানু, আরজিনাসহ বেশ কিছু নারী শ্রমিক আলাকিত বাংলাদেশকে জানান, তারা অনেকক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করলেও শ্রম মজুরী পুরুষের অর্ধেক পেয়ে থাকেন। তাই কাজের ভিত্তিতে তাদের শ্রম মজুরী নির্ধারণের জন্য দাবী জানান তারা। নারী শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল আলু চাষী শফিক, সাজু, রাজু, ছাইদুল, জুয়েলসহ অনেকেই জানান, নারীদের দিয়ে কাজ করানো সহজ এবং কম টাকায় অধিক শ্রম পাওয়া যায়। তবে তাদের বিষয়ে কিছু সমস্যার কথা বলেন তারা, যেমন- পুরুষরা যেসব ভারী কাজ করতে পারেন, নারীদের পক্ষে তা অসম্ভব, তাই নারীদের মজুরী স্বাভাবিক কারনেই কম থাকে। ভারী কাজ করার ক্ষেত্রে অপারগতার অজুহাতে সারা বছর নারীদের সব ধরনের কাজেই শ্রম মজুরী কম থাকে। ফলে নারীরা কাজ বেশি করলেও বেতন কম পেয়ে থাকেন। তবে এই মজুরী তথা বেতন বৈষম্য দূর করা উচিত বলে স্বীকার করেন নারী শ্রম ক্রেতা সব কৃষকরাই।
উপজেলায় সারা বছরই ধান, গম, ভুট্টা ছাড়াও সব ধরনের শাক সবজি ও ফল উৎপাদন হয়। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়ে থাকে। আর এসব ফসল পরিচর্যা, সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষনে নারীরা সার্বক্ষনিক শ্রম দিয়ে আসছেন। এতে কৃষি অর্থনীতি হচ্ছে সমৃদ্ধ।
কৃষি ক্ষেত্রে নারীদের অবদানের বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস জানান, নারীরা পুরুষের তুলনায় ৩ গুন বেশি কাজ করে থাকেন। অন্যদিকে যে সব নারীরা অবৈতনিক ভাবে কৃষিখাতে ও পারিবারিক শ্রমে জড়িত তাদের সিংহভাগই মজুরি নিয়ে অন্যের জমিতে কাজ করতে আগ্রহি নয়। যার পেছনে প্রধান কারণগুলো হল পারিবারিক অসম্মতি, কাজের অবমূল্যায়ন ও মজুরি বৈষম্য। তিনি আরও বলেন, এটাও ঠিক যে- পারিবারিক কাজের ফাঁকে একজন নারীর পক্ষে সারাদিন বাড়ির বাইরে থেকে অন্যের জমিতে শ্রম দেয়া কঠিন হয়ে পরে। তাই নারী শ্রমিকরা কৃষি কাজে জড়িত থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা বেতন বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন। তবে এই বৈষম্য থাকা উচিত নয় বলে তিনি মনে করেন। কারন হিসেবে তিনি বলেন, নারীরা সামান্য কিছু সময় অন্যের জমিতে কাজ করতে না পারলেও কিন্তু তারা বসে নেই। সন্তান দেখভাল করাটাও দেশ ও জাতীর মঙ্গলের জন্যই।
প্রাচীন যুগে যেখানে নারীর হাতে বোনা বীজ দিয়ে চাষাবাদের প্রচলন হয়েছে, মানুষ পশুপালন সভ্যতা থেকে কৃষি সভ্যতার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, সেখানে কৃষিক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কতটুকু তা সহজেই অনুমেয়। গ্রাম বাংলার নারীদের কাছেও অনেক কাজের মধ্যে কৃষিই গুরুত্বপূর্ণ। বীজ সংরক্ষন ও বপন থেকে শুরু করে, চারা রোপণ, সেচ, ফসল উত্তলন এমনকি বিপণনেও নারীরা এককভাবে ভূমিকা পালন করে থাকেন নারীরা।
আইএলও শ্রমশক্তি জরীপ ২০১৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট এক কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে ৭৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৯২ লাখ নারীই কৃষিকাজ, মৎস্যচাষ ও সামাজিক বনায়নের সাথে জড়িত। বিবিএস’র তথ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কৃষিখাতে এ বিপুল জনগোষ্ঠীর দেওয়া শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা আজও সম্ভব হচ্ছেনা। যেসব নারীরা দিনমজুর হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করেন, তারা প্রতিনিয়তই মজুরী বৈষম্যের শিকার হন, সেই সাথে রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে তাদেরকে কাজে নিয়জিত রাখা এবং অন্যান্য মানসিক নিপীড়নের স্বীকারও হন বলে জানা যায়। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৩৪৫ ধারা অনুযায়ী, নারী-পুরুষের সমকাজে সমান মজুরি প্রদানের কথা থাকলেও, চারা রোপণ ও ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে পুরুষদের দৈনিক মজুরি যেখানে মৌসুম বেধে ৪০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা, সেখানে নারীরা পায় মাত্র ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মতো। কাজেই, আপাতদৃষ্টিতে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পেছনে নারীর ক্ষমতায়নের কথা মনে হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে স্বল্প মজুরি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করানোর সুবিধা, এমনটাই মনে করছেন সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।
আর যারা নিজ জমিতে শ্রম দেয়, তাদের চাষাবাদের কাজে নিযুক্ত হবার বিষয়টি বর্তমান সভ্য সমাজেও নারীদের প্রাত্যহিক কাজের অংশ হিসেবেই ধরা হয়, মজুরী বা স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি সেখানে নিতান্তই ব্যর্থ। বাংলাদেশ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-তে নারীর সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রণীত ২২ টি লক্ষ্যের মধ্যে নবম লক্ষ্যটি হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা, কিন্তু এদেশের কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের কোন বৈধ পরিচিতি নেই। পাঠ্যপুস্তকে কিষাণ-কিষাণী শব্দের ব্যবহার থাকলেও, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বা বাস্তবে ‘কিষাণী’ শব্দটির কোন ব্যবহার নেই বললেই চলে।
২০১৬ সালের সিএসআরএল এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষি খাতের ২১ ধরনের কাজের মধ্যে ১৭ ধরনের কাজেই গ্রামীণ নারীরা অংশগ্রহন করার কথা বলা হয়েছে। অথচ কৃষি তথ্য সার্ভিস এর ‘কৃষিতে নারী’ শীর্ষক প্রতিবেদনে কৃষি জমির মালিকানায় নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ১৯ ভাগ। সিপিডি’র গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী- নারীরা পুরুষের তুলনায় ৩ গুন বেশি কাজ করে থাকেন। অন্যদিকে যে সব নারীরা অবৈতনিক ভাবে কৃষিখাতে ও পারিবারিক শ্রমে জড়িত তাদের সিংহভাগই মজুরি নিয়ে অন্যের জমিতে কাজ করতে আগ্রহি নয়। যার পেছনে প্রধান কারণগুলো হল পারিবারিক অসম্মতি, কাজের অবমূল্যায়ন ও মজুরি বৈষম্য। এটাও ঠিক যে, একজন নারীর পক্ষে সারাদিন বাড়ির বাইরে থেকে অন্যের জমিতে শ্রম দেয়া কঠিন হয়ে পরে। যার ফলশ্রুতিতে নারীরা না পায় গৃহস্থালীর কাজের মর্যাদা, না পায় কৃষিখাতে প্রদেয় শ্রমিকের কাজের মর্যাদা।
নারীদের শ্রম মূলত গ্রামীণ কৃষি-অর্থনীতিতে পরিবারের আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়না, বরং ফসল উৎপাদনে সামগ্রিক ব্যয় হ্রাসের উৎস হিসেবে তা পরিগনিত হয়। কৃষি তথা দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নারীদের কাজের মূল্যায়ন তাদেরকে শুধুমাত্র নারী হিসেবে বিবেচনা করে নয়, মূল্যায়ন করা উচিৎ তাদের সামগ্রিক দক্ষতাকে বিবেচনায় এনে। এটা শুধুমাত্র কৃষি খাতেই নয়, সব খাতেই এটি বিবেচনা করা উচিত।
যদিও বর্তমানে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের মাঠে দেখা যাচ্ছে বেশি। এতে করে নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছেন বলে মনে করছেন সর্বশ্রেণির জনগন। কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহন বাড়লে সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি। তাই অনেকের ধারনা কৃষিকাজে নারীদের অংশ গ্রহনের পরিমাণ বা সংখ্যা আরো বাড়ানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত।