নিতাই চন্দ্র রায়
পাট হতে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তিঃ
বাংলাদেশের কৃষক যখন পাটের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কিত, তখন বিশ্ব বাজারে প্রতিটন পাটের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ ডলার । কারণ হিসেবে বলা হয়- বিশ্বের বৃহৎ পাঁচটি মোটর গাড়ি উৎপাদক কোম্পানি তাদের বিলাসবহুল গাড়ির অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও সাজসজ্জার বড় একটি অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে পাটজাত পণ্য, যা টেকসই দৃষ্টিনন্দন ও আরামদায়ক। বিশ্বপাটের বাজার পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ন্যাচারাল ফাইবার ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’ -এর গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায় । অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছে যে, ২০১৯ সালের মধ্যে সদস্যভুক্ত সব দেশ পণ্যের মোড়কসহ বহনের জন্য সব ব্যাগ প্লাস্টিক ও কৃত্রিম আঁশজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া গত কয়েক বছর ধরে পাটকাঠি পুড়িয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে চারকোল, যা প্রিন্টারের কালিসহ ফেসওয়াস, পানির ফিল্টার, বিষ ধ্বংসকারী ওষুধ ও জীবন রক্তাকারী ওষুধসহ নানা পণ্য তৈরির কাজে ব্যবহার করার জন্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। অপরদিকে জার্মানী, পর্তুগাল, ফ্রান্সসহ বেশ কিছু দেশ ইতিমধ্যে প্রাকৃতিক তন্ত্রুর ব্যবহার বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা ও এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোও টেকসই পণ্য হিসেবে পাটের ব্যবহার বেশ বৃদ্ধি করেছে । এইচএনএম জারার মতো বড় বড় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে বহুমুখী পাটপণ্য কেনার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। এর ফলে বিশ্ব বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানিতে দেখা যাচ্ছে উধ্বগতি, যা বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক বিষয় ও সু সংবাদ।
বর্তমানে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ২৪০ প্রকার পাটপণ্য উৎপাদন করছেন। এক বছর আগেও দেশে ১৩৫ ধরণের পাটপণ্য উৎপাদিত হতো। এ হিসেবে পাটপণ্য উৎপাদনের বৈচিত্র বেড়েছে ৭৭ শতাংশ। জাতীয় পাট দিবস-২০১৮ উপলক্ষে সম্প্রতি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত ‘পাট শিল্পের উন্নয়নে পাটের বহুমুখীকরণ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। সেমিনারে বক্তরা বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৯৬ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় করে।তবে পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্যিক সৃজনশীল জ্ঞানস্বল্পতার কারণে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারের ব্যাপক সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের মোট পাটের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং কাঁচা পাটের ৯০ শতাংশ রপ্তানি করে। বাংলাদেশের পাটখাত ও দেশ-বিদেশে পাটের বাজার পুনরুজ্জীবিত করতে হলে ‘জুট পাল্প পেপার অ্যাক্ট’ ও ‘পাট আইন’ প্রণয়ন করা দরকার। পরিবেশ সচেতনতা ও সবুজ পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির পেক্ষাপটে পাটের তৈরি শপিং ও ফুড গ্রেড ব্যাগ, কম্পোজিট, জিও-টেক্সটাইল, পাল্প ও কাগজের বিশাল বাজার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
আশার কথা, বাংলাদেশের পাট থেকে উন্নতমানের ভিসকস সুতা তৈরি ও বাজারজাতের সম্ভাবনা যাচাই শুরু হয়েছে। এ লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফিনল্যাল্ডে আড়াই কেজি শুকনো পাট পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। সম্ভাবতা যাচাইয়ের ফল ইতিবাচক হলে প্রতিবছর প্রায় হাজার কোটি টাকা আমদানি সাশ্রয় হবে।সম্ভাবতা যাচাইয়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ সরকার। ২০ সপ্তাহের মধ্যে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের তিনটি প্রতিষ্ঠানের পাট থেকে ভিসকস সুতা তৈরির রাসায়নিক পরীক্ষা, গুণগতমান নির্ধারণ, বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া, কারখানায় উৎপাদনের জন্য নকশা তৈরির সম্ভাবনা যাচাইয়ের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।জানা যায়, বিশ্বব্যাপী কাঠ থেকে ভিসকস সুতা তৈরি করা হয়। এই সুতা দিয়ে তৈরি পোশাক অনেক আরামদায়ক দামও সুতিকাপড়ের চেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে দেড়গুণ বেশি। আখ থেকেও ভিসকস তৈরি হয় স্বল্প আকারে। তবে পাট থেকে বাণিজ্যিকভাবে ভিসকস তৈরি করতে পারলে তা হবে এদেশের জন্য এক বিরাট অর্জন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এককভাবে সাফল্যের দাবি করতে পারবে। বাংলাদেশের বস্ত্র উৎপাদন কারখানাগুলো বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিকটন ভিসকস আমদানি করে, যার মূল্য ৭০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা। এই ভিসকস দেশে উৎপাদন হলে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে আর আমদানি করার প্রয়োজন হবে না।জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৬৩৭ কোটি ৮২ লাখ টাকার বেশি মূল্যের ৩৩ হাজার ৭৩৭ মেট্রিক টন ভিসকস আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ সরাসরি পাট খাতের সাথে জড়িত। সরকার জুট প্যাকেজিং আ্যাক্টের মাধ্যমে ১৭টি পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় দেশে পাটের ব্যবহার ও উৎপাদন বেড়েছে। পাট চাষিরাও আগের চেয়ে ভাল দাম পাচ্ছেন।২০১৪ সালে দেশে ৬৫ লাখ বেল, ২০১৫ সালে ৭০লাখ বেল, ২০১৬ সালে ৮৫ লাখ বেল এবং ২০১৭ সালে ৯২লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়। দেশের উদ্যোক্তারা পাটপণ্যের বহুমুখীকরণে অত্যন্ত মনোযোগি ও আন্তরিক। এখাতে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে সরকার এরই মধ্যে ৬টি টেক্সটাইল কলেজ ও ১২টি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। পাটপণ্য বহুমুখীকরণের জন্য পাট-বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন। স্বল্পমূল্যে পাটের ব্যাগ উৎপাদনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। এতে দেশের মানুষকে পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে আরো উৎসাহিত করা যাবে। এব্যাপারে তত্ত্ববধায়ক সরকারে উপদেষ্টা ও পাওয়ার আ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের বক্তব্য হলো- সুপ্রাচীন কাল হতে পাটের মাধ্যমে কৃষির বাণিজ্যকরণ হচ্ছে। পাট শুধু আমাদের সোনালী অতীতই নয়, সোনালী ভবিষ্যৎও। কয়েক দশক ধরে তৈরি পোশাকখাত ও প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এখন সময় এসছে নতুন চালিকা শক্তি খুঁজে বের করার।এ ক্ষেত্রে পাটের সম্ভাবনা খুুব বেশি। মধ্যআয়ের দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য আমাদের অর্থনীতির জন্য নতুন একটি শক্তিশালী চালিকা শক্তি প্রয়োজন, যা পাটের মাধ্যমে সম্ভব।পাটপণ্য বহুমুখী করণের জন্য দেশের উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে নিজেদের তৈরি করছেন। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বেশ আশাব্যঞ্জক। পৃষ্টপোষকতা পেলে পাট হবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকা শক্তি। এ শিল্প থেকে দেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দেওয়া সম্ভব।
পাটের বহুবিধ প্রচলিত পণ্য ছাড়াও অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে জার্মানিতে রপ্তানি হচ্ছে পাট পাতা থেকে তৈরি চা। বাংলাদেশে কিছুদিন আগে এ চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাট পাতা থেকে চা উদ্ভাবন করেছেন। পাট থেকে চা তৈরির জন্য ফুল আসার আগে গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করতে হয়। পরে তা সূর্যের আলোয় শুকিয়ে গুড়া করতে হয়।এরপর মধু বা চিনি দিয়ে এ চা পান করতে হয়। পাট পাতার চা রপ্তারি পরিমাণ কম হলেও তা বাড়ানোর জন্য কারখানা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।জামালপুরের সরিষাবাড়িতে এক কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি কারখানা নির্মাণ করা হবে। এখন থেকে দেশে চা শিল্পের সাথে যুক্ত হলো পাটের পাতা থেতে তৈরি নতুন চা। এতে দেশের দু’টু খাত অর্থাৎ পাট ও চা উভয় শিল্প সমৃদ্ধ হবে এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বহু লোকের।
পাট রপ্তানিকারকদের সংগঠন জুট এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে বাংলাদেশ থেকে প্রতিমাসে ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকার পাটপণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ টি দেশের বাইরেও কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, সুদান, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ১২০টি দেশে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া বিশ্ব বাজারে ৫০০ বিলিয়ন পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। তাই পাটজাত শপিং ব্যাগের রপ্তানি ক্ষেত্রে এদেশের ভাল সুযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলে ৭০০-এর বেশি প্রতিষ্ঠান পাটজাত পণ্য তৈরির সাথে যুক্ত রয়েছে।
পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বিগত দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে সারা বিশ্বে তিনগুণ বেড়েছে। এর তুলনায় পাটজাত পণ্য উৎপাদন খুবই কম। তবু এ পণ্যগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখছে। দুনিয়াব্যাপী পাটের ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি ও আমাদের দেশের উন্নত মানের পাট এদু’টু হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশেরও সফলতা আসতে পারে।পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এর আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়লেই দেশের পাটকলগুলো সারা বছর কর্মচঞ্চল থাকতে পারে।পাটের বাজার মূল্য বাড়তে পারে এবং চাষিরাও পেতে পারে সোনালী আঁশের ন্যায্যমূল্য। এ জন্য সরকার ‘ম্যানডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট-২০১০’ বাস্তবায়ন করছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেই প্রতিবছর প্রায় ১০০ কোটি টাকার পাটের বস্তার অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।
২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বর্তমান সরকার পাট ও পাট পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য পাটের বহুমুখীকরণে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ পর্য›ত ৬৩৬ জন উদ্যোক্তা তৈরি করেছে। জেডিপিসি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তারা ২৩২ ধরনের পাটজাত পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করছে, যার মধ্যে রয়েছে ঢাকাই মসলিন, শাড়ি পাঞ্জাবি , কটি, জ্যাকেট, স্যুট, ফতুয়া, টপস অ্যান্ড স্কার্ট, প্যান্ট, গাউন, জুতা, স্যান্ডেল, ফুলদানি, বাহারি নকশা ব্যাগ, দেয়ালের চিত্রকর্ম, ভেড়া, হরিণ, কচ্ছপ, ঘোড়াসহ নানা রকম পাটের তৈরি খেলনা দ্রব্য, বেড কভার, কুশন কভার, সোফা কভার, কম্বল, পর্দা, টেবিল ম্যাট, কার্পেট, ডোর স্যাট, সতরঞ্জিসহ গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারযোগ্য নানাবিধ পণ্য। কারো কারো মতে প্রচলিত পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পাটকে ঢেউটিনও ফার্নিচার তৈরির উপযুক্ত করতে হবে। পাট থেকে পলিথিন উৎপাদিত হচ্ছে। ভিসকস তৈরির কারখানা করা হচ্ছে। এ ধরনের বড় বড় উদ্যোগ না নিলে পাট দিয়ে বিশ্ব জয় করা সম্ভব হবে না।তবে সবার আগে পাট বীজ নিয়ে ভাবতে হবে।কারণ পাট বীজের চাহিদার শতকরা ৬০থেকে ৭০ ভাগ পূরণ করা হয় ভারত থেকে আমদানি করে। সোনালী আঁশের সোনালী ভবিষ্যৎ ফিরে পেতে হলে পাট বীজ উৎপাদনে আমাদের অবশ্যই স্বনির্ভর হতে হবে।
লেখকঃ
মহাব্যবস্থাপক(কৃষি)
সেতাবগঞ্জ সুগারমিলস্ লিঃ
সেতাবগঞ্জ দিনাজপুর