Site icon

পরিবেশ বান্ধব উপকারীএক উদ্ভিদ কেনাফ ঃ জেনে নিন আদ্যোপান্ত

 

মো: ছাব্বির হোসেন: কেনাফ Malvaceae পরিবারের একটি আঁশ উৎপাদনকারী ফসল উদ্ভিদ। উদ্ভিদতাত্ত্বিক দিক দিয়ে কেনাফ তুলা ও ঢেড়সের নিকট সম্পর্কযুক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Hibiscus cannabinus L. কেনাফের আদি বাসস্থান নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। তবে, অনেকের মতে বহুবিধ গুনসম্পন্ন  এই ফসল উদ্ভিদটির উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা, যেখানে কয়েক হাজার বছর থেকে খাদ্য ও আঁশের জন্য কেনাফের আবাদ হয়ে আসছে। ভারত, বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং আফ্রিকা ও দক্ষিণ ইউরোপের কিছু অঞ্চলে কেনাফের আবাদ হয়ে থাকে। তবে, কেনাফ উৎপাদনে ভারত ও চীনের স্থান শীর্ষে। কেনাফ একটি পরিবেশ বান্ধব ফসল। গাছ ১.৫-৬.০ মিটার লম্বা হয়। কান্ড ১-২ সেন্টিমিটার ব্যাসের শাখাবিহীন কিংবা শাখাযুক্ত। পাতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা, লোবযুক্ত। ফুল সাদা, হলুদ বা পার্পেল বর্নের। ফল এক ধরণের ক্যাপসুল যাতে কয়েকটি বীজ থাকে। কেনাফ থেকে দুই ধরণের আঁশ পাওয়া যায়। বাকল থেকে স্থূল আঁশ বা বাস্ট ফাইবার এবং কাষ্টল অংশ বা জাইলেম থেকে সূক্ষ্ম আঁশ বা কোর ফাইবার। গাছের শতকরা ৪০ ভাগ বাস্ট এবং ৬০ ভাগ কোর ফাইবার। কেনাফের আঁশ স্বাস্থ্য বান্ধব ও প্রাকৃতিকভাবে পচনশীল। কাগজ শিল্পের পাল্প তৈরির জন্য সমুদয় কান্ড ব্যবহার করা হয়। এক কথায়  আঁশ, উন্নত মানের কাগজ তৈরি ছাড়াও কেনাফের রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার। তাই এই অর্থকরী ফসলটি সারা বিশ্বে মানুষের নজর কেড়েছে।

আমাদের প্রিয় আবাসস্থল পৃথিবী নামক গ্রহ। যার আনুমানিক বয়স ৪.৫ বিলিয়ন বা প্রায়  সাড়ে ৪০০ কোটি বছর। আমাদের চারপাশে এমন কিছুর অস্তিত্ব নেই যার সাথে পৃথিবীর এই বয়সের বিশালতার তুলনা করা চলে। সময়ের মাপকাঠিতে এই বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে আসা সত্ত্বেও পৃথিবীর সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল আমরা সবাই কামনা করি। কারণ এর  ভালোমন্দের উপর আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা অস্তিত্ব নির্ভরশীল। কিন্তু পৃথিবীর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যেখানে বসবাস করে সেই শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ক্রমবর্ধমান হারে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে এ গ্রহের অবস্থা আজ মোটেই ভালো নেই, এ কথা সবার জানা। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক  CO2  এর নির্গমন ঘটে থাকে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে। এ বিষয়ে বিশ্বের পরিবেশ প্রেমীরা সদা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। সমাধান খুঁজতে পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ রয়েছেন নিরন্তর গবেষণায়  সচেষ্ট। কেনাফের রয়েছে বায়ুমন্ডল থেকে বিপুল পরিমাণে কার্বন শোষণের ক্ষমতা। যা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনাগত ভবিষ্যতের অনেক খারাপ আশংকার মাঝে খানিকটা স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে পরিবেশের বৈরি আচরণের শিকার পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষের জন্য।

কেনাফের উপকারিতাঃ

পরিবেশ সংরক্ষণে:

কেনাফ একটি বৃক্ষের তুলনায় ৩-৮ গুন বেশি CO2 শোষণ করে। সাধারণভাবে ১ একর জমিতে জন্মানো কেনাফ স্বাভাবিক অবস্থায়  প্রতি মৌসুমে বায়ুমন্ডল থেকে ১০ টন CO2 শোষণ করে  যা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় ২০ টন পর্যন্ত হয়ে  থাকে।
কেনাফের ১ টন শুষ্ক পদার্থ উৎপাদনের জন্য প্রায় ১.৫ টন CO2 প্রয়োজন হয়।
সারা বছরে ২০ টি জীবাশ্ম জ্বালানী চালিত গাড়ি থেকে কম-বেশি ৩০-৪০ টন  CO2 নির্গত হয়, যা ১ হেক্টর জমিতে এক মৌসুমে জন্মানো কেনাফ শোষণ করে থাকে।
কেনাফ জন্মাতে তেমন কোন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। তাই কেনাফ       পরিবেশ বান্ধব ফসল, যা ইকো-সিস্টেমের জন্য উপকারী।
হাইড্রোকার্বন জনিত মাটি দূষণ প্রতিকারের জন্য কেনাফ কোর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কেনাফ মাটি থেকে হেভী মেটাল শোষণ করে বলে ধারণা করা হয়।
কেনাফে লিগনিন কম থাকায় বহুল ব্যবহৃত উড পাল্পের তুলনায় কেনাফ পাল্প তৈরিতে ২০% কম শক্তি খরচ হয়। অপরদিকে কাগজ শিল্পে উড পাল্পের বিকল্প হিসেবে কেনাফ পাল্প ব্যবহারের ফলে বনজ সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব হয়।
কেনাফ ফাইবার থেকে উৎপাদিত সিনথেটিক পন্য রিসাইকেল করা যায়।
কেনাফ থেকে প্রি বোর্ড তৈরি হয় যা গাড়ির ইন্টেরিয়র তৈরির বেইজ ম্যাটেরিয়াল বা কাঁচামাল। কেনাফ থেকে তৈরি প্রি বোর্ড পরিবেশ বান্ধব।
কৃষি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে:
কেনাফের রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার। অনুর্বর প্রান্তিক ভূমিতেও কেনাফ জন্মানো যায়। কেনাফ থেকে উৎপন্ন নানাবিধ পন্যের চাহিদা বিশ্বজুড়ে। সুতরাং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কৃষক ভাইয়েরা কেনাফ চাষ করে অধিক মুনাফা লাভ করতে পারেন।
কেনাফ গাছ দ্রুত বর্ধনশীল এবং কম-বেশি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। এ গাছের মূল মাটির তুলনামূলক গভীর অঞ্চল থেকে খাদ্য আহরণ করতে পারে। তাই উর্বর মাটি বাদ দিলে মোটামুটি অনুর্বর মাটিতেও কেনাফ আবাদ করা যায়। অনেকটা কম যত্নে কেনাফ  সন্তোষজনক ফলন দিয়ে থাকে।
কেনাফ থেকে পাওয়া যায় আঁশ ও আঁশজাত সামগ্রী। এর বীজ থেকে উৎপাদিত হয় মানসম্পন্ন     ভোজ্য তেল। কেনাফ বীজে মোট ওজনের ২০.৪% তেল থাকে যা তুলা বীজে বিদ্যমান তেলের সমান। কেনাফ পাতা প্রোটিন সমৃদ্ধ যা মানুষ ও প্রানির খাদ্য। কেনাফ কাগজ শিল্প, নির্মান শিল্প, প্রসাধনী সামগ্রী তৈরির কাঁচামালের যোগান দিয়ে থাকে। এছাড়া কেনাফ থেকে বায়োফুয়েল ও জৈব সার পাওয়া যায়।
কেনাফ চাষীগণ Kyoto protocol এর আওতায় বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশসমূহের  কাছে  কার্বন বিক্রি (carbon credit) করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করতে পারেন।
কেনাফের  মাধ্যমে মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণ বায়োমাস যোগ হওয়ায় দেশের অবক্ষয়িত ভূমির (degraded land) উন্নয়নের লক্ষ্যে এর আবাদ করা যেতে পারে।

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Exit mobile version