পান বরোজের সাথী ফসল হতে পারে অধিক আয়ের অপার উৎস

পান বরোজের সাথী ফসল

মৃত্যুঞ্জয় রায়ঃBitle Leaf

দিনটা বেশ ভালই ছিল। শ্রাবণের আকাশটার কালচে রঙ বদলে নীল হতে শুরু করেছে। কিন্তু বরগুনা শহরের উপকণ্ঠে গৌরীচন্না ইউনিয়নের খাজুরতলা গ্রামে যখন পৌঁছলাম তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এলো। অগত্যা গোমস্তÍা বাড়ির দাওয়ায় আশ্রয় নিলাম। বাড়ির কর্তা স্বপন গোমস্তা একজন ‘বারুই’। ভালো বাংলায় বারুইদের বলা হয় ‘বারুজীবি’। অর্থাৎ তারা বরোজের উপর জীবিকা নির্বাহ করে। পানগাছ রোদে হয়না, পানের জন্য চাই ছায়া জায়গা। তাই পানকে এক ধরনের ছায়াঘরের মধ্যে চাষ করা হয়। এই ছায়াঘরকে বলা হয় বরোজ। স্বপন গোমস্তা বললেন, ‘খাজুরতলা গ্রামে ঝোট বড় প্রায় পঞ্চাশটি পানের বরোজ আছে। তবে আগে শুধু বারুই সম্প্রদায়ের লোকেরাই পানের বরোজ করতো। এখর শুধু তারাই নয়, অন্যান্য আরো অনেক সম্প্রদায় ও গোত্রের লোকেরা এখন পান চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। বৃষ্টি থামতেই স্বপন বাবুর পান বরোজে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম, পান বরোজের বাইরে চারপাশে
মোটা মোটা মানকচু গাছের সারি। সেই সাথে বরোজের মাটি তোলা প্রতিটি উঁচু বেডের দ ুপ্রান্তে একটি করে আদা গাছ। ফাঁকে ফাঁকে মরিচ গাছ। সে মরিচের রঙ কালো, উর্ধমুখী আর ঝালও বেশ। এ মরিচকে তারা বলেন উবধা মরিচ। কবে বরোজের বাইরে বেড়ার কোল ঘেঁষে যেসব মানকচুর গাছ লাগানো হয়েছে সেগুলো বেশ বড় হয়ে উঠেছে। যেহেতু পান বরোজ বহুবর্ষী, তাই মানকচুর গাছও ধীরে ধীরে সময় নিয়ে ইচ্ছে মতো বাড়তে থাকে। স্বপন বাবু জানালেন, গেল বছর কোনো কোনো মানকচুর ওজন ২০ কেজি পর্যন্ত হয়েছিল। কেজি কম করে হলেও ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়। বরোজ তৈরির সময় ফাল্গুণ-চৈত্র মাসে মানকচুর মোথা লাগিয়ে এক বছর পর থেকে তোলা শুরু করা যায়। দুই-তিন হাত পর পর মুঠো হাত পরিমাণ চোঙার মত গর্ত করে তার ভেতরে ছাই ভরে মোথা লাগালে কচুর বাড়-বাড়তি ভাল হয়। দশ শতক জমির পান বরোজের চার ধার থেকে ভাল কচু হলে ৭০ থেকে ৭৫টি মানকচু পাওয়া যায় যার বাজার মূল্য প্রায় ২০ হাজার টাকা। তবে বিক্রির চেয়ে খাওয়ার কাজই বেশি চলে। তিনি বললেন, পান বরোজের সাথী ফসল হিসেবে মানকচু চাষ মনে হয় লাভজনক। কোন যতœ নেয়া বা সার দেয়ারও দরকার হয় না। মানকচুর কোনো পোকাও নেই।

স্বপন বাবুর পান বরোজটা বেশ পরিচ্ছন্ন। ভেতরের মাটি আগাছাশূণ্য, ছাউনির উপর দিয়ে লতিয়ে গেছে বেশ কিছু লতানো সবজি গাছ। চাল কুমড়ো গাছে বেশ কয়েকটা চাল কুমড়ো ধরেছে। পুঁইশাকের লতাতেও বেশ হৃষ্টপুষ্ট সবুজ পাতা। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কি কি ফসল হয় পানের সাথে? বললেন, কখনো হলুদ চাষ করে দেখা হয়নি। তবে গ্রামের কেউ কেউ তা করে। আদা যা হয় তাতে বছরে খাওয়ার জন্য কোন আদা কিনতে হয় না। মরিচও কিনতে হয় না। যখন দরকার হয় বরোজের গাছ থেকে তুলে নেয়া হয়। ছাউনির উপর দিয়ে আরও কিছু লতানো সবজির চাষ করা যায়। বিশেষ করে করলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, বরবটি ইত্যাদি চাষ করা যায়। এসব সবজি চাষের জন্য বরোজের বাইরে মাদা করা হয়। বেড়ার কোল দিয়ে সেসব মাদা থাকে। কেউ কেউ মিষ্টি কুমড়া গাছও লাগায়। বরোজের খুঁটি হিসেবে কেউ কেউ সজিনা গাছ লাগায়। তাতে সজিনা ধরে। দু চারটা পেঁপে গাছও লাগানো হয়। তবে তার অভিজ্ঞতা হল, বরোজের বাইরে মানকচু ও মরিচ ভালো হয়, ভেতরে ভাল হয় আদা। চালা বা ছাউনির উপরে সবজি করলে পান গাছের ক্ষতি হয়, বরোজেরও আয়ু কমে যায়। বরোজের বাইরে চারদিকে এক সারি সুপারি গাছ লাগানো যেতে পারে। ওলকচু, মেটে আলু, গাছ আলু বা পেস্তা আলুর চাষও করা যায়। মেটে আলু, গাছ আলু, চই ইত্যাদি ফসল সুপারি গাছ বড় হলে সেসব গাছে লতিয়ে দেয়া যায়। পার্বত্য এলাকার পান বরোজে সাথী ফসল হিসেবে বিলাতি ধনিয়া চাষ করা যায়। পান বরোজে বিলতি ধনিয়ার চাষ বেশ লাভজনক। পান ও বিলতি ধনিয়া উভয়ের জন্য ছায়া লাগে, বিলাতি ধনিয়ার জন্যও পানের মত বরোজ তৈরি করতে হয়। কাজেই একই বরোজের মধ্যে পানের পাশপাশি বিলাতি ধনিয়ার গাছ লাগানো যেতে পারে। পার্বত্য এলাকায় সাধারণত: সমতলের মত বরোজের চেয়ে সুপারি বাগিচায় পান চাষ বেশি করা হয়। সেসব পানগাছ সুপারি গাছ বেয়ে ওঠে। এজন্য সেসব পানকে বলা হয় গাছ পান। সিলেট, মৌলভীবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে গাছ পানের চাষ প্রচলিত আছে। সেরূপ পান বাগিচায় গাছ পানের পাশাপাশি গোল মরিচের চাষও করা যায় ও সুপারি গাছে গোল মরিচের গাছ লতিয়ে দেয়া যায়। ভারতে বিভিন্ন পান বরোজে আন্ত:ফসল চাষে পান গাছের বৃদ্ধি ভাল হয় ও বাড়তি লাভ হয় বলে এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে। পান বরোজের মোট জমির সর্ব্বোচ্চ ১৫ শতাংশ জমিতে আন্ত:ফসল বা সাথী ফসল চাষের সুপারিশ করা হয়েছে।

পান বরোজের মধ্যে ছায়া থাকে। সেজন্য পানের সাথে অন্য কোন ফসল চাষ করা বেশ কঠিন। কেননা, বেশিরভাগ ফসলের জন্য চাই রোদ। ছায়াতে জন্মে এমন ফসল ছাড়া অন্য কিছু বরোজে লাগানো যায় না। তা ছাড়া পান বরোজে বৃষ্টির সময় প্রচুর মাটি ধুয়ে জৈব পদার্থ ও পুষ্টি উপাদান চলে যায়। ঠিকমতো সার না দিলে পানগাছের বৃদ্ধি ভাল হয় না। সেখানে অন্য ফসল লাগালে সেসব ফসল পানগাছের খাদ্যে ভাগ বসায়। সেজন্য পান বরোজের সাথী ফসলের জন্য অতিরিক্ত জৈব সার দিতে হয়, প্রয়োজনে কিছু রাসায়নিক সারও দিতে হয়। এসব ফসল পরিচর্যার জন্য কিছু বাড়তি শ্রমও দিতে হয়। তারপরও বরোজের ভেতরে, চারপাশে ও ছাউনিতে স্বপন গোমস্তার মত বেশ কিছু সাথী ফসলের চাষ করে পান চাষিরা বাড়তি লাভ করতে পারেন। তার মতে পান বরোজের সাথী ফসল হিসেবে মান কচু, দুধ কচু, আদা, মরিচ প্রভৃতি ফসলের চাষ বেশি লাভজনক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *