নিরাপদ সবজি-ফল চাষে বেকারত্ব জয় করলেন শিক্ষিত যুবক শেখ ফরিদ

নিরাপদ সবজি-ফল চাষে বেকারত্ব জয়


মো. মোশারফ হোসেন (শেরপুর) :

নিরাপদ সবজি-ফল চাষে বেকারত্ব জয়

শেরপুরের নকলায় শিক্ষিত বেকার যুবকরা সোনার হরিন নামক সরকারি চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ শাক-সবজি ও ফলের বাগান করে বেকারত্বকে জয় করার স্বপ্ন দেখছেন। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নেই এমন উদ্যমী বেকার যুবকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অনেকেই পরীক্ষামূলক ভাবে বাড়ীর আঙ্গিনায় শাক-সবজি ও ফলের বাগান করে লাভবান হয়েছেন। তারা হয়ে উঠেছেন আত্মপ্রত্যয়ী, তাদের পরিবারে এসছে স্বচ্ছলতা, সমাজে তাদের সম্মান বেড়েছে। তাদের দেখা দেখি অনেক বেকার যুবক-যুবনারীরা চাকরির আশা ছেড়ে নিরাপদ শাক-সবজি ও ফলের বাগানের পাশাপাশি হাঁস মুরগি পালনের দিকে ঝুঁকছেন। কেউ কেউ দেশীয় জাতের হাঁস-মুরগী ও গরু পালন শুরু করে সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছেন।

এমন এক শিক্ষিত বেকার যুবক এইচ এম শেখ ফরিদ, সে উপজেলার উরফা ইউনিয়নের শালখা গ্রামের আমিনুল ইসলামের ২ মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সবার বড় সন্তান। সে ১৯৯৮ সালে জন্ম গ্রহন করে নিজ গ্রামেই পরিবারের সাথে থেকে বড় হয়। উপজেলার বারমাইসা দাখিল মাদরাসা হতে জেডিসি ও ২০১৪ সালে দাখিল পাশ করে এবং হাজী জালমামুদ কলেজ থেকে ২০১৬ সালে বিজ্ঞান শাখা থেকে এইচএসসি পাশের পরে শেরপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রসায়ন বিভাগে পড়া লেখা করছেন।

শেখ ফরিদ জানায়, বর্তমানে চাকরিতে শূণ্য পদের চেয়ে যোগ্যপ্রার্থীর সংখ্যা হাজার গুণ বেশি। হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবনারী চাকরি না পেয়ে টাকার প্রয়োজনে হতাশ হয়ে বিপথ গামী হচ্ছেন। তাই সে চাকরি ব্যতিত স্বাবলম্বী হওয়ার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে বাড়ীর আঙ্গিনায় ২০১৫ সালে পরীক্ষা মূলক ভাবে ১০ টি দেশীয় জাতের পেঁপে গাছ লাগান ও বিভিন্ন শাক সবজি থেকে ওই বছর প্রায় ২৩ হাজার কি ২৫ হাজার টাকা লাভ থাকে তার। ওই লাভের টাকায় তার সারা বছরের লেখা পড়ার খরচ চলে যায়। বিলপাড়ে বাড়ী হওয়ায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সহযোগিতায় পরে বেশ কিছু হাঁস পালন শুরু করেন তিনি। শাক সবজি, পেঁপে ও হাঁস পালনে লাভ দেখে শেখ ফরিদ সরকারি চাকরি করার চিন্তা ছেড়ে দেন। তার বাগান ও হাসের সেবায় তার বাবা-মা ও ছোট বোনরাও নিয়মতি সহযোগিতা করেন। তাছাড়া প্রয়োজনে এলাকার শ্রমিকদের দিয়ে নিড়ানি ও সেচ দেওয়া হয়। বর্তমানে তার নতুন ১০ শতাংশ পেঁপে বাগানে ফলন আসা শুরু হয়েছে। এই বাগানে পারিবারিক শ্রম বাদে সব মিলিয়ে ১২ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। বিক্রি শুরু হওয়ার আগে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকার পেঁপে বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন।

ফরিদ জানায়, তার সফলতা দেখে এলাকার অনেক শিক্ষিত বেকার ভাই-বোনেরা নিরাপদ শাক সবজি ও ফলের বাগানের পাশাপাশি হাঁস মুরগী ও গরু পালনে ঝুঁকছেন। উরফার তারাকান্দা গ্রামের রেজাউল হক হীরা (বিএসসি অনার্স-এমএসসি), পিছলা কুড়ির মোশাররফ হোসেন (বিএসসি অনার্স-এমএসসি), ভূরদী মারাকান্দার এস এম মনিরুজ্জামান (বিকম), হেলাল মিয়া (বিএসএস), ভূরদী পূর্ব খন্দাকার পাড়ার মোখলেছুর রহমান (বিএ), কায়দা গ্রামের আফরিন আন্না (বিএসএস) ও হাসিয়া বেগম (এসএসসি), বাছুর আলগার মোকছেদ মাস্টার (বিএসএস), ভূরদী মালপাড়ার সাদির মাহমুদ (বিএসএস), নয়ানী পাড়ার ফটিক (বিএ)’র মত শত শত শিক্ষিত বেকার যুবক আজ নিরাপদ শাক সবজি ও ফল বাগানের পাশাপাশি দেশীয় হাঁস-মুরগী ও গরু পালন করে বেকারত্ব জয়ের স্বপ্ন দেখছেন। তারা বলেন, সরকারি চাকরিতে যে টাকা পাওয়া যায় তা নিজের এলাকায় থেকে আমাদের মত এই পেশায় নিয়োজিত হতে পারলে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আয় কার সম্ভব। তবে এই ক্ষেত্রে অল্প শিক্ষিত মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন জরুরি। অনেকেই শিক্ষিত হয়ে কৃষি কাজ করাকে হেয় মনে করেন। তাই সমাজে কৃষি কাজকে অধিক গুরুত্ব দিতে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তারা।

শেখ ফরিদের বাবা আমিনুল ইসলাম বলেন, ছেলে পেঁপে চাষে বাড়তি আয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার বাগানে দুই শতাধিক এবং বাড়ির আঙ্গিনায় আরও ২০ টি পেঁপে গাছ রয়েছে। আশাতিত সফলতা পাওয়ায় বাণিজ্যিক ভাবে চাষের আগ্রহ জাগে তার। প্রতিটি গাছে ছোট বড় মিলিয়ে ৫৫ থেকে ৬৫ টি পেঁপে হয়েছে, পরিপক্ক হলে যার ওজন হবে ৪০ কেজি থেকে ৫০ কেজি। সবজি হিসেবে বিক্রি করলে তার ওই বাগান থেকে অর্ধলক্ষাধিক টাকা আয় হবে। আর যদি পাকিয়ে বিক্রি করা হয় তাহলে আয় হবে ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা। অল্প জমিতে অধিক লাভের চাষ হওয়ায় আগামীতে তার ছেলেকে আরও ২০ শতাংশ জমিতে পেঁপে বাগান বাড়াতে বলবেন। তাকে অনুকরণ করে অনেকেই পেঁপে চাষ শুরু করেছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, পেঁপে বাগানে গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেশি সবরী কলা ও বিভিন্ন শাক সবজি লাগানো হয়েছে। এক সেবাতেই চলছে দুই দুই চাষ। পেঁপে গাছ একবার লাগালে টানা দেড়বছর ফল দেয়। তাঁর পরের ৬ মাস যেন জমিটুকু পতিত না থাকে সেদিক বিবেচনায় এইসব রোপন করেছেন তারা। তারা জানান, নিরাপদ ফল ও শাক সবজির চাহিদা বেশি থাকায় দামটাও বেশি পাওয়া যায়। তাছাড়া দেশী হাঁস মুরগীর ডিম ও মাংসের চাহিদা ও দাম দুটিই বরাবরই বেশি থাকে।

উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষন কর্মকর্তা আতিকুর রহমান বলেন, এবছর উপজেলায় শাহী, বারি-১, রেডলেডী, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত ইপসা, এবং স্থানীয় জাতের পেঁপে বেশি চাষ করা হয়েছে। শাক সবজি ও ফলের চাষ করে আজ পর্যন্ত কারো লোকসান গুনতে হয়নি। তাই এইসব চাষ বাড়াতে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ। আগামীতে শাক-সবজি ও পেঁপে চাষের পরিমাণ কয়েকগুন বেড়ে যাবে বলে জানান চাষিরা। এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর বলেন, যে কেউ চাকরির আশা বাদ দিয়ে শাক সবজি ও ফলের বাগান করে স্ববলম্বী হতে পারেন। এসবের চাহিদা সারা বছর থাকে। তিনি জানান, এ বছর উপজেলায় প্রায় ২৫ একর জমিতে বাণিজ্যিক ভাবে পেঁপে চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে শতাধিক বাগান রয়েছে। সব মিলিয়ে উপজেলায় ২৫ সহস্রাধিক পেঁপে গাছ রয়েছে বলে তিনি ধারনা করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *