নিতাই চন্দ্র রায়
বাংলাদেশে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসেই সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু ফল পাওয়া যায়। এ জন্য এ মাস তিনটিকে মধু মাস বলা হয়। এ সময়ে আম ,জাম কাঁঠাল, লিচু, লটকন, জামরুল, তরমুজ, পেয়ারা, বাঙ্গি ও আনারসসহ নানা রকমের রসালো ফলে গ্রামের হাট-বাজার ও শহরের ফলের দোকানগুলি ভরপুর থাকে। গ্রামের মানুষ এই সময় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে উপহার হিসেবে আম, কাঠাল ও লিচু পাঠান। নিজের গাছের বা বাগানের ফল অনেকে পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যেও বিতরণ করেন। এটা গ্রাম বাংলার একটি অতীত ঐতিহ্য। জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাই ষষ্ঠি হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় উৎসব। এ উৎসবে জামাই শ্বশুর বাড়িতে মৌসুমী ফলের ঝুরি নিয়ে উপস্থিত হন। শ্বশুর-শ্বাশুরী জামাইকে কাপড়-চোপড় উপহার দেন।আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অত্যন্ত জাকজমকের সাথে জামাই ষষ্ঠী উদযাপন করা হয়। সেখানেও মৌসুমী ফল ও পদ্মার ইলিশই জামাই ষষ্ঠীর প্রধান অনুষঙ্গ।
বাংলাদেশে উৎপন্ন প্রায় ৭০ রকমের ফলের মধ্যে ৯টি ফলই প্রধান। প্রধান ফলগুলোর মধ্যে আম ,কলা, কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, লিচু ও কুল প্রায় শতকরা ৭৯ ভাগ জমি দখন করে আছে। অবশিষ্ট শতকরা ২১ ভাগ জমিতে হয় অপ্রধান ফলগুলোর চাষ।বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক তিন লাখ হেক্টর জমি থেকে বছরে প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয়। বিশ্বের প্রধান ১০টি আম উৎপাদকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান সপ্তম।
অন্য ফসলের তুলনায় ফল চাষ অধিক লাভজনক হওয়াতে বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, দিনাজপুর, রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও , মৌলভী বাজার, সিলেট,বান্দারবন, খাগড়াছড়ি জেলায় ফলের চাষ উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময় উন্নত জাতের আমের চাষ রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কয়েকটি জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক নব্বইয়ের দশকে আ¤্রপালি ( বারিআম ৩) জাতটি প্রবর্তনের ফলে সারা দেশে আম চাষের এক নীলব বিপ্লব সাধিত হয়। সুস্বাদু আমের চাষ ময়মনসিংহ , টাঙ্গাইল, সিলেট, মৌলভী বাজার, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, বান্দারবান ও খাগরাছড়িসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আমের উৎপাদন ও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ ক্ষেত্রে বারি আম ৪, ও মল্লিকা জাতের অবদানও কম নয়।ইদানিং হাড়িভাঙ্গা, বারিআম ৯ ( কাঁচামিঠা) ও গৌড়মতি আম আবাদে কৃষকের মধ্যে বেশ আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে । সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার জন্য মাথা পিছু দৈনিক কমপক্ষে ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। আমরা প্রতিদিন গড়ে ফল গ্রহণ করি মাত্র ১৭২ গ্রাম।আবার গ্রহণকৃত ফলের পরিমাণও সুষমন নয়। ধনীরা বেশি খায় । আবার অনেক গরীবের ভাগ্যে ফলের খোসাও জোটে না। এ জন্য দেশে অপুষ্টিজমিত রোগের প্রকোপ বেশি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগানিরা বালাইনশক বিক্রেতাদের পরামর্শে শোষক পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা, ছাতরা পোকা, এনথ্রাকনোজ ও পাওডারি মিলডিওসহ বিভিন্ন পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই দমনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে সাইপারমেথ্রিন, ফেনিট্রোথিয়ন, ডাইমেথয়েড, ব্যাভিষ্টিন, রোভরাল এবং সালফার জাতীয় বালাইনাশক ব্যবহার করেন।