নিতাই চন্দ্র রায়ঃ
এখন জ্যৈষ্ঠ মাস। বাজারে আসতে শুরু করেছে আম, জাম ,কাঁঠাল, লিচু, জামরুল প্রভৃতি সুস্বাদু ও রসালো মৌসুমী ফল। জাতীয় অর্থনীতিতে ফলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।ফলের আওতায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ১.৬৬ শতাংশ হলেও জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফসল ভিত্তিক আয়ের প্রায় শতকরা ১০ ভাগ আসে ফল থেকে।এ ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ফল চাষের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। এদেশে ৬০ থেকে ৭০টি ফলের চাষ হলেও উৎপাদিত ফলের শতকরা ৫৪ ভাগ পাওয়া যায় বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে।অবশিষ্ট ৪৬ ভাগ ফল পাওয়া যায় বছরের বাকি ৮ মাসে। বাঙালি ফল খাওয়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকে মধু মাসের দিকে। মৌসুমী ফল মানব স্বাস্থ্যর জন্য অত্যন্ত উপকারী।স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ , পুষ্টি ও ভেষজ গুণের জন্য ফল সকলের প্রিয় খাদ্য। ফলের আর একটি সুবিধা হলো- এটি রান্না ছাড়াই সরাসরি ভক্ষণ করা যায়। কিছু দিন আগেও এদেশে ফল ছিল সবচেয়ে নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত উৎকৃষ্ট খাবার। ফলে ভেজাল দেয়ার কথা কেউ ভাবতেও পারতো না। গাছ থেকে পাকা ফল পেড়ে কৃষক বাজারে বিক্রি করতো। মানুষ সেই ফল কিনে বাড়িতে নিয়ে মনের আনন্দে উপভোগ করতো পরিবারের সদস্যদের সাথে। শিশুদের হাতে পাকা সুস্বাদু রঙিন ফল তুলে দিলে তারা যে কী খুশি হতো তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তখন ফলের স্বাদ ও ছিল অনেক বেশি। কিন্তু এখন সে অবস্থা নেই। ফল হাতে নিলে বিষের ভয়ে কেঁপে উঠে বুক। ফলের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণের বিভিন্ন পর্যায়ে মেশানো হচ্ছে মানব স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ। তাই মধু মাসে নিরাপদ মৌসুমী ফলের প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে জনমনে ।২০১২ সালে দিনাজপুরে কীটনাশক মিশ্রিত বিষাক্ত লিচু খেয়ে ১২ জন শিশু মারা যায়। গত বছরও একই ঘটনা ঘটে দিনাজপুর জেলায়। হৃদয় বিদারক ওই ঘটনাগুলো প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হওয়ায় সারা দেশের মানুষের মধ্যে মৌসুমী ফল নিয়ে অজানা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। রাসায়নিক বিষ মেশানো ফল খেয়ে মানুষ আ্যাজমা, গ্যাস্ট্রিক, লিভার নষ্ট হওয়া, ক্যান্সারসহ দীর্ঘ মেয়াদী নানা রকম মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কৃষক ও সাধারণ মানুষ গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নিপতিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের চেয়ারম্যান (পবা)এর অভিমত হলো-আমারা যে ফল-মূল, শাক-সবজি খাচ্ছি ,সেগুলো বিষমুক্ত কি না, তা নিশ্চিত নয় । দেশে আজ নীরব গণহত্যা চলছে।এর কারণ, আমারা বিষাক্ত খাদ্য খাচ্ছি । পরিবেশ বিষাক্ত করছি। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমের মুকুল আসা থেকে শুরু করে বাজারজাত ও সংরক্ষণ করা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কীটনাশক মেশানো হচ্ছে ।কৃষক ভালভাবে না জেনে এক শ্রেণির অসাধু কীটনাশক ব্যবসায়ীদের প্ররোচনায় এসব আত্মঘাতি কাজ করছে। এসব বিষ মেশানো ফল খেয়ে মানুষের শরীর সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকে মারা যাচ্ছে বিভিন্ন অসুখে। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, কীটনাশকের নামে নিষিদ্ধ জিনিস ব্যবহার করা হচ্ছে দেশে। কীটনাশক ব্যবহারের জন্য সরকারের কমিটি রয়েছে। সেই কমিটিতে আমদানী কারক ও প্রস্তুকারকদের প্রতিনিধি থাকলেও পরিবেশবাদী সংগঠনের কোনো প্রতিনিধি নেই। কীটনাশকের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের গাফিলতি রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ রাসায়নিক আমদানি হচ্ছে, কতগুলো আইনিভাবে আবার কতগুলো বেআইনিভাবে । এই অসাধু কাজে যারা জড়িত তাদের বিচার হওয়া উচিত। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে ‘বিষমুক্ত নিরাপদ মৌসুমী ফল নিশ্চিত কর’ শীর্ষক এক মানব বন্ধনের আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দেলনসহ ৯টি সামাজিক সংগঠন।মানব বন্ধনে বক্তরা বলেন- মৌসুমী ফল ও খাদ্যে বিষ এবং ভেজাল মিশ্রণ চরম আকার ধারণ করেছে। এতে বিঘিœত হচ্ছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ।
এ অবস্থা অবসানে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য সরকারের কাছে ১০ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করে। সুপারিশগুলো হচ্ছে-১. খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি উৎপাদন থেকে যোগানের প্রতিটি ধাপে পরিবেশ সম্মত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ২. খাদ্যে ক্ষতিকর সকল ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধ করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৩.নিরাপদ খাবার তৈরী বিপণন ও বাজারজাতকরণ এবং জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ ও সমন্বিত প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।বিশেষ করে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এবং ফরমালিন নিয়ন্ত্রন আইন-২০১৫ দ্রুত কার্যকর করতে হবে।৪. প্রতিটি জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপন এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদ্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ করতে হবে। ৫. প্রতিটি জেলায় কৃষি আদালত গঠন করতে হবে। ৬. সরকারক কর্তৃক নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থের আমদানি কারক ও ব্যবহারকারী এবং লেবেল ছাড়া বা মিথ্যা লেবেলের মাধ্যমে কীটনাশক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৭. সময়োপযোগী কীটনাশক নিয়ন্ত্রন আইন প্রণয়ন করতে হবে। ৮. দেশের চাহিদা অনুযায়ী টিসিবির মাধ্যমে ফরমালিন আমদানি করতে হবে। ৯. খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রনে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জেরদারকরণ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।১০. দেশে জৈব কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন ও একে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।এ দাবি শুধু পরিবেশবাদী সংগঠন গুলোর নয়; এদাবি ১৬ কোটি মানুষের।গণমানুষের এ দাবির সাথে একাত্ত্বতা প্রকাশ করে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার আহম্মদপুর বাজারের ফল ব্যবসায়ীরা বুকে হাত রেখে ক’দিন আগে শপথ করেছেন। তারা আম, জাম লিচুসহ সব ধরনের ফলে ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক মেশাবেন না। শপথে অংশ নেয়া ব্যবসায়ীগণ বলেন, তারা না বুঝেই এতদিন ফলে কার্বাইড ও ফরমালিনসহ নানা ধরনের রাসায়নিক মিশিয়েছেন। এখন এর ক্ষতির দিকটা তারা জানতে পেরছেন। তাই তারা আর কখনো ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশাবেন না। শপথ গ্রহণের ঠিক একই দিনে বাগাতিপাড়া উপজেলার শাহাব উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীকে আমে ক্ষতিকর কার্বাইড মেশানোর দায়ে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জেও কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম বিক্রির দায়ে মোঃ রাজু নামের এক আম বিক্রেতাকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে এখনও ব্যবসায়ীরা আমে রাসায়নিক মেশানোর মত গর্হিত কাজ পরিত্যাগ করতে পারছে না।জনস্বাস্থ্য তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।তাদের উদ্দেশ্য একটাই- অধিক অর্থ উপার্জন এবং রাতারাতি আঙ্গুল ফলে করাগাছ হওয়া।
২০১৪ সাল ছিল আম চাষিদের জন্য একটি কলঙ্কিত বছর। ওই বছর ফরমালিন যুক্ত আম ধ্বংসের নামে সারা দেশে যে তা-ব চালানো হয় তা আম চাষিরা ভুলতে পারবেনা কোনো দিন। তখন আমে বিষাক্ত ফরমালিনসহ নানা রকম রাসায়নিক মিশানোর মিথ্যা অভিযোগে ঢাকা শহরের প্রবেশ পথে ব্যাপক তল্লাশি করে শতশত ট্রাক আম ধ্বংস করা হয়। এতে শুধু চাপাইনবাবগঞ্জের ক্ষুদ্র উৎপাদকারীরা মহাজনের নিকট বাকিতে বিক্রয় করা আমের ২০০ কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হন।আম ব্যবসায়ীরাও লাখ লাখ টাকা লোকসানের কারণে সর্বস্বান্ত হন। পরবর্তীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষাতে ধরা পড়ে, যে যন্ত্রটি আমের ফরমালিন শনাক্তের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল তা সঠিক ছিল না। সেটি ছিল বাতাসের ফরমালিন মাপার যন্ত্র। গত বছরও আম চাষিরা আম নিয়ে অযথা বিরম্বনার শিকার হন ।কার্বাইড দিয়ে অপরিপক্ক আম পাকানো রোধে প্রশাসন আম পাড়ার একটি তারিখ বেধে দেয়। এতেও আম চাষিরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন। এ ছাড়া আমের ভরা মৌসুমে রোজার কারণে বাজারে আমের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। গোপালভোগ ,হিমসাগর ও লক্ষণভোগের মত ভাল জাতের আম ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। এতে চাষিয়া আমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
কিছু দিন আগেও আম চাষ রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ,দিনাজপুর, কুষ্টিয়া , মেহেরপুর জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে দেশের ২২টি জেলাতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আম চাষ হচ্ছে। মাঠ ফসলের চেয়ে বেশি লাভ হওয়ার কারণে আম চাষ দক্ষিণের লবণাক্ত এলকা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে পার্বত্য এলাকর খাগড়াছড়ি ,কাপ্তাই ও বান্দরবান এলাকায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবে প্রতি বছর দেশে নতুন করে আট হাজার হেক্টর জমি আম চাষের আওতায় আসছে এবং প্রতি বছর উৎপাদন বাড়ছে ৫০ হাজার মেট্রিক টন করে। জাতি সংঘের কৃষিও খাদ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশ বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন করে বিশ্বের শীর্ষ আম উৎপাদনকারী দেশের অষ্টম স্থান দখল করেছে। আম উৎপাদনের এই বিষ্ময়কর সফলতা থেকে বলা যায় দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আম হতে পারে অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে উৎপাদিত আমের চাহিদা মেটানোর পরও ৭০ শতাংশ উদ্বৃত্ত আম রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এসব আম রপ্তানি করে বাংলাদেশ খুব সহজেই ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের মতো আম রপ্তানিকারক দেশের সুনাম অর্জন করতে পারে। আধুনি উৎপাদন ব্যবস্থা, উন্নত প্যাকিং ও বিপণন ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে রপ্তানির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। জানা গেছে গত বছর পরীক্ষা মূলকভাবে রপ্তানি করার পর ইউরোপ- আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আম নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট এ বছর বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ আম আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিদেশে আম রপ্তানি করতে হলে নিরাপদ আম উৎপাদনে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আম উৎপাদনকারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের নজরদারী ও পর্যবেক্ষণ আরো জোরদার করতে হবে।এ ছাড়া আমকে কেন্দ্র করে দেশের উত্তরাঞ্চলে আরো অধিক সংখ্যক কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম