![](https://www.krishisongbad.com/wp-content/uploads/2017/04/Pangas-fish.17-300x225.jpg)
বিশেষ প্রতিবেদকঃ
অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে পাঙ্গাসের আগাম ব্রুড উৎপাদনে গ্রীনহাউজ পদ্ধতি ব্যবহার করে রেণুর পরিস্ফুটন (Hatching) এবং আগাম পোনা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এতে করে অধিক উৎপাদনের পাশাপাশি বাড়তি মুনাফা অর্জন করতে পারবে হ্যাচারী মালিক ও চাষীরা।
পাঙ্গাস মাছ বর্তমানে ব্যাপক চাষকৃত একটি মাছের প্রজাতি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নদী কেন্দ্র, চাঁদপুরে ১৯৯০ সালে কৃত্রিম প্রজননে সর্ব প্রথম থাই বা সূচী পাঙ্গাসের পোনা উৎপাদন ও পরবর্তিতে পুকুরে চাষ শুরু হয়। বেসরকারী উদ্যোগে পাঙ্গাস চাষ প্রযুক্তি সারাদেশে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে এবং তা দেশের প্রাণীজ আমিষ চাহিদা পূরনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে।
পাঙ্গাস মাছ অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায় এবং দৈহিক বৃদ্ধির হার রুই জাতীয় মাছের চেয়ে বেশী হয় বলে এদের উৎপাদন অনেক বেশী যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। দেশব্যাপী প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জলাশয়ে পাঙ্গাস মাছ চাষ করা হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে অধিক উৎপাদনশীল এই মাছটি আমাদের দেশে সাধারণত শীতকালে চাষ করা হয়। শীতকালে এলাকাভেদে পরিবেশে তাপমাত্রার ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। স্থান বা সময়ভেদে তাপমাত্রা ১০-১২০সে এ নেমে আসে। এতে করে পাঙ্গাস মাছের ব্রুডের বিবিধ সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। অতিরিক্ত শীতের পীড়নে পাঙ্গাসের ব্রুড খাবার গ্রহণ বন্ধ করে অনেক সময় মারা যায়। অতিরিক্ত শীতের এ সমস্যা হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য পাঙ্গাসের আগাম ব্রুড ব্যবস্থাপনায় গ্রীণহাউজ পদ্ধতি একটি সময়োপযোগি পদক্ষেপ। বাহিরের পরিবেশের তাপমাত্রার তুলনায় গ্রীনহাউজের তাপমাত্রা প্রায় ৫০সে বেশি থাকে ফলে পুকুরকে গ্রীনহাউজে পরিণত করতে পারলে পরিবেশের তুলনায় ভিতরের তাপমাত্রা ৫০সে বেশি থাকায় মাছতথা পাঙ্গাসের ব্রুডের পরিপাকক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা যায় এবং খাদ্য গ্রহণের হার বাড়ানো যায়। মাছের পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক থাকায় খাবার গ্রহণের হার স্বাভাবিক থাকে। ফলে মাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং প্রতিকূল সময়েও (Lean Period) মাছের গোনাড পরিপুø য়য়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মৎস্য চাষী মাছের রেণু উৎপাদন শুরু করে মে মাসেএবংমাছচাষ শুরু হয় জুন-জুলাই মাসে। ফলে মাছের চাষ সময় কমে যাওয়ায় মাছচাষীরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীনহয়ে থাকেন। এ প্রেক্ষিতে আগাম পোনা উৎপাদন তথা আধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে পাঙ্গাস মাছের আগাম ব্রুড উৎপাদনের জন্য গ্রীনহাউজ ব্যবহারের ওপর বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা পরিচালনা করে আসছে।
গ্রীন হাউজ পদ্ধতি ব্যবহার করে পাঙ্গাসের আগাম ব্রুড উৎপাদন কৌশল
গ্রীনহাউজ পদ্ধতি ব্যবহার করে পাঙ্গাসের আগাম ব্রুড উৎপাদনের মাধ্যমে আগাম রেণু ও পোনা উৎপাদনের লক্ষে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র, সান্তাহার, বগুড়ায় উপকেন্দ্র গবেষণা পরিচালনা করে আসছে। সান্তাহার, বগুড়ায় পাঙ্গাস মাছের সর্বাধিক পোনা উৎপাদিত হয়। প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের পুকুর স্বচ্ছ পলিথিন (০.৪ মিমি) দ্বারা আবৃত করে গ্রীনহাউজ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। বাঁশের ফ্রেম তৈরী করে পুকুরের উপরে স্থাপন করে তার উপর দিয়ে স্বচ্ছ পলিথিন বিছিয়ে দিলে পুকুর সহজেই গ্রীনহাউজে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে পুকুরের পানির উপরিভাগ থেকে গ্রীনহাউজের ছাদ এর উচ্চতা হবে ২৫০ সেমি.। পুকুরে পানির গভীরতা ১ মিটার রাখতে হবে। পুকুর প্রস্তুতকালে ২০০-২৫০ গ্রাম/শতাংশ জিওলাইট দিয়ে পুকুরের পানি পরিশোধণ এবং ইউরিয়া, টিএসপি সার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
গ্রীনহাউজ তৈরির পর অক্টোবর মাসে পরিপক্ক পাঙ্গাস ব্রুড গ্রীনহাউজের পুকুরে মজুদ করতে হবে। খাদ্য হিসেবে ২৮% প্রটিনসমৃদ্ধ পিলেট খাবার দিনে ২ বার মাছের দেহ ওজনের ৫-৩ শতাংশ হারে প্রয়োগ করতে হবে। গ্রীনহাউজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য এর ছাদের কিছু অংশ ও দরজা খোলা রাখার ব্যবহার করতে হবে। পুকুরে প্রতিদিন ১০% হারে পানি পরিবর্তন করতে হবে। পাঙ্গাসের ব্রুড মজুদ ঘনত্ব ৯৯০টি/হেক্টর (১২ কেজি/শতাংশ) এবং পরিপক্ক ও স্বাস্থ্যবানপ পুরুষ পাঙ্গাসের ওজন ১.৫-২.০ কেজি ও স্ত্রী পাঙ্গাসের ওজন ২.৫-৩.০ কেজি হতে হবে। পুকুরে মজুদকৃত স্ত্রী ও পুরুষের অনুপাত ২:১ হবে হবে।
গবেষণা পর্যবেক্ষণে গ্রীনহাউজে ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে পুরুষ মাছের পরিপক্কতা ১০০%এবং স্ত্রী মাছের পরিপক্কতা ৭০% পাওয়া গেছে। এ সময় স্ট্রিপিং পদ্ধতিতে পাঙ্গাদের ডিম নিষিক্তকরণ এবং তিলক মাটির লাল কাদার দ্রবণে নিষিক্ত ডিমের জিলাটিনাস আঠালো পদার্থ অপসাণের ৮-১০ ঘন্টার মধ্যে স্ত্রী ও পুরুষ মাছের পেটে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ডিম ও শুক্রানু সংগহ করে একত্রে মিশিয়ে নিষেক সম্পূর্ণ করা হয়। এরপর নিষিক্ত ডিমগুলোকে হ্যাচিং বোতল বা সার্কুলার ট্যাংকে ছাড়া হয়। কুসুম থলি নি:শেষ না হওয়া পর্যন্ত নপরিস্ফুটিত রেণু পোনার বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। ৭২ ঘন্টা পর কুসুম থলি নি:শেষ হওয়ার পর প্রথম খাবার হিসেবে মুরগির সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাওয়ানো হয়। হ্যাচিং বোতল বা সার্কুলার ট্যাংকে ১-২ দিন বাইরের খাবার দেওয়ার পর পোনা নার্সারী পুকুরে মজুদের ব্যবস্থা করা হয়। গ্রীনহাউজ পদ্ধতিতে পাঙ্গাস মাছের ওভুলেশন মাত্রা ৬০-৬৫% এবং হ্যাচিং মাত্রা ৭০% পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র, সান্তাহার, বগুড়া প্রথমবারের মত গ্রীনহাউজ পদ্ধতি ব্যবহার করে পাঙ্গাসের আগাম ব্রুড তৈরী করে ফেব্রুয়ারী মাসের শেষে রেণুর পরিস্ফুটন (Hatching) ঘটাতে এবং আগাম পোনা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে যা দেশের পাঙ্গাস মাছের পোনা উৎপাদনে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীরা আশা করেন।