অনেকে অধিক লাভের আশায় অপরিপক্ক ফল পাকাতে এবং রং উজ্জ্বল করতে বিভিন্ন হরমোন ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করেন। ফল গবেবষকগণ বলেন, মুকুল থেকে শুরু করে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত ২০ থেকে ৬০ বার পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিরা বিভিন্ন বালাইনাশক, ভিটামিনও হরমোন স্প্রে করতেন। গত কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত বালাইনাশক স্প্রে না করার জন্য আমবাগানিদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারের কারণে এবং আমে নিরাপদ ফ্রুটব্যাগিং পদ্ধতি প্রচলনের ফলে আম বাগানে বালাইনাশক ব্যবহার বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এখন বেশিরভাগ আম বাগানি ৪ থেকে ৫ বারের বেশি বালাইনাশক স্প্রে করেন না।
মধুমাসে নিরাপদ আম নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়েছে নানা উদ্যোগ। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলা প্রশাসন ২৫ মের আগে আম পাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেঁধে দেওয়া সময় হলো- গোপালভোগ ২৫ মে, হিমসাগর ২৮ মে, লক্ষণভোগ ১ জুন, ল্যাংড়া ও বোম্বাই খেরসাপাত ৫ জুন, ফজলি, সুরমা ফজলি ও আ¤্রপালি ১৫ জুন এবং আশ্বিনা ১ জুলাই । প্রশসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এ সময়ের আগে কেউ আম পেড়ে বাজারজাত করলে মনিটরিং কমিটি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া মৌসুমে ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রয়োগের মাধ্যমে আম পাকানো বন্ধ করণে হাট-বাজারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উদ্বুদ্ধকরণ সভা, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ এবং ভ্রাম্যমান আদালত থাকবে জেলার সব উপজেলায়। আম বাগানে বিএসটিআই, র্যাব, পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটগণ প্রতিদিন অভিযান চালাবেন।
বিজ্ঞানীরা জানান, গত বছরের সফলতার পর এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় বিষমুক্ত আম উৎপাদনে নিরাপদ ফ্রুটব্যাগ ব্যবহারে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার শতকরা ৭০ থেকে ৯০ ভাগ হ্রাস পাবে । এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ মুক্ত আম পাওয়া যাবে, আমের রং উজ্জ্বল হলুদ হবে এবং আম ৯ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত ভালভাবে সংরক্ষণ করা যাবে।আম ছাড়াও নাটোর , রাজশাহী, পাবানা, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় থাই পেয়ার উৎপাদনে এ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে চাষিরা লাভবান হচ্ছেন এবং ভোক্তাগণও পাচ্ছেন বিষমুক্ত নিরাপদ পুষ্টিকর পেয়ারার স্বাদ। ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ প্রতিরোধে এবং লিচুর আকার বড় ও রং আকর্ষণীয় করতে লিচুবাগানিরা কীটনাশকসহ নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য মাত্রামাফিক কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে, তবে তার প্রয়োগ লিচু পাড়ার ১৫ দিন আগেই বন্ধ করতে হবে।
সম্প্রতি মেহেরপুরের গাংনিতে কার্বাইড মিশিয়ে পাকানো এক ট্রাক আম ধ্বংস করে ভ্রাম্যমান আদালত। আদালত সূত্রে জানা যায়, জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০ মে থেকে হিমসাগর আম সংগ্রহ শুরু হওয়ার সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই চিৎলা গ্রামের শফিউর রহমান টমার ছেলে হিরণ মিয়া আম সংগ্রহ করে বগুড়া শহরের ফল মার্কেটে প্রেরণ করছিল। খবর পেয়ে ভ্রাম্যমান আদালত এক ট্রাক আম জব্দ করেন। আমে কার্বাইড দেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত হয়ে ট্রাকের চাপায় পিষ্ট করে আমগুলো ধ্বংস করা করেন ভ্রাম্যমান আদালত।
ক্যাসিয়াম কার্বাইড এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ পদার্থ।যৌগটি বাতাস বা জলীয় বাস্পের সংস্পর্শে এলেই এসিটিলিন গ্যাস উৎপন্ন করে, যা ফলে প্রয়োগ করলে এসিটিলিন ইথানল নামক বিষাক্ত পদার্থে রূপান্তরিত হয়। এই কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেয়ে মানুষ দীর্ঘ মেয়াদী নানা রকম রোগে বিশেষ করে বদহজম, পেটের পীড়া, পাতলাপায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্টিক, শ্বাসকষ্ট, আ্যাজমা, লিবারও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া মহিলার এর প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারে। শিশুরা এসব বিষাক্ত পদার্থের বিষক্রিয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।২০১২ সালে কীট নাশক মিশ্রিত লিচু খেয়ে দিনাজপুর জেলায় ১৪ জন শিশু অকালে প্রাণ হারায়। বিষয়টি তখন সারা দেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ইথোফেন দিয়ে ফল পাকানোর কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই বলে বৈজ্ঞানিকরা অভিমত প্রকাশ করেন। ইথোফেন একটি প্লান্ট হরমোন। এটি পরিপক্ক ফলকে পাকাতে ও সংরক্ষণে সারা পৃথিবীতে এর প্রচলন রয়েছে।গবেষকগণ বিভিন্ন মাত্রায় ইথোফেন পরিপক্ক আমে স্প্রে করার ২৪ ঘণ্টা পর পুনরা তার উপস্থিতি নির্ণয় করতে গিয়ে দেখতে পান যে, তা দ্রুত উপরিভাগ থেকে উড়ে যায়। উড়ে যাওয়ার পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা নির্ধারিত গ্রহণযোগ্যতার মাত্রার অনেক নিচে নেমে যায়। তবে আমচাষিরা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার না করেন এবং তা কেবল মাত্র পরিপুষ্ট কাঁচা আমে ব্যবহার করা হয় সে বিষয়ে বহুল প্রচার ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
গরম পানিতে পরিপক্ক আম শোধন করা হলে কাঁচা আম শোধন করা হলে আমের গায়ে লেগে থাকা রোগ জীবাণু ও পোকা মুক্ত হয়। ভোক্তার কাছে শোধন করা আমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। মৌসুমে পরিপক্ক পুষ্ট কাঁচা আম গাছ থেকে সাবধানে পেড়ে তা পরিস্কার পানিতে ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে। তারপর একটি পাত্রে ৫২ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে আমগুলো ৫ মিনিট শোধন করে উঠিয়ে নিতে হবে। তারপর আমের গা থেকে পানি শুকিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে প্যাকিং করে বাজারজাত করতে হবে। এ অবস্থায় জাত ভেদে অশোধিত আমের চেয়ে গরম পানিতে শোধিত আম ১০ থেকে ১৫ দিন বেশি সংরক্ষণ করা যায়। এ পদ্ধতি সীমিত পরিমাণ আমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ভারতসহ পৃথিবীর অনেক উৎপাদনকারী দেশে রাসায়নিক পদ্ধতিতে আম শোধন করা হয়। গাছ থেকে আম পাড়ার পর আমের কস বের হয়ে গেলে শোধন উপযোগী হয়। প্রতি লিটার পানিতে ০.৫৫ মিলি ‘ প্লোক্লোরাজ’ নামক রাসায়নিক দ্রব্য মিশানো পানিতে আম ভালভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। এভাবে আম শোধনে আমের পচন রোধ ও উজ্জ্বলতা বজায় থাকে। অধিকন্তু আম পাড়া থেকে বাজারজাত করণ পর্যন্ত আম ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সহজেই সংরক্ষণ করা যায়। আম রপ্তানি কারক সব দেশেই এই পদ্ধতি প্রচলিত আছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ থেকে ১.০ গ্রাম ‘ বেনোমিল’ নামক রাসায়নিব দ্রব্য মিশিয়ে তাতে একই ভাবে আম শোধন করা যায়। এ পদ্ধতিতে আম শোধন ব্যবস্থা ভারতে অতি জনপ্রিয়। বর্তমানে কিছু সচেতন আম চাষি ভারত থেকে ‘বেনোমিল’ এনে আম শোধন করে সুফল পাচ্ছেন। আম চাষিদের স্বার্থে বিষয়টির প্রতি আমাদের আম বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
* লেখকঃ
সাবেক মহাব্যবস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