জেনে নিন নারিকেল গাছে মাইটের আক্রমণ ও তার দমন ব্যবস্থা

নারিকেল গাছে মাইটের আক্রমণ

Coconut Miteএম এনামুল হক
মহাপরিচালক (অবঃ), ডিএই

মাইটের আক্রমণে নারিকেল গাছের ক্ষতি সম্বন্ধে আগে অজানা ছিল। এ মাইটের উপস্থিতি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬৫ সালে মেস্কিকোতে। এর পর পরই এ মাইটের উপস্থিতি ব্রাজিলে ও আইভোরী কোষ্টে দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে ভারতের কেরালাতে এ মাইটের আক্রমণ লক্ষ করা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় ভারতে এ মাইটকে নারিকেলের জন্য অপ্রধান ক্ষতিকারক পেষ্ট হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পরে ভারতে ১৯৯৯ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষ ভাগে কেরালায় এ মাইট মনিটরিং এর জন্য বিস্তারিত সার্ভের আয়োজন করা হয়। তাদের এ সার্ভের ফলা ফলে দেখা যায়, তদাঞ্চলে প্রায় ৫৮৯ লক্ষ ফলন্ত নারিকেল গাছ এ মাইট দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এ আক্রমণের প্রতিকূল প্রভাবে এ সব নারিকেলের ফলন প্রায় ৪২% কম হতে দেখা যায়। তখন থেকেই ভারতে এ নারিকেল মাইটকে প্রধান ক্ষতিকারক পেষ্ট হিসাবে চিহ্নিত করে সরকারীভাবে তা দমন ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। একই গুরুত্ব বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ মাইট সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা ব্যবস্থা নিয়ে এ দেশে এ মাইটের উপস্থিতি ও তার দমন ব্যবস্থা সর্ম্পকিত বিস্তারিত সুপারিশ মালা নারিকেল চাষীদের বৃহত্তর স্বার্থে প্রণয়ন করতে পারে ।

নারিকেলের মাইট চিহ্নিতকরণ ঃ নারিকেল মাইট ‘ইরিওফিড’ নামে পরিচিত, যা অন্য মাইট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ মাইটের আকারে খুবই ছোট। খালী চোখে তা দেখা সম্ভব নয়। প্রায় ১০-১৫ গুণ পাওয়ার বিশিষ্ট ম্যাগনিফায়িং
গ্লাস দিয়ে তা দেখা সহজ হয়। একটা নারিকেল মাইট লম্বায় প্রায় ২০০-২৫০ মাইক্রোন এবং চওড়ায় প্রায় ২০-৩০ মাইক্রোন হয়। সাধারণ মাইটের ৪ জোড়া বা ৮ টা পা থাকে। অথচ নারিকেলের ক্ষতিকারক এ মাইটের পায়ের সংখ্যা মাত্র ৪ টা। পুরুষ মাইটের তুলনায় স্ত্রী মাইট আকারে কিছুটা বড়। মাইটের জীবন চক্র শেষ হতে সময় লাগে মাত্র ১০-১২ দিন। শীত মৌসুমে এ চক্র শেষ হতে কিছু বেশী সময় লাগে, এ সময় চক্র শেষ হয় প্রায় ১৫-২১ দিনে। ডিম ফুটে ৩-৪ দিন পর ‘লারভা’ বের হয় পরে তা রূপান্তরিত হয়ে ‘নিমফ’ আকার ধারন করে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই তা পুর্ণাঙ্গ মাইট রূপ ধারন করে।
কেকোনাট মাইট অপবৎরধ মঁবৎৎবৎড়হরং

নারিকেল মাইটের তৎপরতা ও ক্ষতি ঃ ফুল ফল ধরার জন্য নারিকেলের যে কাঁদি বের হয় এবং তাতে ক্ষুদ্র কচি নারিকেল গাঁথা/ধরার সংগে সংগে মাইট তার বোটার অংশের উপরিভাগে যে ক্যাপ বা খোলস থাকে তার নিচের অতি নরম অংশে অবস্থান নেয়। এখানে অবস্থান কালে একটা স্ত্রী মাইট প্রতিদিন ৫-১০টা ডিম দেয়। ডিম দেয়া আরম্ভ করলে একেক দফায় শতাধিক ডিম পাড়ে। বছর শেষ হওয়ার আগে ১০-১৫ বার এ ভাবে একটা স্ত্রী মাইট ডিম দেয়া অব্যাহত রাখে। কয়েক মাসের ব্যবধানে সেখানে শতশত মাইটের কলোনী তৈরী হয়। এখান থেকে নূতন গজানো কচি ডাবে মাইট ছড়িয়ে পড়ে। অতি কচি ডাবের বোঁটার নিকট খোলের নীচের অংশের টিস্যু খুব নরম থাকে। তাই অবাধে এ অংশ ক্ষত করে মাইট ভিতরের রস চুষে খায়। কচি ফল ধরার পর থেকে তা নারিকেল হতে সময় লাগে প্রায় বার মাস। কচি ফল গাঁথা থেকে শুরু করে প্রথম ৬ মাস তখনও ফল বা ডাব কচি ও ছোট অবস্থায় থাকে, যার নরম টিস্যুর রস আহার করা ও বংশ বিস্তার করা মাইটসের জন্য অতি সহজ হয়।

ডাব ও নারিকেলে মাইটের উপস্থিতির লক্ষন ও ধরণ ঃ নারিকেলে বা ডাবের গায়ে গাঢ় বাদামী ছোবড়া ছোবড়া দাগ দেখা গেলে বুঝতে হবে তা মাইটের আক্রমনের লক্ষণ। আক্রমণের মাত্রা অত্যাধিক হলে কচি অবস্থায় মাটিতে অপূর্ণ ডাব ঝরে
পড়ে। যেগুলো টিকে যায় সেগুলোও আকারে ছোট ও অনাকাঙ্খিত আকার (ডিফরম) ধারন করে। মাইটের আক্রমণে ডাব ও নারিকেলের স্বাভাবিক রং থাকে না, বেশী গাঢ় হয়ে বির্বণ হয়ে যায়। ভিতরের শাঁস (কারনেল) গঠন খুব কম হয় (৩০% ক্ষতি), নারিকেলের ছোবড়ার গুণাগুণ নষ্ট হয়ে তা শিল্পকারখানায় ব্যবহার অনুপোযোগী হয়।

মাইটের বিস্তার ঃ
 একই গাছের বা পার্শ্ববর্তী গাছ থেকে মাইট বাতাসের মাধ্যমে বা মৌমাছি বোলতা বা মধু আহোরনকারী পাখির মাধ্যমে অন্য গাছে বা অপর বাগানে ছড়াতে পারে।
 এছাড়াও প্রবল বাতাসের মাধ্যমে অথবা নারিকেল/ডাব বা নারিকেল চারার মাধ্যমে এক দেশে থেকে অন্য দেশে এ মাইট ছড়িয়ে পড়ে।

নিয়ন্ত্রণ/দমন ব্যবস্থা ঃ
যেহেতু মাইট বোঁটার অংশে খোলের নীচে অবস্থান করে এবং নরম টিস্যুর রস খেয়ে বংশ বিস্তার করে তাই এ নিরাপদ স্থানে অবস্থানরত মাইট দমন খুব সহজ নয়। তবে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাইটের আক্রমণ প্রতিহত করা সহজ। এগুলোর বিবরণী নিম্ম্রুপ ঃ
১। বাগান স্বাস্থ্য সম্মত রাখা ঃ (ক) নারিকেল বাগান বা গাছ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার। এ লক্ষ অর্জনে গাছের নীচে মাইট দ্বারা আক্রান্ত ঝরে পড়ে থাকা অপুষ্ট ডাবগুলো কুড়িয়ে পুড়িয়ে ফেলা উচিত।
২। গাছে সময় মত,পরিমিত প্রয়োজনীয় খাদ্য/সার প্রয়োগ করা হলে ও প্রয়োজনীয় সেচ নিকাশ ব্যবস্থায় নারিকেল গাছের ও ফলের বৃদ্ধি বেশী হয়। তাতে মাইটের আক্রমণ হলেও ক্ষতির মাত্রা খুব কম হয়।

৩। প্রাকৃতিক (বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল) ভাবে দমন ঃ
(ক) প্রিডেসিয়াম নামক এক ধরনের রাক্ষুসে বা পরজীব ভোজী মাইট নারিকেল মাইট খেতে পছন্দ করে। নারিকেল মাইট কলোনিতে এ পরভোজী মাইটের উপস্থিতিতে নারিকেল মাইটের বিস্তার রোধে অন্যতম ভূমিকা রাখবে।
(খ) এক প্রকার প্যানোজেনিক ছত্রাক নারিকেল মাইট ধবংসের অন্যতম ছত্রাক। নারিকেল মাইট কলোনীতে এ ছত্রাকের উপস্থিতি নারিকেল মাইটের বংশ বিস্তার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
(গ) এছাড়াও এক প্রকারের লেডিবাড বিটল এ ক্ষতিকর নারিকেল মাইট ধবংস করতে সক্ষম। তাই এ জাতের লেডিবাড বিটল চিহ্নিত করে তা বাগানে ছেড়ে দেয়ার বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। মাইট আক্রান্ত নারিকেল গাছে/ বাগানে এ সব প্রকৃতিক শত্রুুর উপস্থিতিতে এ নারিকেল মাইটের বংশ বিস্তার ও তা দ্বারা ক্ষতির সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে।

একই কারণে পশ্চিমা দেশেগুলো পরিবেশের দিক বিবেচনরায় এনে মাকড় নাশক ব্যবহারে তারা খুব একটা উৎসাহিত নয়, নারিকেল মাইট দমনে এ সব পরভোজী ছত্রাক ও পোকা-মাকড় দ্বারা বায়োলোজিক্যাল কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনার উপর তারা বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারত একই ব্যবস্থায় এ মাইট দমনের লক্ষে গবেষণা শুরু করেছে।
৪। বায়ো পেষ্টি সাইড বব্যহার ঃ
পরিবেশ ও পরভোজী উপকারী প্রাণী সংরক্ষণ করার দিক বিবেচনায় এনে ভারতে নারিকেল মাইট দমনে বায়ো পেষ্টিসাইড ব্যবহারের উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করছে। এগুলো নি¤œরূপ ঃ

(ক) নিম তেল দিয়ে তৈরী মাকড়নাশক ব্যবহার ঃ
আক্রান্ত নারিকেল গাছ ২% নিম তেল, রসুন এবং সাবানের মিক্চার দিয়ে স্প্রে করে সফলভাবে মাইট দমন করা বর্তমানে সহজ হচ্ছে। এ মিক্চার তৈরী করার জন্য ২০ মিলি নিম তেল, ২০ গ্রাম পরিষ্কার রসুন বাটা ও ৫ গ্রাম কাপড় ধোয়ার সাবান একত্রে মেশাতে হয়। এ স্প্রে মিশ্রন তৈরীর জন্য ৫ গ্রাম কাপড় ধোয়া সাবান ৫০০ মিলি পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে তাতে ২০ মিলি নিম তেল মেশাতে হয়। এরপর ২০ গ্রাম পরিষ্কার রসুনকে ভালোভাবে গুঁড়া করে বা বেটে নিয়ে তাতে সাবানগুলা পানি ও নিম তেল মিশিয়ে সমস্ত মিক্চার পাতলা কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিয়ে তা দিয়ে স্প্রে করতে হয়। এ মিক্চার তৈরীর পর পরই স্প্রে করার কাজ সমাধা করতে হবে, তৈরীকৃত মিক্চার রেখে দিয়ে পরের দিন ব্যবহার বা বাসী করে ব্যবহার করা উচিত হবে না।

(খ) বায়ো মাকড় নাশক ব্যবহার ঃ
বর্তমানে এ্যাজাডাইর‌্যাথিন (অুধফরৎধপযঃরহ) নামক নিম থেকে তৈরী এক ধরনের মাকড় নাশক বাজারে পাওয়া যাচ্ছে যা নারিকেল মাইট দমনে কার্যকরি। এ মাকড় নাশক দু ধরনের ফরমুলেশনে পাওয়া যাচ্ছে। তা হতে পারে ১% অথবা ৫% ফরমুলেশনে তৈরী। এ মাকড় নাশক ব্যবহার ক্ষেত্রে ১% ফরমুলেশনের ব্যবহার করা হলে প্রতি লিটার পানিতে ৪ মিলি এবং ৫% ফরমুলেশনে তৈরী মাকড় নাশক ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলি এ মাকড় নাশক মিশিয়ে এ মিশ্রন দিয়ে নারিকেল গাছের আক্রান্ত অংশ ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।

গ) স্প্রে করার সময় খেয়াল রাখতে হবে তা যেন কেবল মাত্র নারিকেল ফুল ফল ধরার প্রত্যেকটা নারিকেল কাঁদিতে স্প্রে করা হয় এবং স্প্রের ক্ষুদ্র ফোটা দিয়ে যেন নারিকেলের আক্রান্ত অংশগুলো ভালোভাবে ভেজানো হয়। খেয়াল রাখতে হবে যেন ব্যবহৃত স্প্রে যন্ত্রটি খুব ফাইন ফোটা বের হতে সক্ষম হয়। একটা নারিকেল গাছ স্প্রে করতে ১-১৫ লিটার স্প্রে মিশ্রন যথেষ্ট।
ঘ) * স্প্রে করার কাজ বছরে অন্তত ৩ (তিন) বার করতে হবে। প্রথম বার ডিসেম্বর-ফের্রুয়ারী মাসে, দ্বিতীয় বার এপ্রিল-জুন মাসে এবং তৃতীয় বার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে স্প্রে করার কাজ শেষ করতে হবে।
* খেয়াল রাখতে হবে যেন এ স্প্রের তরল পদার্থ কচি নারিকেলের বোঁটার অংশসহ সমস্ত জায়গায় ভালভাবে ভেজানো যায়।
* নারিকেলের কাঁদি ছাড়া অন্য অংশে (পাতা ও কান্ড) স্প্রে করার প্রয়োজন নেই। কেন না, বাকী অংশে নারিকেলের মাইট থাকে না। নারিকেলের স্ত্রী ফুল যা ফল ধরা আরম্ভ হয়নি, সে অংশেও স্প্রে করা যাবে না।
* স্প্রে করার আগে অবশ্যই সংগ্রহযোগ্য ডাব ও নারিকেল পেড়ে নিতে হবে।

নারিকেল গাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা গ্রহনঃ
ক) নারিকেলের বিভিন্ন অংশের উপাদান দিয়ে তৈরী ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরী করে তা নারিকেল বাগানে বছর ব্যাপী ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে তাতে লিগনীল জাতীয় ছত্রাক ব্যবহার করতে হবে।
খ) বাগানে বা গাছের গোড়ায় সবুজ সার (বরবটি, ধৈঞ্চা) তৈরী ও ব্যবহার উদ্যোগ নিতে হবে। এগুলো গ্রীষ্মকালে মালচিং এর কাজ করবে এবং পরবর্তীতে বর্ষায় তা পঁচে জৈব সারের কাজ করবে।
গ) বছরে বর্ষার আগে ও পরে কম পক্ষে ২ বার অনুমোদিত ডোজে জৈব ও অজৈব সার নারিকেল গাছে ব্যবহার করতে হবে
ঘ) শুকনা মৌসুমে বাগানের মাটিতে রসের পরিস্থিতি বুঝে প্রতি গাছে সপ্তাহে একবার ২০০-৪০০ লিটার পানি সেচ দিতে হবে।
ঙ) গাছের গোড়ার চারদিকে মাটিতে রস সংরক্ষণের জন্য মালচিং ব্যবস্থা নিতে হবে। এগুলো হতে পারে ঃ
 গোড়া থেকে প্রায় ২ মিটার (রেডিয়াস) ব্যাপী স্থান নারিকেল ছোবড়া দিয়ে মালচিং ব্যবস্থা নেয়া একই ভাবে নারিকেল পাতা/সবুজ সার/ গ্রীন লতা পাতা দিয়ে তৈরী কম্পোষ্ট দিয়ে রস সংরক্ষণ করা কোকো ডাষ্ট দিযে মালচিং করার ব্যবস্থা নেয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *