অধ্যাপক ড. সালাম
আবহমান কাল থেকে এই উপমহাদেশের তথা বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন ধরনের ফলের আচার তৈরী করে আসছে। আচারকে মানুষ এতই পছন্দ করে যে এর নাম নিতেই ছেলে বুড়ো সবার জিভে পানি এসে যায়। আমরা খাবারের স্বাদ বাড়াতে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের কাঁচা পাকা ফলের আচার করে ভাত বা খিচুড়ীর সাথে মজা করে খেয়ে থাকি। বিশেষত ঋতু ভেদে যখন বিভিন্ন ফলের প্রাচুর্য্য ঘটে তখন বিভিন্ন ফলের আচার, জ্যাম, জেলী ও চাটনী তৈরী করে তা সংরক্ষন করে সারা বৎসর খাওয়া বাঙ্গালী জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন কোম্পানী এখন বানিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের ফলের আচার তৈরী করে বাজারজাত করছে। তবে আমাদের দেশে মাছের আচারের প্রচলন তেমন একটা নেই বললেই চলে। ২০০৯ সালে ময়মনসিংহের পাঙ্গাস চাষিরা যখন মাছের দাম না পেয়ে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন তখন আমি চাষিদের রক্ষার জন্য কিছূ একটা করার চিন্ত করতে থাকি। মাথায় অনেক দিন থেকেই চাষিদের রক্ষার জন্য নতুন কিছূ করার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমনি এক সময় আমার গবেষণার পুকুরে প্রচুর ছোট ছোট বেলে মাছ পাই। এত ছোট মাছ দিয়ে কি করা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরীক্ষামূলক ভাবে ঐ ছোট বেলে মাছ দিয়ে আচার জাতীয় কিছূ একটা করার সিদ্ধান্ত নেই।
পারিবারিক সহযোগিতা কেমন ছিলো?
অধ্যাপক ড. সালাম
প্রথমে স্ত্রী ও দুই মেয়ে এই কাজকে পাগলামী বলে ভৎসনা করে । তারপরও তারা খুব আগ্রহ সহকারে আমাকে কাজে সাহায্য করতে থাকে। বিশেষ করে ছোট মেয়ে চয়নিকা সবচেয়ে বেশী আগ্রহ ও কৌতুকোচ্ছলে তাকে সাহায্য করে। এই আচার তৈরীতে আমি ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতা এবং ইন্টারনেটের সাহায্য নেইূ। সত্যি সত্যি আচারটা যখন তৈরী হলো তখন পরিবারের সবাই তা খুব পছন্দ করলো। তবে তাদের কথা হল এই আচার যদি পাঙ্গাস, বোয়াল, বাইম বা শোল-গজার মাছ দিয়ে করা হত তবে খুব মজা হত। তাদের কথা মত এক শুক্রবারে ৫ কেজি পাংগাস মাছ কিনে এনে শুরু করলাম পাঙ্গাস মাছের আচার তৈরীর কাজ। এবার পরিবারের কেউ আমার এই আচার তৈরিকে পাগলামী বলেনি বরং সবাই সহযোগিতা করেছে। মাছ কাটা কাটি থেকে শুরু করে মসলা মাখিয়ে রাখা এবং আচার তৈরী সম্পন্ন হতে প্রায় সারা দিন লেগে যায়। সবার অনেক পরিশ্রম হলেও আচারের মজা পেয়ে সব কষ্টই সবাই ভুলে যায়। পরিবারের সবাই এক বাক্যে পাঙ্গাস মাছের আচারকে মজাদার ও অতুলনীয় বলে অভিহিত করে।
আচারের সাথে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা যদি শেয়ার করতেন?
