নিতাই চন্দ্র রায়
পরিপক্ক আখ কাটার পর মাটিতে অবস্থিত আখের কান্ডস্থ চোখ গজানোর পর উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে যে ফসল পাওয়া যায় তাকে মুড়ি আখ বলে। পৃথিবীর সকল আখ উৎপাদনকারী দেশে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ বার মুড়ি আখের চাষ করা হয়। ভারতে একবার নতুন আখের চাষ করে ৪ থেকে ৬ বার,মরিসাস ও তাইওয়ানে ৬ থেকে ৮ বার পর্যন্ত মুড়ি আখের চাষ করা হয়। বাংলাদেশে শতকরা ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ জমিতে অত্যন্ত অয্তন অবহেলায় ১ থেকে ২ বার মুড়ি আখের চাষ করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাংলাদেশে একর প্রতি আখের গড় ফলন মাত্র ১৮ টন এবং মুড়ি আখের ফলন আরো কম। আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে মুড়ি আখের ফলন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব।
নতুন আখের চেয়ে মুড়ি আখ চাষে অনেক সুবিধা আছে। সুবিধা গুলি হলো- (১) মুড়ি আখ চাষে নতুন আখের চেয়ে উৎপাদন খরচ শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ কম লাগে। (২) চাষিরা তাড়াতাড়ি মুড়ি আখ কেটে মোথা তুলে ওই জমিতে ছোলা, গম, আলু, তিসি বা বোরো ধানের চাষ করতে পারেন। (৩) মুড়ি আখ চাষে নালা কাটা, বীজখ- তৈরী, বীজ শোধন, বীজ রোপণ প্রভৃতি কাজে চাষিদেরকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হয় না। (৪) মুড়ি আখ চাষে বীজ বাবদ চাষিদের বহু টাকা সাশ্রয় হয়। (৫) মুড়ি আখে আগাম পরিপক্কতা আসে এবং চিনি ও গুড় আহরণ হারও বেশি হয়।
পদ্ধতিগত মুড়ি আখ চাষের জন্য নিম্ন লিখিত বিষয়গুলি চাষি ভাইদের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। (১) মুড়ি আখের জন্য নির্বাচিত আখের জমিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক পরিপুষ্ট আখ গাছ থাকতে হবে। (২) মুড়ি আখের জন্য চাষিগণকে চারা আখ রোপণের সময়ই উপযুক্ত জাত নির্বাচন করতে হবে। (৩) রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম ছিল এ ধরনের জমি মুড়ি আখের জন্য নির্বাচন করতে হবে। (৪) মুড়ি আখের জন্য জমি নির্বাচন কালে রোপা আখ ক্ষেত, বীজ আখ ক্ষেত ও প্রদশর্নী আখ ক্ষেত গুলিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। (৫) চারা আখের জমিতে যদি লালপচা, কালোশীষ, ঢলেপড়া, ঘাসীগুচ্ছ প্রভৃতি রোগ এবং উঁইপোকা, সাদা কীড়া, গোড়ার মাজরা পোকার আক্রমণ থাকে তবে ওই সকল জমিতে মুড়ি আখের চাষ করা যাবে না। (৬) মুড়ি আখের জন্য নির্বাচিত জমির আখ সময়মত কর্তনের ব্যবস্থা নিতে হবে। (৭) আখ কাটার ৭ দিনের মধ্যে মুড়ি আখের জন্য নির্বাচিত জমিতে চাষ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
উপযুক্ত যত্ন নিলে মুড়ি আখে নতুন আখের মতই ফলন পাওয়া সম্ভব। মুড়ি আখের ফলন বৃদ্ধির জন্য চাষি ভাইদের নিম্নলিখিত কাজগুলি অত্যন্ত যত্ন সহকারে সম্পন্ন করতে হবে।
(১) উপযুক্ত জাত নির্বাচন: উপযুক্ত জাত নির্বাচনের উপর মুড়ি আখের ফলন বহুলাংশে নির্ভর করে। মুড়ি আখের জন্য উপযুক্ত জাতগুলি হলো- ঈশ্বরদী-২১, ঈশ্বরদী-৩২, ঈশরদী-৩৩, ঈশ্বরদী-৩৪, ঈশ্বরদী-৩৫, ঈশ্বরদী-৩৬, ঈশ্বরদী-৩৭, ঈশ্বরদী-৩৮, ঈশ্বরদী-৩৯ , ঈশ্বরদী-৪০, বিএসআরআই আখ-৪৩ ও বিএসআরআই আখ ৪৪। তবে এটেল দোআঁশ মাটিতে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে ঈশ্বরদী-১৬ ও ঈশ্বরদী-২৬ জাতের প্রথম মুড়ি আখেও সন্তোষ জনক ফলন পাওয়া যায়।
(২) আখ কাটার সময়: মুড়ি আখের জন্য নির্বাচিত জমির আখ হয় নভেম্বর মাসে না হয় মধ্য জানুয়ারী হতে মধ্য মার্চ মাসের মধ্যে কর্তন করতে হবে।
(৩) মাটির সমান করে আখ কাটা: মুড়ি আখের জন্য নির্বচিত জমির আখ ধারালো কোদাল দিয়ে মাটির সমান করে কাটতে হবে। এতে মাটির নিচ থেকে এক সাথে অনেকগুলি শক্তিশালী চারা গজায়।
(৪) পাতা ও আবর্জনা পুড়ানো: মুড়ি আখের জন্য নির্বাচিত জমির আখ কাটার পর পরিত্যক্ত পাতা ও আবর্জনা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এতে অনিষ্টকারী পোকা-মাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনেকটা হ্রাস পায়।
(৫) জমি প্রস্তুত করণ: আখ কাটার ৭ দিনের মধ্যে ৪/৫টি চাষ দিয়ে ভালভাবে জমি তৈরী করতে হবে। প্রয়োজনে আখের মোথার চারপাশের মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে দিতে হবে।
(৬) ফাঁকা স্থানপূরণ: বাংলাদেশে মুড়ি আখের জমিতে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ ফাঁকা স্থান থাকে, যা আখের ফলন বৃদ্ধির প্রধান অন্তরায়। ভাল ফলনের জন্য আখ কাটার সাথে সাথে ফাঁকা স্থান পূরণ করতে হবে। যদি প্রতি মিটার জায়গায় ৩টি সতেজ ঝাড় না থাকে, তবে সেই স্থানকে ফাঁকা স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে বেড চারা অথবা পলিব্যাগ চারা অথবা পূর্বে গজানো বীজখ- বা মাথার বীজখ- দিয়ে ফাঁকা স্থান পূরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
(৭) সেচ প্রয়োগ: মুড়ি আখের জমিতে রসের অভাব হলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২ থেকে ৩টি সেচ দিলে মোথা থেকে বেশি চারা গজায় এবং ফলনও ভাল হয়।
(৮) জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ: ভাল ফলনের জন্য মুড়ি আখের জমিতে একর প্রতি ২০০ কেজি খইল বা ২ থেকে ৩ টন হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা বা ৪ টন পঁচা গোবর/ আবর্জনা সার/প্রেসমাড জৈব সার হিসেবে জমি তৈরীর সময় প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া জমি প্রস্তুত কালে রাসায়নিক সার হিসেবে একর প্রতি ৮০ কেজি ইউরিয়া, ১১০ কেজি টিএসপি, ৪৮ কেজি এমওপি প্রয়োগ করতে হবে। পরবর্তীতে মুড়ি রাখার ৯০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে জো অবস্থায় আখের সারির দুই পাশে লাঙ্গল দিয়ে ভাউর টেনে একর প্রতি ৮০ কেজি ইউরিয়া ও ৪৮ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।কারো কারো মতে প্রথম দফা সারের সাথে একর প্রতি ৯ কেজি রোটন নামক শিকড় বর্ধক হরমোন প্রয়োগ করলে মুড়ি আখের ফলন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
(৯) রোগবালাই ও পোকা মাকড় দমন: মুড়ি আখের জমিতে সাদাপাতা, ঘাসিগুচ্ছ ও কালোশীষ রোগ দেখা গেলে আক্রান্ত ঝাড় শিকড় সহ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। মুড়ি আখের জমিতে গোড়ার মাজরা ও উঁই পোকার আক্রমণ দেখা দিলে তা দমনের জন্য জমিতে জো থাকা অবস্থায় একর প্রতি ৬কেজি হারে রিজেন্ট-৩জিআর অথবা গুলি-৩জিআর কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
(১০) কার্বোফুরান-৫জি প্রয়োগ: মুড়ি আখের জমিতে মার্চ থেকে মে মাসে একর প্রতি ১৬ কেজি কার্বোফুরান- ৫ জি প্রয়োগ করলে আগাম মাজরা ও ডগার মাজরা পোকার আক্রমণ কম হয় এবং আখের ফলন বেশ বৃদ্ধি পায়।
(১১)অন্যান্য পরিচর্যা: সময় মতো আগাছা দমন, নাবি কুশি ব্যবস্থাপনা, আখের গোড়ায় মাটি দেয়া ও আখ বাঁধার কাজগুলো সময় মতো সম্পাদন করতে হবে।
ফলন: উপযুক্ত কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সঠিক যতœ নিলে বাংলাদেশে মুড়ি আখে একর প্রতি ২০ থেকে ২৫ টন ফলন পাওয়া সম্ভব
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম