Site icon

নাইট্রোজেন সার মাটির স্বাস্থ্যহানীর কারণঃ গবেষণার ফলাফল

N Researchকৃষিবিদ মোঃ নূরুল হুদা আল মামুনঃ

সফল ভাবে ফসল উৎপাদন এবং ফলন বৃদ্ধির জন্য সারের ব্যবহার অত্যাবশক । নতুবা ফলন মারাত্বক ভাবে কমে যাবে । এ তথ্য এখন আর নতুন করে বলা বাহুল্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। গাছের বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য প্রায় ১৭টি পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন হয়। এসব পুষ্টি উপাদান গুলোর মধ্যে ৯টি পুষ্টি উপাদান গাছ বেশী গ্রহণ করে। যে সব পুষ্টি উপদান গাছ বেশী গ্রহণ করে তার মধ্যে নাইট্রোজেন অন্যতম। মাটিতে এই পুষ্টি উপাদানের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। আর এ প্রেক্ষাপটে রাসায়নিক সার হিসেবে নাইট্রোজেন সার যেমন- ইউরিয়া সারের ব্যবহারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কৃত্রিম নাইট্রোজেনাস সার যে মাটির জন্য ক্ষতিকর কারণ এমন দুঃসংবাদের কথা জানান আমেরিকার বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গবেষনায় দেখেছেন যে, কৃত্রিম ইউরিয়া জাতীয় নাইট্রোজেনাস সার মাটির কার্বন ধ্বংস করে ফলে সহজেই মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়।
গত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করে আসছেন যে, কৃত্রিম নাইট্রোজেন পরিবেশের জন্য ভাল কাজ করে এবং মাটির কার্বন গঠন করে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এবং অধিক গ্রীনহাউজ গ্যাস নিসরনের প্রেক্ষাপটে খামার জমি গুলো অধিক কার্বন শুষে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কেননা খামারে ব্যাপকহারে রাসায়নিক নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করা হয় । অধিকন্তু কার্বন সমৃদ্ধ মাটির পুষ্টির সংরক্ষনাগার এবং অধিককাল পর্যন্ত মাটির উর্ববরতা মান বজায় রাখতে পারে। যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আর্শিবাদ স্বরূপ। কৃত্রিম নাইট্রোজেন পরিবেশেকে স্থিতিশীল করে। জলাবদ্ধ খামার জমিতে কৃত্রিম নাইট্রোজেনের উপস্থিতিতে গাছের বৃদ্ধি বেশি ও দ্রুত হয়। গাছের বৃদ্ধি পর্যায়ে বাতাস থেকে র্কাবন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে । এছাড়া ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটিতে মিশে যায় এবং এ মাটি থেকে গাছ র্কাবন গ্রহণ করে।

নতুন গবেষনাঃ প্রচলিত এই ধারনা বা যুক্তির বিরুদ্ধে প্রচন্ড চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন আমেরিকার বিখ্যাত University of  Illinois এর একদল গবেষক যারা হলেন : রিচার্ড মালভেনী , সাঈদ খান এবং টিম এলসার্থী। সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক গবেষনা প্রবন্ধে তাঁরা বিষ্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেন যে, কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার মাটির জৈব পদার্থ কমিয়ে দেয়। কেননা নাইট্রোজেনাস সার যেমন ইউরিয়া সার মাটির অনুজীবকে উদ্দীপিত করে এবং তৃপ্তি সহকারে মাটির জৈব পদার্থ বিশ্লেষিত করে উপভোগ করে।
তাঁদের গবেষণায় আরো উঠে আসে যে, মাটিতে কৃত্রিম নাইট্রোজেন এর ব্যবহারে এক ধরনের চাকতি তৈরী করে যা জৈব পদার্থের অপচয়কারী হিসেবে কাজ করে এবং মাটির জৈব নাইট্রোজেন সংরক্ষনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে জমি থেকে ব্যাপক হারে নাইট্রোজেন চুয়ে (leaching loss) চলে যায়। নাইট্রেড আকারে ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে । অপর দিকে বায়ুমন্ডলে (N2O) নাইট্রাস অক্সাইড হিসেবে মিশে যায়। এই নাইট্রাস অক্সাইড গ্রীনহাউজ গ্যাস হিসেবে কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ৩০০ গুন বেশী তাপ উৎপাদন করে। অন্যদিকে কৃত্রিম নাইট্রোজেনের কারণে জৈব নাইট্রোজেনের এ সংরক্ষণ ক্ষমতা হ্রাস পায় ।
গবেষকরা আরো জানান , মাটিতে জৈব পদার্থ অপচয়ের কারণে মাটি আরো (Compact)   নিবিড় হয়ে পড়ে । মাটিতে রন্ধতা কমে যায় , মাটিতে গাছের মূলের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান গড়িয়ে বা চুয়ে অপসারিত হয়। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ফলে জমিতে সেচ বেশি দিতে হয়। গবেষনা দলের প্রধান প্রফেসর রিচার্ড মালভেনী আরো জানান ’কৃত্রিম নাইটে্রুাজেন সার ব্যবহারে প্রতিনিয়ত মাটির রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।’
পুরাতন ধারণা নতুনের জন্ম দেয় ঃ গবেষনা দলটি জানান যে, তারা মূলত কোন নতুন ধারনার জন্ম দেননি। প্রকৃত পক্ষে এ বিষয়ে বিশের দশক ও ত্রিশের দশকের ধারণার ভিত্তিতে তাদের এ গবেষণা পরিচালিত হয় । মালভেনী বলেন , কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার মাটির কার্বন ও জৈব নাইট্রোজেনের অপচয় বৃদ্ধি করে এই ধারনা সম্পর্কে বৃটিশ কৃষিতত্ত্ববিদ স্যার এলবার্ট হওর্য়াড তাঁর ঞযব ঝড়রষ ধহফ ঐবধষঃয (১৯৪৭) বইয়ে এ সর্ম্পকে প্রথম উল্লেখ করেন। তিনি বলেন কৃত্রিম সার বিশেষ করে কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার মাটির অবর্ননীয় ক্ষতি সাধন করে। নাইট্রোেিজনের উপস্থিতিতে ছত্রাক এবং অন্যান্য অনুজীবকে উদ্দীপিত করে ফলে তাদের উপভোগের জন্য জৈব পদার্থ সন্ধান করে। তাদের শক্তি সঞ্চয় ও জৈবিক ক্রিয়াকলাপের জন্য প্রথমে মাটির সংরক্ষিত হিউমাস উপভোগ করে। পরে মাটির সিমেন্টিং এজেন্ট হিসেবে পরিচিত জৈব পদার্থ বিয়োজিত করে। ফলে মাটির জৈব পদার্থ কমিয়ে দেয় । আর কোন মাটির জৈব পদার্থ হলো ঐ মাটির জীবনী শক্তি। এভাবে মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়। বিজ্ঞানী স্যার আলবার্টের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই ধারণা অব্যাহত আছে।
গবেষনায় যা পাওয়া যায় ঃ আমেরিকার ইলিনোয়েস বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রাচীন পরীক্ষা মাঠে (Morrow Research Plot) গবেষকরা প্রথমত ঃ শুধুমাত্র ভুট্টা ফসল, দ্বিতীয়ত ঃ ভুট্টা- সয়াবিন এবং তৃতীয়তঃ ভুট্টা -যব -খড় এই ৩টি শস্য বিন্যাসের মাধ্যমে গবেষণা করেন। কতিপয় প্লটে সারবিহীন,কতিপয় প্লটে মধ্যম মাত্রার রাসায়নিক সার আর অবশিষ্ট প্লট গুলোতে উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। এসব ফসলের প্লট থেকে শুধূমাত্র ভূট্টার মোচা সংগ্রহ করা হয়। ফসলের অবশিষ্টাংশ ঐসব প্লটে মিশেয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় মাটিতে যথেষ্ট পরিমান ফসলের অবশিষ্টাংশ পুঞ্জিভূত হওয়া সত্ত্বেও কার্বন এর পরিমাণ ঐ হারে বাড়েনি বরং কমতে থাকে। অন্যকথায়, যে হারে মাটিতে উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ জমা করা হয় তার চেয়ে বেশি হারে কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার জমির জৈব পদার্থ বিয়োজিত করে ফেলে।
প্রসঙ্গত: আমেরিকার ইলিনোয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত Morrow Research Plot টি সবচে পুরাতন গবেষণা মাঠ হিসেবে সর্র্বাধিক পরিচিত । রির্পোট অনুযায়ী দেখা যায় ১৯০৪ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই গবেষণা মাঠের মাটির জৈব কার্বন সম্পর্কিত গ্রাফ বা তথ্য থেকে জানা যায়, যে পর্যন্ত এই গবেষনা মাঠে জৈব সার ব্যবহার করা হত সে সময় পর্যন্ত এখানকার মাটিতে জৈব কার্বন কয়েক দশক পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের পর থেকে কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার জমিতে ব্যবহার শুরু হয় তখন থেকে জমির জৈব কার্বনের পরিমান কমতে থাকে ।
গবেষকরা আরো জানান যে, মাটিতে যে পরিমান কৃত্রিম নাইট্রোজেন প্রয়োগ করা হয় তাতে প্রচলিত ধারণা মতে মনে করা হয়েছিল যে, মাটিতে নাইট্রোজেন গঠন করবে। প্রকৃতপক্ষে গবেষকরা ঠিক তার উল্টো ঘটনা দেখতে পান অর্থাৎ মাটিতে নাইট্রোজেন কমে গেছে। এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন যে, মাটিতে জৈব পদার্থ অপচয়ের কারনে মাটির নাইট্রোজেন ধারন ক্ষমতা শূন্য করে ফেলে।

প্রতিক্রিয়াঃ প্রফেসর মালভেনীকে তাঁর গবেষক দলের গবেষনা সম্পর্কে অন্যান্য ব্যক্তি বা সংস্থার প্রতিক্রিয়া সর্ম্পকে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন :” আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, সার কারখানা গুলো আমাদের কাজ সম্পর্কে সচেতন আছে এবং তারা এতে সন্তুষ্ট নয়। কোম্পানী গুলো মূলত বিক্রি নির্ভর, আর আমাদের কাজ অবশ্যই বিক্রি বান্ধব নয়।”মৃত্তিকা বিজ্ঞান সম্প্রদায় থেকে এখনো মিশ্র প্রতিক্রিয়া আসছে। প্রাথমিকভাবে সয়েল সায়েন্স সোসাইটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এ পর্যন্ত দুটি প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
প্রথমতঃ জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল কোয়ালিটি এর সম্পাদকীয়তে ড.কিথ রিড বলেন, কৃত্রিম নাইট্রোজেন এবং মৃত্তিকা কার্বন সম্পর্কে প্রফেসর মালভেনী ও তাঁর গবেষক দলের প্রাপ্ত তত্ত্ব যদি সত্য হয় তবে এটা চাঞ্চল্যকর এবং অবিশ্বাস্য রকম গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মাটিতে জৈব কার্বনের ঘাটতি সম্পর্কে একমত হলেও শুধূমাত্র কৃত্রিম নাইট্রোজেন এ জন্য দায়ী, এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার মতে, আধুনিক ফসল ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে মাটি থেকে যে পরিমাণ জৈব কার্বন অপচয় হয়, সেই হারে মাটিতে উচ্চ নাইট্রোজেন প্রয়োগ করেও তা আশানুরূপ নাইট্রোজেন ঘাটতি প্রশমিত করতে পারেনা।
দ্বিতীয়ত ঃ অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের Rothamsted Research Station এর মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক Dr. S. Powlson বলেন: ’মাটির উপরিস্তরের কার্বন ও নাইট্রোজেন কমে যাওয়ার ঘটনা চমকপ্রদ এবং পুনঃ বিবেচনার দাবীদার।’
পরিশেষে, ইলিনোয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনা দল যে প্রমানপত্র দিয়েছেন তা গত ৫০বছরের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণার থেকে বিপরিত। যদি এই গবেষনা তত্ত্ব সঠিক হয়, তবে মাটিতে কৃত্রিম নাইট্রোজেন সারের ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থার জন্য বিরাট হুমকির কারণ। তবে তাদের গবেষনা ও বিশ্লেষন জৈব কৃষিকে আরো উৎসাহিত করবে। যা মাটির দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ও উর্বরতা মান বজায় রাখতে আবশ্যই প্রয়োজন । অপরদিকে আমাদের আবাদী জমির স্বাস্থ্য বা উর্বরতা মান বজায় রাখতে কৃত্রিম নাইট্রেজেন সার বা ইউরিযা সারের প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানী, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট।

তথ্য সূত্রঃ ইন্টারনেট

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Exit mobile version