অধ্যাপক ড. সালাম
আচারের অন্যান্য মানুষের মতামত নেওয়ার জন্য প্যানেল টেষ্টের চিšতা করলাম। এমন সময় ঢাকা থেকে কিছু সংখ্যক মেহমান আমার বাসায় এলে তাদেরকে খেতে দিয়ে তাদের মতামত জানতে চাইলাম। তারা সবাই আচার খেয়ে উচ্ছ্বাশিত প্রশংসা করেন এবং ১০০ তে ১০০ নম্বর প্রদান করেন। এরপর আমি বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তার মন্ডল মহোদয়কে আচারটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য বলি। উপাচার্য মহোদয় এবং তার পরিবার এক শুক্রবারে খাওয়ার টেবিল থেকেই ফোন করে আচারের খুব প্রশংসা করেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক মন্ডল নবম সংসদে কৃষির উপর আলোচনা করতে গিয়ে পাঙ্গাস মাছের আচারকে বিশ^বিদ্যালয়ের এক নব উদ্ভাবন বলে অভিহিত করেন। এরপর তিনি তার কিছু সহকর্মীকে আচারটা টেষ্টের জন্য দেন। তারা সবাই এটাকে এক বাক্যে আচারটিকে খুবই উপাদেয় বলেন অভিহিত করেন। এরপর আমি ময়মনসিংহের স্বর্ণলতা মৎস্য খামারের সাহায্যে আচারটিকে ময়মনসিংহ শহরের এক মেলায় প্রদর্শনির ব্যবস্থা করি এবং সেখান থেকেও উৎসাহ ব্যাঞ্জক ফলাফল পাই। পরবর্তীতে একোয়াকালচার বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত মৎস্যচাষীদের সমাবেশ শেষে দুপুরের খাবারের সাথে পাঙ্গাস মাছের আচার পরিবেশন করেও ভাল, মজাদার ও টেষ্টি ইত্যাদি বিশেষণে আচারটি বিশেষায়িত হয়।
পাঙ্গাস মাছের আচার ছাড়াও অন্য কোন আচারের রেসিপি চেষ্টা করেছেন কি?
অধ্যাপক ড. সালাম
এরপর আমি হাওড়ের বোয়াল ও গুচি বাইম মাছ দিয়েও আচার তৈরী করে ভাল ফল পাই। কাটা যুক্ত ছোট মাছের আচার কিছু দিন ফ্রিজে রেখে দিলে ভিনেগারের জন্য কাটাগুলি নরম হয় ফলে কাটাসহ আচার খাওয়া যায়। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকার রাস্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মর্জিনা বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় সফরে এলে তাকেও দুপুরের খাবারের সাথে পাঙ্গাস মাছের আচার পরিবেশন করা হয়। যদিও তার সঙ্গী গন তাকে ঝাল ও কাঁটা যুক্ত খাবার পরিবেশন করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি পাঙ্গাস মাছের আচার খেয়ে এতই মজা পান যে পর পর তিনবার এই আচার নেন, শেষে নিজেই আচারের কৌটা থেকে ঢেলে আচার খান এবং বলেন তুমি এই আচার তৈরি করে আমেরিকায় রফতানি কর না কেন? এরপর আমি পাঙ্গাসের চাটনীও তৈরী করি এবং প্যানেল টেষ্টে সেটাও ভাল এবং টেষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়। মাছের আচার ও চাটনী তৈরির পর আমি ফুলকপি ও করোল্লার আচারও তৈরি করি যা খুবই মজাদার ও সুস্বাদু ছিল ।
পাংগাস মাছের আচার তৈরীর উপকরন সম্পর্কে যদি বলতেন?
অধ্যাপক ড. সালাম
পাংগাস মাছের আচার তৈরীতে প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হলো..
১. কাটা ছাড়া পাংগাস মাছের ছোট ছোট টুকরা এক কেজি
২. ৫-৬ চা চামচ শুকনা মরিচ গুড়া
৩. ২ চা চামচ হলুদ গুড়া
৪. সরিষার তেল ৪০০ মি.লি. লিটার
৫. ২ চা চামচ সরিষা
৬. ২ চা চামচ মেথি
৭. ২-২.৫ কাপ পিয়াজ কুচি
৮. ৪ চা চামচ আদা বাটা ও ১/২ কাপ আদা কুচি
৯. ৪ চা চামচ রশুন বাটা ও ১/২ কাপ রশুন কুচি
১০. ৪-৫টা কাচা মরিচ ফালি ও
১১. এক থেকে দেড় কাপ ভিনেগার
মাছের আচার তৈরীর পদ্ধতিতে যদি জানাতেন?
অধ্যাপক ড. সালাম
প্রথমেই আচার তৈরীর জন্য তাজা পাংগাস মাছ নিয়ে কাঁটা ফেলে এক সেন্টিমিটার আকারের ছোট ছোট টুকরা করে মাছ কাটতে হবে। মাছ কাটা হলে ধুয়ে পানি ঝড়িয়ে ১ কেজি মাছের মধ্যে ১ চামচ হলুদ গুড়ো, ২ চামচ মরিচ গুড়ো, পরিমান মত লবন মিশিয়ে দেড় থেকে ২ ঘন্টা রেখে দিতে হবে। এরপর মাছ গুলিকে সসপেন বা কড়াইতে অল্প সরিষার তেলে ভাঁজতে হবে। খুব কড়া করে ভাঁজার প্রয়োজন নেই। এবার কড়াইতে ২ কাপ পরিমান সরিষার তেল নিয়ে গরম করে তাতে ২ চা চামচ সরিষা দিয়ে না ফোটা পর্যন্ত নাড়াতে হবে। পরবর্তীতে ২ চা চামচ মেথি দিয়ে অল্প সময় নাড়ার পর পিয়াজ কুচি ভেজে লাল করতে হবে। এবার ৪-৫ চা চামচ করে আদা বাটা, রশুন বাটা ও ৪ চা চামচ শুকনা মরিচ বাটা এবং ৪-৫টা কাচা মরিচ ফালি দিয়ে কড়া করে ভাঁজতে হবে। মসলা ভাজার শেষ পর্যায়ে আধা কাপ করে আদা ও রসুন কুচি দিয়ে আরও কিছুক্ষন ভাজতে হবে। মসলাগুলি কড়া ভাজা হলে ভাজা মাছগুলি তাতে ঢেলে দিয়ে ১৫-২০ মিনিট অল্প আচে নাড়তে হবে। প্রয়োজন হলে আরও তেল দিতে হবে যাতে মাছের টুকরাগুলি তেলের নীচে ডুবে থাকে। এবার চুলা বন্ধ করে লবন চেখে নামাতে হবে । এরপর এক থেকে দেড় কাপ ভিনেগার দিয়ে নেড়ে চেড়ে রেখে দিতে হবে। ঠান্ডা হলে কাচের বয়ামে ভরে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কৌটার ভিতর মাছ ভরার পর মাছের উপর তেল ভাসে।
কতদিন সংরক্ষণ করা যাবে?
অধ্যাপক ড. সালাম
এটাকে ফ্রিজে রেখে ৬ মাস পর্যšত খাওয়া যায়।
আচার কিভাবে খেতে পারি?
অধ্যাপক ড. সালাম
পাংগাস মাছের এই আচার পোলাও, খিচুড়ীসহ আলু ভর্তা, ডাল ও ভাতের সাথে খুব মজা করে খাওয়া যায়। আমার মেয়েরা সকালে পরাটা দিয়ে এই আচার খুব মজা করে খায়। তাছাড়া বিকালের না¯তা হিসাবে মুড়ির সাথে মাখিয়েও মজা করে এই আচার খাওয়া যায়।
ভোক্তাদের মাঝে জনপ্রিয়তা করতে পারলে ভবিষ্য কেমন হবে?
অধ্যাপক ড. সালাম
বানিজ্যিক ভিত্তিতে ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাংগাসের আচার উৎপাদন করা হলে এই অঞ্চলের পাংগাস চাষীরা সবচেয়ে বেশী উপকৃত হবে। তাছাড়া যারা পাংগাস মাছ খেতে পছন্দ করেন না তারাও এই আচার খেতে পারবেন। তাছাড়া সমুদ্র উপকূলে বা হাওর-বাওরে যখন বেশী বেশী মাছ পাওয়া যায় সেসব অঞ্চলে মাছের আচার তৈরীর কুটির শিল্প হতে পারে যা দেশে শুধু নতুন কর্মসংস্থানই করবে না উৎপাদিত আচার দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব ।