Site icon

পাহাড়ে মিশ্র ফলজ বাগানের সাথে বাণিজ্যিকভাবে মসলা চাষের সম্ভাবনা

 

মাসিংনু মার্মা
আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষি ভিত্তিক উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে। ২০১০ সালে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এর তথ্যানুযায়ী জাতীয় জিডিপির শতকরা ৪০% আসে কৃষি খাত থেকে এবং দেশের প্রায় শতকরা ৭৫% লোক পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কৃষি কাজে বা কৃষিভিত্তিক উৎপাদন আয়ের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে বাড়ছে মানুষ, কিন্তু আবাদযোগ্য জমি সে তুলনায় বাড়ছে না। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭.৫ কোটি আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে আশংকাজনক ভাবে বেকারের সংখ্যাও কিন্তু বাড়ছে। গ্রামে শহরে সকল স্থানেই আজ বেকার সমস্যায় আক্রান্ত। কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও চাষাবাদের প্রতি মনোযোগী হলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা সম্ভব। আমাদের বিপুল পরিমান পতিত অনাবাদী জমি গুলোকেও অনায়াসে চাষাবাদের আওতায় যদি ব্যবহার করা যায়। এমনকি বসত বাড়ীর আঙ্গিনায় খালি জায়গা গুলোতেও শস্য বিন্যাস অনুযায়ী উন্নত মানের শস্যাদি চাষ করা সম্ভব। এজন্য গ্রামের বেকার যুবক যুবতীরা ও একটু চেষ্টা করলেই কৃষি কাজের মাধ্যমে বেকারত্বের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন থেকে নিজেকে, পরিবারকে এমনকি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও অংশীদার হওয়া সম্ভব।

পাহাড়ে আদি চাষাবাদ এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট:
পাহাড়েও বর্তমানে দিন দিন যে হারে বাড়ছে মানুষ সে তুলনায় পাহাড় তো আর বাড়ছে না। সুতরাং এখানেও চাষাবাদ যোগ্য ভূমি দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদি চাষাবাদ ছিল জুম নির্ভর। পাহাড় পোড়ানোর মাধ্যমে পাহাড়েই চাষাবাদ হতো। তখনকার সময়ে জুম চাষের জন্য একেক বছর একেক পাহাড়ে জুম চাষ করতো। সেটা ছিল অস্থায়ী ভাবে। আবার সমতল ভূমিও কিছু ছিল। কিন্তু বর্তমান জনসংখ্যার তুলনায় আবাদ যোগ্য পাহাড়ের পরিমান অত্যন্ত কম। ছোট বেলায় দাদা-দাদী, নানা-নানীদের পাহাড়ে জুম চাষ করা দেখেছি। তখন জনসংখ্যা ও কম ছিল। যার কারণে স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে জুম চাষ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে এখন আর স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে জুম ক্রমেই কমে আসছে। অন্যদিকে বর্তমানে লক্ষনীয় যে, পাহাড়ের ঢালে শতকরা ৮০% ভাগ সমতল জমিতে বিভিন্ন তামাক কোম্পানীর প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা ক্ষতিকর তামাক চাষে ঝুকে পড়ছে। যে চাষাবাদ করলে পরবর্তীতে অর্থনৈতিক, পরিবেশ ও চাষীদের স্বাস্থ্যগত স্থায়ীভাবে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মিশ্র ফলজ বাগানের সাথে মসলা জাতীয় ফসলের চাষাবাদের সম্ভাবনা:

পার্বত্যাঞ্চলে বর্তমানে আশঙ্কা জনকভাবে বাড়ছে মানুষ। কিন্তু পাহাড়তো আর বাড়ছে না। আবাদযোগ্য পাহাড় এর পরিমাণও কমে আসছে। এহেন পরিস্থিতিতে এ এলাকার মানুষ গুলো কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় আধুনিক চাষাবাদের মাধ্যমে সারা বছর কিভাবে একই জমি থেকে কিভাবে আয় করা সম্ভব তা খুজে বের করতে হবে। যদিও এ ধরণের কলাকৌশল বা চাষাবাদের উপায় নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে আমাদের অন্তত পক্ষে আরো ১৫ বছর আগে থেকেই পরিকল্পনা করার প্রয়োজন ছিল। তবুও কর্মহীন মানুষের জন্য পাহাড়ে পরিকল্পিতভাবে মিশ্র ফলজ বাগানের সাথে মসলা জাতীয় ফসলের চাষাবাদ হতে পারে মুক্তির সোপান। পাহাড়ে বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় যে, রাংগুয়াই আম ও আনারস চাষের ব্যাপকতা বিশেষ করে বান্দরবান জেলাতে একটু বেশি। এর কারণ হচ্ছে এই জাতের আম বীজ রোপনের মাধ্যমে ৪-৫ বছরের মধ্যে ফলন পাওয়া যায় এবং ক্ষরা সহিষ্ণু জাত আর এই আম গুলো স্থানীয় জাতের আম পাকা শেষ হওয়ার পরেই রাংগুয়াই আম পাকতে শুরু করে। তখন বাজারে আমের চাহিদা থাকে বেশি। এখন মালিকানাধীন এই আম বাগান গুলি কোন পরিকল্পনা ছাড়াই চাষাবাদ শুরু করেছেন। বাগান গুলোতে দেখা যায় যে, জায়গার তুলনায় আম গাছের সংখ্যা বেশি লাগানো হয়েছে। এর ফলে গাছ লাগানোর ৬-৭ বছর পরে বাগান ঘন এবং ঝোপালো হয়ে যায়। উক্ত অবস্থায় গাছে আর ফলন বেশি পাওয়া যায় না। কিছু বাগানে পরবর্তীতে ঐ ঘন হয়ে যাওয়া আম গাছ কেটে ফেলতেও দেখা গেছে। তাই বাগান শুরু করার আগেই পরিকল্পিত ভাবে সুনির্দিষ্ট পরিমাপে ২র্৫২র্৫ দুরত্বে যদি গাছ লাগানো হয় তাহলে এক সাথে একই বাগানে বিভিন্ন জাতের ফলজ গাছ ও সমন্বিত ভাবে মসলা জাতীয় ফসল ও চাষাবাদ করা সম্ভব।

পাহাড়ে ধাপ পদ্ধতিতে যে সব ফসল চাষ করা সম্ভব
প্রথমত: গাছের দূরত্বের মাঝখানে ধাপ থাকলে যে কোন ফসল চাষ করা সম্ভব হবে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ২র্৫২র্৫ ফুট দূরত্বে ফল গাছ রোপন করলে ফলন বেশি হয় এবং বাগানের গাছ গুলো দ্রুত ঝোপালো হবে না। এখন পাহাড়ে ধাপ কাটলে মাটির ক্ষয় হবে। আবার মাটির ক্ষয়রোধ করার জন্য আনারস চাষ অথবা এলাচি জাতীয় মসল্লা চাষ করা যেতে পারে। বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি এবং গ্রীষ্মকালে আমাদের দেশে যেহেতু সমতল জমিতে টমেটো চাষ সম্ভব হয় না সেক্ষেত্রে পলি ছাউনি ব্যবহার করে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করা যেতে পারে এবং সারি থেকে সারির দূরত্বে মাঝখানে অন্তত পক্ষে ৪-৫ বছর পেঁপের চাষও করা যেতে পারে। আবার বাউকুল বা আপেল কুল অথবা ডালিম ফল চাষও করা যেতে পারে। যেহেতু কুল গাছ গুলো কুল সংগ্রহের পর ডাল ছাটাই করতে হয়। চা আমাদের অর্থকরী ফসল। সেহেতু চা জাতীয় গাছ কফি, গাছের ছায়ায়ও চাষ করা যায়। সারি থেকে সারির দূরত্বে মাঝখানে ৮ ফুট দূরত্বে লম্বালম্বি ভাবে লাইন করেও কফি চাষ সম্ভব। বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকার আবহাওয়া ও জলবায়ু অনুকুল থাকায় এখানে বাণিজ্যিক ভাবে কফি চাষ করা সম্ভব। কফি মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ বিধায় এটি সহজেই মিশ্র ফসল হিসেবে যেকোন ফলজ বাগানের সঙ্গেও সেচ বিহীন অবস্থায় চাষ করা সম্ভব। আর কফি চাষে তেমন কোন রোগ বালাই এর আক্রমণ হয় না বললেই চলে। তাই কোন রকম পরিচর্যা ছাড়াই পাহাড়ী অঞ্চলে কফি চাষ করা সম্ভব। আবার দেশে প্রচুর পরিমাণ মসল্লার চাহিদা রয়েছে। এই মসল্লার চাহিদা পূরণ করতে আমাদের আমদানী করতে হয়। যেমন, লবঙ্গ, গোলমরিচ, দারচিনি, এলাচি, জাফরান ইত্যাদি। দেশের বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে এই সমস্ত মসলার চাষ গবেষনা করে সফল হয়েছেন। এখন আমাদের দেশেও কিছু মসলা চাষ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে গাছের হালকা ছায়ার নিচে এলাচী চাষ সম্ভব। আবার উচ্চ মূল্য মসলা যেমন জাফরানও বাগানের ফাঁকা জায়গাতে চাষ করা যেতে পারে। খুব সহজে এবং কম পরিচর্যার মাধ্যমে বাগানের সীমানায় তেজপাতা মসলার গাছ লাগানো যেতে পারে। ড্রাগন ফলের সাথে কংক্রিট পিলারে একই সাথে গোলমরিচ এর চাষেরও নতুন পদ্ধতির সম্ভাবনা রয়েছে। গোল মরিচ একটি আংশিক পরজীবী লতানো গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। অন্য গাছের কান্ডে গোলমরিচ বেয়ে বাড়তে থাকে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয় ও আদ্রতা বেশি এমন এলাকায় গোল মরিচ ভাল জন্মে। এ ফসল ১০-৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। মাটির পিএইচ ৪.৫-৬.০ মাত্রা পর্যন্ত এ ফসল ফলানো যায়। পাহাড়ী এলাকার মাটি এ ফসলের জন্য খুবই উপযোগী। গোল মরিচ মসলা ও পথ্য হিসেবে এটি আমাদের কাছে অতি পরিচিত। যে কোন ফলজ বাগানের সাথে সেচ বিহীন অবস্থায় চাষ দুই ভাবে চাষ করা সম্ভব। ১। যেকোন ফলজ গাছে বেয়ে দিয়ে, ২। ফলজ গাছের ফাঁকা জায়গায় কংক্রিক পিলারেও বানিজ্যিক ভাবে চাষ করা সম্ভব। গোল মরিচ চাষেও বেশি রোগ বালাই আক্রান্ত হয় না। তাই পাহাড়ে বানিজ্যিক চাষে গোল মরিচের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

সবুজের ছায়ায় হোক সুন্দর পৃথিবী:
বিশ^ব্যাপি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি ভিত্তিক উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অনেকখানি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সিডর, আইলা ও রোয়ানুর মত বড় ধরনের ঘুর্ণিঝড়ের কবলে পড়েও দেশের বৃক্ষ জগৎ তথা বনাঞ্চল ক্রমেই ধ্বংস হচ্ছে। পৃথিবীতে যে হারে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে আমরা যদি এ পরিস্থিতিতে মোকাবেলা করতে আরো দেরি করে ফেলি কিংবা এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারি তাহলে পৃথিবী একদিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তাই আগে প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। প্রকৃতি এবং সবুজ বাঁচলেই পৃথিবীকে রক্ষা করা সম্ভব। তাই আমাদের প্রকৃতি ও পৃথিবীকে বাঁচাতে বৃক্ষ রোপনের কোন বিকল্প নেই।

পরিশেষে, পার্বত্যাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে মিশ্র ফলজ বাগানের সাথে মসলা জাতীয় চাষাবাদের প্রযুক্তি পরিকল্পিতভাবে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে উদ্ধুদ্ধ ও উৎসাহিত করনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বেসরকারী বিভিন্ন সংগঠনের পৃষ্টপোষকতার ভূমিকা অত্যাবশ্যকীয়।
————-
লেখক: বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কার প্রাপ্ত (স্বর্ণ পদক)
উদ্যান প্রশিক্ষক
হিউমেনিটারিয়ান ফাউন্ডেশন,থানছি, বান্দরবান।

কৃষির আরো খবরাখবর জানতে আমাদের পেইজে লাইকদিনঃ facebook.com/krishisongbad.com

Exit mobile version