Site icon

নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন ও জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণঃ স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ ও করণীয়

মাছ-চাষ

ড. মোঃ মুনিরুজ্জামান*

আমাদের বলা হয়ে থাকে ”মাছে ভাতে বাঙ্গালি”। কিন্তু মাছ যে শুধু বাঙ্গালির খাদ্য তালিকাতেই পুরোপুরি ঠাঁই করে নিয়েছে তাই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খাদ্য তালিকায় মাছের স্থান নজির বিহীন। পুষ্টিগুণ, স্বাদ ও সহজে হজমযোগ্য হওয়ার কারণে সারা বিশ্বে মাছ অত্যন্ত উপাদেয় ও সকল শ্রেণির মানুষের নিকট অধিকতর পছন্দনীয় খাদ্য। প্রাচীন রাজ-রাজাদের ভোজ সভায়ও মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ আইটেম হিসেবে থাকত। এদেশে গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন হোটেলগুলোতে, বড় বড় পার্টিতে মাছের একাধিক আইটেম থাকে। কিšুÍ উৎপাদিত মৎস্য বা মৎস্যপণ্যে ও চিংড়িতে যদি জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোন জীবাণু বা উপাদান থাকে তখন সেটা খাদ্য হিসেবে গ্রহণের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ থাকে না বরং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভোক্তার শরীরে সৃষ্টি করে খাদ্যবাহী নানা রোগ বা সমস্যা। তাই বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা হলো খাদ্য উৎপাদন, পরিবহন এবং সংরক্ষণের বিজ্ঞানভিত্তিক এমন সব উপায় যাতে খাদ্যবাহিত রোগ প্রতিরোধের নিশ্চিয়তা থাকে । খাদ্য নিরাপত্তার শর্তই হলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, মানুষের খাওয়ার জন্য উপযোগী বা নিরাপদ নয় এমন খাদ্য বাজারে সরবরাহ করা যাবে না। কারণ নিরাপদ খাদ্য মানুষের জন্ম জন্মান্তরের অধিকার। তাই জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণে এবং সুস্থ জাতি গঠনের জন্য নিরাপদ মৎস্য ও চিংড়ি উৎপাদন খুবই জরুরী
মৎস্য ও মৎস্য পণ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণ
মাছ বা চিংড়ি উৎপাদনের পুকুর বা ঘের প্রস্তত থেকে শুরু করে ভোক্তার টেবিলে পৌঁছা পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এ ধাপগুলোর যে কোন ধাপে মাছ বা চিংড়ি দূষণযুক্ত হয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। নি¤েœ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপের উল্লেখ করা হলোঃ

খামারের স্থান নির্বাচন
মাছ বা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে খামারের স্থান নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুকুর/ঘের তৈরির আগে অবশ্যই মাটি পরীক্ষা করে নিতে হবে। মাটির পিএইচ ৬.৫-৮.৫ এর মধ্যে আছে এমন স্থান খামারের জন্য নির্বাচন করা হলে সেখানে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা না দিলে এবং সঠিক উৎপাদন ব্যবস্থা অনুসরণ করলে একদিকে যেমন মাছ বা চিংড়ির উৎপাদন বেশি হবে অন্য দিকে উৎপাদিত মৎস্য বা চিংড়ি মানুষের জন্য নিরাপদ থাকবে। যেখানে গবাদি-পশু বা হাঁস-মুরগির খামার আছে, শিল্প ও কলকারখানার বা পয়:বর্জ্য নিষ্কাশন হয় বা নিয়মিত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হয় এমন কৃষি ক্ষেত আছে সেখানে খামোরের স্থান নির্বাচন উচিত নয়।
পুকুর/ঘের প্রস্ততকালে রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার
রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ বা প্রাণি দূর করার জন্য অনেক মৎস্য চাষি বা ঘের মালিক দ্রুত গতিতে ফল পাওয়ার আশায় ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ ঘোষিত রাসায়নিক দ্রব্যাদি যেমন-থায়োডিন, থায়োনেক্স, থায়োনেল ইত্যাদি কীটনাশক ব্যবহার করেন। এর ফলে রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ বা প্রাণি মারা যাওয়ার সাথে সাথে জলজ বাস্তসংস্থান, জীববৈচিত্র্য, খাদ্য শিকলসহ পুরো জলজ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং বিষাক্ত হয়ে যায়। রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ বা প্রাণি দূর করার জন্য রোটেনন পাউডার ব্যবহার করা সর্বোত্তম। কারণ এক্ষেত্রে মাছ শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়। তাই এ মাছ খেলে মানুষের ক্ষতি হয় না। কিন্তুু কীটনাশক ব্যবহার করলে এর বিষক্রিয়া মাছের পাকস্থলীতে প্রবেশ করে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ মাছ কোন মানুষ খেলে সেও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। সিগারেট পান করলে যেমন সাথে সাথে কোন ক্ষতি বুঝা যায় না তেমনি বিষযুক্ত মাছ খেলেও তার বিষক্রিয়াও তাৎক্ষণিকভাবে অনুভূত হয় না কিন্তুু সিগারেটের মতো অনেক দিন পর সমস্যা দেখা দেয় বা কোন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পুকুর/ঘেরের তলার কালো কাদা
তলার পচা কালো কাদা তুলে ফেলে সূর্যালোকে ভালভাবে না শুকালে তলা জীবাণুমুক্ত হয় না। ব্যাকটেরিয়াল জীবাণু
দ্বি-বিভাজন প্রক্রিয়ায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে চাষের যে কোন পর্যায়ে মাছ বা চিংড়ি রোগে আক্রান্ত হতে পারে বা ক্ষতিকর জীবাণু দ্বারা দূষিত হয়ে মানুষের খাদ্য হিসেবে অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে।
প্রাণির মলমূত্র ব্যবহার 
অনেক চাষি হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, গরুর গোবর, অনেক দেশে মানুষ বা শুকুরের পায়খানা কম্পোস্ট না করেই জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করে। অথচ এগুলোতে মানুষের জন্য ক্ষতিকারক ঝধষসড়হবষষধ, ঝযরমবষষধ, ঊংপযবৎরপযরধ পড়ষর সহ বিভিন্ন ধরণের অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়া থাকে। হাঁস-মুরগির চিকিৎসার জন্য অনেক খামারী নাইট্রোফুরান জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ হিসেবে বা অনেক সময় খাবারেও এ ওষুধ ব্যবহার করা হয়। হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা পানিতে সার হিসেবে ব্যবহার করলে নাইট্রোফুরান ও তার মেটাবোলাইটস পানিতে মিশে। পরে পানি হতে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় চিংড়ি বা মাছের দেহে প্রবেশ করে শরীরে জমা হতে থাকে। ঐ চিংড়ি বা মাছ তখন খাবার হিসেবে নিরাপদ থাকে না।।
অপরিশোধিত পোনা/পিএল মজুদ 
পোনা/পিএল মজুদ করার পূর্বে তার উৎস বিবেচনায় না আনা হলে বা লবণ/পটাশ দিয়ে পরিশোধন করে ছাড়া না হলে অনেক সময় পোনার কারণে মৎস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে বা উৎপাদিত মৎস্য খাওয়ার জন্য নিরাপদ নাও হতে পারে।

খাদ্যে হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার 
দীর্ঘ সময় ব্যাপি স্টেরয়েড জাতীয় খাদ্য ব্যবহারে বা অতিরিক্ত মাত্রায় স্টেরয়েড সমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়ালে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন- গোনাড (মড়হধফ) বৃদ্ধিতে , হাড়ের বিকলঙ্গতা, ঘা সৃষ্টি এবং লিভার, কিডনি ও পোষ্টিক নালীতে রোগ সৃষ্টি হতে পারে। আহরণযোগ্য মাছ বৃদ্ধিতে হরমোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। খাদ্য পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্লোরামফেনিকল ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। এ অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের শরীরে রক্তশূন্যতা সৃষ্টি করে এবং কারসিনোজেনিক প্রভাব আছে। ফ্লুরোকুইনোলোনস ব্যবহারের ফলে মানুষের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠে।

অ্যান্টিবায়োটিক টেরামাইসিন ও রেনামাইসিন
খাদ্যের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা
অতিরিক্ত তাপমাত্রায় সংরক্ষিত খাদ্যের পুষ্টিমান হ্রাস পায়। খাদ্যে আর্দ্রতার পরিমান ১০ ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৫% এর বেশি থাকলে ছত্রাক বা পোকামাকড় বেশি জন্মাতে পারে এবং তাদের শরীরের এনজাইম খাদ্যের গুণগতমান নষ্ট করে দেয়। অনুকূল তাপমত্রা ও আর্দ্রতা পেলে অংঢ়বৎমরষষঁং ংঢ়., চবহরপরষষরঁস ংঢ়. ইত্যাদি প্রজাতির ছত্রাক তৈরি খাদ্য ও খাদ্য উপাদান পচায়ে ফেলে। এক ধরণের বিষ উৎপাদন করে যা কারসিনোজেনিক, সাইকোটক্সিক বা নিউরোটক্সিক। ছত্রাকজনিত মাইকোটক্সিন মানব দেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
নিম্মমানের খাদ্য উপকরণ ব্যবহার 
অনেক চাষি খরচ কমানোর জন্য খাদ্য হিসেবে পচা, নষ্ট বা নি¤œ গুণগতমানের গম, ভুট্টা, আটা, গমের ভূষি, চালের খুদ, চালের কুঁড়া, খৈল, গোল আলু, মিষ্টি আলু, মাছের গুড়া, ছোট চিংড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে। এতে পানি দূষিত হয় এবং মাছ ও চিংড়ি মানুষের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়।
রোগ নিরাময়ে রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার 
মাছের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ নিয়াময়ের জন্য অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এতে ধীরে ধীরে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিকের অব্যবহৃত অংশের খারাপ প্রভাব জলজ পরিবেশে এবং মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের মধ্যেও থেকে যায়। অন্যদিকে মাছের ছত্রাকজনিত রোগ, পরজীবী দমনের জন্য মেলাকাইট গ্রিন, ফরমালিন, কপার সালফেট ইত্যাদি রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয় যেগুলোর ঋনাত্বক প্রভাব আছে। চিকিৎসার কারণে মাছকে বাহ্যিকভাবে সুস্থ মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে সুস্থ হয় না বরং মাছের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে নানা সমস্যা দেখা দেয় এবং খাদ্য হিসেবে অনিরাপদ হয়ে পড়ে।

মাছে ফরমালিনের অপব্যবহার 
মাছকে দীর্ঘসময় সতেজ রাখার জন্য কোন কোন অসাধু মৎস্য বিক্রেতা বা ব্যবসায়ী মাছে ফরমালিন ব্যবহার করে। ফরমালিন গলাধঃকরণ হলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। ফরমালিন দ্রুত ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়ে মেটাবলিক এসিডোসিসের সৃষ্টি করে লিভার ও কিডনীকে বিকল করে দেয়। মহিলাদের ঋতুচক্রের পরিবর্তন ও বন্ধ্যাত্ব হতে পারে । দীর্ঘমেয়াদী ফরমালিন নিয়ে কাজ করা মানুষের লিউকোমিয়া এবং ব্রেইন ক্যান্সার হতে পারে ।
আহরণোত্তর পরিচর্যিমি.
মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের গুণগতমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আহরণোত্তর পরিচর্যা বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আহরণোত্তর পরিচর্যা করলে মৎস্য ও চিংড়ি খাদ্য হিসেবে অনিরাপদ হয়। মাছ বা চিংড়ি উৎপাদনের পর আহরণোত্তর অর্থাৎ ধরা থেকে শুরু করে ভোক্তার টেবিলে না পেঁৗঁছা পর্যন্ত পরিচর্যা সঠিক পদ্ধতিতে না হলে ভোক্তার জন্য তা নিরাপদ থাকে না।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাসে করণীয়
জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করতে নিরাপদ মৎস্য ও চিংড়ি উৎপাদন নিশ্চিতকরণ করা প্রয়োজন। নিরাপদ মৎস্য ও চিংড়ি অর্থ হলো- খামারে উৎপাদিত মৎস্য ও চিংড়ি যা সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত এবং তাতে কোন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকে না। নিরাপদ খাদ্য হিসাবে মাছের উৎপাদন এবং মাছ চাষকে উন্নত করতে হলে “ ফার্ম-টু-ফর্ক” অর্থাৎ “খামার থেকে খাওয়ার টেবিল” পর্যন্ত সকল পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে অপরিহার্য অংশ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু এ কাজটি নিশ্চিত করা শুধু মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং উত্তম মৎস্য চাষ অনুশীলন  ও হ্যাসাপের যথাযথ বাস্তবায়ন। চাষ পর্যায়ে অনুসরণীয় কার্যাবলী যা সঠিকভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করলে পণ্য হিসেবে চিংড়ি বা মাছের গুণগতমান এবং খাদ্য নিরাপত্তার বিষযটি নিয়ন্ত্রণ বা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় তাকে উত্তম মৎস্য চাষ অনুশীলন বলে। চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নিযমগুলোকেই উত্তম মৎস্য চাষ অনুশীলন বলে (জিএপি)। সামগ্রিকভাবে খামার পরিকল্পনা, পুুকুর তৈরি, পোনার মান, খাদ্য ও পানির গুণাগুন ব্যবস্থাপনা, আহরণ ও আহরণোত্তর পরিচর্যা, পরিবহন, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি সবই উত্তম মৎস্য চাষ অনুশীলনের আওতায় আসে।এটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। উত্তম মৎস্য চাষ অনুশীলনের উদ্দেশ্য হলো:
ক্স ভোক্তার জন্য নিরাপদ ও মানসম্মত চিংড়ি ও মাছ উৎপাদন করা;
ক্স মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন রোগজীবাণু দ্বারা চিংড়ি বা মাছ যেন সংক্রমিত না হয় তার ব্যবস্থা করা:
ক্স ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক বা রাসায়নিক দ্রব্যাদি বা কোন কীটনাশক দ্বারা চিংড়ি বা মাছ যেন দূষিত না হয় তার ব্যবস্থা করা:
ক্স চাষের শুরু থেকে আহরণ ও আহরণোত্তর পরিচর্যা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে চাষির এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করা যেন উৎপাদিত মাছ বা চিংড়ি জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
অন্যদিকে হ্যাসাপ হলো পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতকরণের একটি আধুনিক পদ্ধতি। এটি বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিসংগত, সুসংগত, নিখুঁত এবং প্রোঅ্যাকটিভ পদ্ধতি। নিরাপদ মৎস্য ও সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে উত্তম মৎস্য চাষ অনুশীলন ও হ্যাসাপের বিকল্প নেই। জিএপি ও হ্যাসাপ সঠিকভাবে অনুসরণ করলে ঃ
ক্স চিংড়ি ও মাছ রোগ সৃষ্টিকারী বা মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোন জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হবে না।
ক্স ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিক বা রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হবে।
ক্স নিষিদ্ধ নয় এমন অ্যান্টিবায়োটিক বা রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার সঠিক মাত্রায় ব্যবহৃত হবে এবং বিষক্রিয়ার মেয়াদকাল যথাযথভাবে অনুসরণ করা হবে।

পরিবেশবান্ধব মাছ চাষের মাধ্যমে নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন

মৎস্য ও চিংড়ির চাষির করণীয় 
 চাষিকে মৎস্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। উপযুক্ত স্থানে পুকুর/ঘেরের স্থান নির্বাচন করতে হবে।
 নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাড়ে বা আশপাশে মলমূত্র ত্যাগ করা যাবে না।
 পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করে পুকুর/ঘের প্রস্তুত করতে হবে। কৃষিক্ষেতে ব্যবহার করা হয় এমন কোন কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত নয়।
 খামারে কর্মচারি নিয়োগের পূর্বে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
 জীবাণুমুক্ত, সুস্থ-সবল ও গুণগত মানের পোনা/পিএল চাষ পদ্ধতি অনুযায়ী সঠিক পরিমানে সকাল বা বিকালে ঠান্ডা আবহাওয়ায় মজুদ করতে হবে। মজুদের পূর্বে পোনা শোধন করে নিতে হবে।
 দূষণ ও সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য খামারে অবাঞ্ছিত প্রাণির প্রবেশ বন্ধ নিশ্চিত রাখতে হবে।
 ভাল মানের খাদ্য পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে এবং যথাযথভাবে খাদ্য গুদামজাত ও সংরক্ষণ করে
রাখতে হবে। কাঁচা খাবার সরাসরি ব্যবহার করা যাবে না।
 শুকনা পিলেট খাদ্য ও খাদ্য উপাদান পরিস্কার, শুকনা ও পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করে এমন ঘরে মেঝে থেকে
১৫-২০ সে.মি. উঁচুতে কাঠ বা বাঁশের মাচার উপর সংরক্ষণ করতে হবে। সরাসরি সূর্যের আলোতে খাদ্য সংরক্ষণ করা যাবে না। তিন মাসের বেশি খাদ্য বা খাদ্য উপকরণ গুদামজাত করে রেখে সেই খাদ্য ব্যবহার করা উচিত নয়।
 মাছ বা চিংড়ির দ্রুত বৃদ্ধির জন্য হরমোন জাতীয় কোন উপাদান ব্যবহার করা যাবে না।
 নিষিদ্ধ ঘোষিত ভেটেরিনারি ড্রাগ এবং রাসাযনিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা যাবে না।
 নিরাপদ নয় এমন মাছ বা চিংড়ি বাজারে সরবরাহ করা যাবে না।
 খাদ্য গুদামে জীবাণূবাহী তেলাপোকা, ছুঁচো, ইঁদুর, বেজি, পাখি ইত্যাদি প্রবেশ যাতে না করে সে ব্যবস্থা
করতে হবে।
 খামার/পুকুরের কালো মাটি ও বর্জ্য শোধন না করে বাইরে কোথাও ফেলা যাবে না।
 নিযমিত খামার পরিদর্শন ও পানির গুণাগুণ পরীক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর জলজ পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
 কেবল সর্বশেষ উপায় হিসেবে অনুমোদিত ওষধ সঠিক ব্যবহারবিধি মেনে ব্যবহার করতে পারেন। তবে ব্যবহারের তথ্য সংরক্ষণ করে অবশেষ নি:শেষ সময় মেনে চলতে হবে।
 নির্দিষ্ট সময় পর পর সঠিকভাবে নমুনায়ন করে মাছের বা চিংড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও খাদ্যের পরিমান পুনঃনির্ধারণ করতে হবে।
 মাছ/চিংড়ি আহরণ করে পরিষ্কার ও ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। মাছ বা চিংড়ি ও বরফের অনুপাত (১:১) সঠিক হতে হবে । কুচি বরফ ব্যবহার করতে হবে এবং গরমের সময় ও দুরত্ব বেশি হলে মাছ বা চিংড়ি ও বরফের অনুপাত ১:২ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
 মাছ ধরার পর মসৃণ ও পরিষ্কার পাত্র ব্যবহার করে যত তাড়াতড়ি সম্ভব আড়ত বা ডিপোতে পেঁৗঁছাতে হবে।

বরফকল, আড়তদার বা ডিপো মালিক, খাদ্য উৎপাদনকারী ও রপ্তানীকারদের করণীয় 
 বরফকল, আড়ত বা ডিপোতে স্বাস্থ্যকর ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
 পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত পানি বরফ তৈরিতে ব্যবহার করতে হবে।
 মাছে বা বরফে ফরমালিন ব্যবহার করা যাবে না।
 আড়তে মাছ গ্রেডিং এর পাকা প্লাটফরম যুক্তিসংগতভাবে উঁচু হতে হবে।
 মাছ পরিবহন যানের ফিশ হোল্ডের সকল দেওয়াল পানি নিরোধক ও তাপ অপরিবাহী হতে হবে।
 পরিবহন যানে এমনভাবে মাছ রাখতে হবে যেন মাছ থেতলিয়ে বা ভেঙ্গে না যায়।
 খাদ্য উৎপাদনকারীকে মৎস্য ও পশু খাদ্য আইন, ২০১০ অবশ্যই মেনে চলতে হবে। মৎস্য খাদ্যে নিষিদ্ধ ড্রাগস যেমন- ক্লোরামফেনিকল, ক্লেনবিউটেরল, ডাই-ইথিলস্টিলবেসট্রল, ডাইমেট্রিডাজল, প্রোনিডাজল, ফুরাজেলিডন, নাইট্রোফুরাজোন, ফ্লুরাকুইনোলোনস, গ্লাইকোপেপটাইডস ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না।
 অভ্যন্তরীণ বাজারে মৎস্য ও মৎস্য পণ্য বাজারজাত করতে ও আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানীর ক্ষেত্রে মৎস্য ও মৎস্য পণ্য (পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৮ (সংশোধিত) অবশ্যই মেনে চলতে হবে। মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় বিধি ৫(২) ১৫ (১) অনুযায়ী অনেকগুলো সুবিধা বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন। নিম্মে কিছু সুবিধাবলী উল্লেখ করা হলো :
ক্স কারখানার মেঝে মসৃণ, পানি নিরোধক এবং ঢালু হতে হবে।
ক্স স্বাস্থ্যসম্মত নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ক্স কারখানার ভিতরের দেওয়াল মেঝে হতে কমপক্ষে ১.৮ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত মসৃণ, পানি নিরোধক ও হালকা রংয়ের হতে হবে।
ক্স কারকানার ভিতরের ছাদের উচ্চতা এমন হতে হবে যেন ছাদের নিচে সহজে চলাফেরা ও কাজ করা যায় এবং মেঝের সঙ্গে দেওয়ালের, দেওয়ালের সঙ্গে দেওয়ালের এবং দেওয়ালের সঙ্গে ছাদের সংযোগস্থলসমূহ অধিবৃত্তাকার হতে হবে।
ক্স জানালা এবং অন্যান্য খোলা অংশ সমূহ এমনভাবে নির্মিত হতে হবে যেন কারখানায় ধূলা-বালি ঢুকতে না পারে এবং ঐগুলো কীট-পতঙ্গ রোধক জাল দ্বারা আচ্ছাদিত হতে হবে।
ক্স দরজা মসৃণ, অশোষক, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন এবং কীট-পতঙ্গ রোধক জাল দ্বারা আচ্ছাদিত হতে হবে।
ক্স প্রক্রিয়াজাকরণ এলাকার প্রবেশ পথে হাত ধৌত করার বেসিন এবং উপযুক্ত পরিস্কারক ও জীবাণুনাশক দ্রব্যাদির সংস্থান থাকতে হবে।
ক্স প্রক্রিয়াজাকরণ এলাকার প্রবেশ পথে পাদুকার তলদেশ জীবাণুমুক্ত করার জন্য জীবাণুনাশক তরল পদার্থের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ক্স কারখানার কর্মীদের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার এবং শৌচাগারের প্রবেশ পথের নিকট হাত ধৌত করার বেসিন এবং উপযুক্ত পরিস্কারক ও জীবাণুনাশক দ্রব্যাদির সংস্থান থাকতে হবে।
ক্স কর্মীদের পোষাক-পরিচ্ছেদ পরিবর্তনের জন্য কারখানার সন্নিকটে বা প্রবেশ পথে প্রয়োজনীয় স্থান ও সুবিধা থাকতে হবে এবং উক্ত স্থান প্রক্রিয়াজাকরণ এলাকা হতে আলাদা হতে হবে।
ক্স শেলফিশ এবং ক্রাশ্টাশিয়ান ব্যতীত অন্যান্য মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে তার-জাল সম্বলিত পাত্র ব্যবহার করা যাবে না।
ক্স প্রক্রিয়াজাতকরণে এনামেল বা গ্যালভানাইজড পাত্র ব্যবহার করা যাবে না।
ক্স প্রত্যক হিমাগারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রা রেকর্ড করা যায় এমন তাপমাত্রামাপক যন্ত্র থাকতে হবে।
ক্স হিমাগারের তাপমাত্রা স্থিরভাবে -১৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে -২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বা তার নি¤েœ রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ক্স চিল রুমের তাপমাত্রা ০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ক্স বরফ মজুদ কক্ষের তাপমাত্রা ০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
উপসংহার 
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পণ্য হলো মৎস্য ও চিংড়ি। মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদেয় খাদ্য উপাদান এবং অথচ পচনশীল। চাষ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ও উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে মাছ ও চিংড়ি জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত বা দূষনযুক্ত হতে পারে। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে এর সঠিক গুণগতমান বজায় রাখা প্রয়োজন। মৎস্য বিশেষ করে চিংড়ির ক্ষেত্রে সরবরাহ বা বিপণন ব্যবস্থাকে সরলীকরন করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সুফলভোগীদেরকে বিভিন্ন আইন ও বিধিমালা এবং জিএপি ও হ্যাসাপ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং এগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ মৎস্য ও চিংড়ি উৎপাদনের স্বার্থে ব্যাপক প্রচারণা, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়নের নিমিত্ত মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। এর জন্য সরকারের পাশাপশি সংশ্লিষ্ট সুফলভোগীদের এবং বেসরকারী সংস্থাসমূহকেও এগিয়ে আসতে হবে।

——-

* সিনিয়র সহকারী পরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, জেলা মৎস্য দপ্তর, মুন্সীগঞ্জ।

Exit mobile version