কৃষিবিদ মোঃ নূরুল হুদা আল্ মামুন
স্টেভিয়া (Stevia rebaudiana Bert) একটি প্রাকৃতিক মিষ্টি সমৃদ্ধ এবং নন ক্যালরিক হার্ব জাতীয় গাছ। এটি শীত প্রধান দেশে বহুবর্ষজীবি হিসেবে চাষ করা হলেও উষ্ণ প্রধান দেশে এক বছরের বেশি সময় মাঠে জীবিত থাকবেনা বলে বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেছেন। এর মূল উপাদান স্টেভোসাইড-এ যার কারণে এটি চিনির চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি। এটি মানুষের রক্তের গ্লুকোজের কোন পরিবর্তন করেনা যার ফলে ডায়াবেটিস রোগীরা চিনির বিকল্প হিসেবে সহজেই গ্রহণ করতে পারে। ১৯৬০ সাল থেকে জাপানীরা এ ফসলের চাষাবাদ এবং উপকারীতা সম্বন্ধে অবগত আছেন। তারা স্টেভিয়ার সবুজ পাউডার, স্টেভিয়া থেকে আহোরিত স্টেভিসাইড-এ এর সাদা পাউডার এবং সিরাপ আকারে ব্যবহার করে আসছে।
স্টেভিয়ার উৎপত্তিস্থল হচ্ছে প্যারাগুয়ে। বিজ্ঞানী বর্টোনি প্রথম ইহা আবিস্কার করেন। তারপর হতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাষ শুরু হয়। বর্তমানে চীন, জাপান সহ বিভিন্ন দেশে চিনির বিকল্প হিসেবে এর যথেষ্ট ব্যবহার হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে স্টেভিয়া ঃ বাংলাদেশে উদ্ভিদটির তেমন পরিচিতি নাই। বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০১ সালে প্রথম থাইল্যান্ড হতে স্টেভিয়ার চারা নিয়ে আসেন। তারা ল্যাবরেটরি পর্যায়ে কিছু গবেষণাসহ টিসু্যু কালচারের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধিতে সফলতা অর্জন করেন। ব্র্যাক এ ফসটিকে ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক হবে ভেবে চারা তৈরী এবং স্বল্প পরিসরে বাজারজাতকরণে মোটামোটিভাবে সফল বলে দাবী করেছে। ব্র্যাক প্রতি গ্রাম শুকনা পাতা ৫ টাকা হারে এবং ২০ ও ৩০ গ্রাম এর প্যাকেট যথাক্রমে ১০০ এবং ১৫০ টাকা হারে এবং প্রতিটি চারা ২০ টাকা হারে বেশ কিছুদিন যাবৎ বিক্রি করে আসছে। টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন, পরিচর্যা, গাছ ও পাতা বৃদ্ধিতে উৎকর্ষ সাধন সহ বিভিন্ন দিকে গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব ও কৃষি রসায়ন বিভাগসমূহের গবেষণাগারে গবেষণা চলছে।
ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য স্টেভিয়া ঃ
ডায়াবেটিক শুধু আমাদের দেশেই নয় বিশ্বজুড়ে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমানুষ, সমাজ এবং অর্থনীতিতে এ রোগের বিধ্বংসী প্রভাব উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ২৪০ মিলিয়নেরও বেশি এবং প্রতি বছর এর সাথে যোগ হচ্ছে আরো ৭ মিলিয়ন রোগী। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক গবেষণা ফেডারেশন বলেছে যে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ৩৪০ মিলিয়নে এবং একই সাথে বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যার দিক থেকে ১০ নম্বরে গিয়ে দাঁড়াবে। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিক সমস্যা চাপগ্রস্থ করছে অর্থনীতিকে। প্রতি বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে ডায়াবেটিক রোগ ও কিডনী ডায়ালাইসিস এর পিছনে। ডায়াবেটিক নিরাময় হয় না তবে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সারা বিশ্বে স্টেভিয়ার উপর বিজ্ঞানীরা প্রচুর গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ করেছেন এটা মানুষের গ্রহণের জন্য নিরাপদ এবং এর পাতা চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এর কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নাই। এটি চা, কফি, পিঠা, পায়েস, কেক ও সুজি সহ যাবতীয় সুস্বাদু খাবারে সীমিতভাবে হলেও ব্যবহার হচ্ছে বলে জানা যায়।
যেভাবে আবাদ করা যায় ঃ
জমি নির্বাচন ঃ মোটামুটি সব রকম জমিতে স্টেভিয়ার চাষাবাদ সম্ভব তবে জমি অবশ্যই সুনিস্কাশিত ও উঁচু হতে হবে যেখানে বৃষ্টির পানি জমতে না পারে। এ গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারেনা। গবেষণায় দেখা গেছে যে মাত্র চার দিনের জলাবদ্ধতায়ই স্টেভিয়ার মৃত্যু ঘটে।
জমি তৈরী ঃ
প্রথমে জমিকে ৩-৪ টি চাষ এবং ২-৩ টি উল্টা চাষ দিতে হবে। ভালমত আগাছা মুক্ত করতে হবে। নালির মাধ্যমে পানি দেয়া এবং প্রয়োজন হলে পানি সরিয়ে দিতে হবে। জমি তৈরীর সময় প্রচুর জৈব সার বা পঁচা গোবর সার দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। হেক্টর প্রতি ৮-৯ টন পঁচা গোবর সার স্টেভিয়া চাষের জন্য উপযোগী। জমি তৈরীর দুই সপ্তাহ আগে এ সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
চারা লাগানো ঃ
স্টেভিয়া টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন চারা সরাসরি লাগানো যায়। কাটিং এর বয়স ৩-৪ সপ্তাহ হলে চারা লাগানোর মত হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে লাইন থেকে লাইনের দুরত্ব ৩৫ সে.মি. এবং চারা থেকে চারার দুরত্ব ২৫ সে.মি. বজায় রাখতে হবে।
পরিচর্যা ঃ
আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। মোটামুটি ৪-৫ সপ্তাহ পর পর পরিষ্কার করতে হবে। মাটি আলগা ও ঝুরঝুরে করে দিতে হবে। স্টেভিয়ার জমিতে অন্যান্য আগাছার চেয়ে মুথার প্রাধান্য বেশি লক্ষ্য করা যায় তবে এর যথেষ্ট কোন কারণ জানা যায় নি। স্টেভিয়ার চাষের জন্য পর্যাপ্ত সেচ দিতে হবে। সেচ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চারা লাগানোর পরপরই ভালোমত সেচ দিতে হবে। ৩-৪ সপ্তাহ পর পর সেচ দিতে হবে। সেচ দেওয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন নালাগুলো ভালোমতো ভিজে যায়।
সার প্রয়োগ ঃ
প্রতি ২৫-৩০ দিন পর পর পাতা সংগ্রহ করা যাবে এবং প্রতিবার পাতা সংগ্রহের পর খুব সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া দিলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
পাতা সংগ্রহ ঃ
চারা লাগানোর একমাস পর হতে প্রতি ২৫-৩০ দিন পরপর পাতা সংগ্রহ করা যায়। পাতা সংগ্রহের সময় ডালপালা হতে পারে এমন অংশ অবশিষ্ট রেখে উপরের সবটুকু কেটে নিতে হবে। ভালমতো পরিচর্যা করা হলে ২৫-৩০ দিন পরপর আবার পাতা সংগ্রহ করা যাবে। প্রতিবার পাতা সংগ্রহের সাথে সাথে ডালপালার সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং সেই সাথে ফলন বাড়তে থাকে। এভাবে পাতা সংগ্রহ করলে বছরে ৮-১০ বার পাতা সংগ্রহ করা যাবে।
বংশবৃদ্ধি ঃ
স্টেভিয়া গাছের বংশবৃদ্ধি স্টেস কাটিং এর মাধ্যমে করা সম্ভব। মূল জমিতে চারা লাগানোর আগে বীজতলায় চারা তৈরী করতে হবে। কয়েকটি ধাপে এটা করা যায়।
প্রথম ধাপ ঃ প্রথমে একটি নিরোগ এবং সবল ডাল নিতে হবে এবং উপরের থেকে মোটামুটি ৬-৮ সে.মি. অংশ কেটে নিতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপ ঃ উক্ত ডালের উপরের দিকের ৮-৯ টি পাতা রেখে বাকি সব পাতা ফেলে দিতে হবে।
তৃতীয় ধাপ ঃ ডালটির নীচের দিকে একটি তেরসা কাট দিয়ে বীজতলার মাটিতে লাগাতে হবে। লাগানো কাটিং এক সপ্তাহ ছায়ায় রেখে দিতে হবে এবং এ সময়ের মধ্যে নতুন শিকড় গজাবে। তারপর কাটিং গুলোকে হালকা রোদে রেখে দিতে হবে তবে অত্যাধিক রোদ থেকে রক্ষা করতে হবে এবং মাঝে মাঝে পানি দিতে হবে। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মাঝে গাছগুলো মাঠে লাগানোর উপযোগী হয়ে যাবে। এছাড়া বীজ থেকে কিভাবে বংশবৃদ্ধি করা যায় এ নিয়ে বাকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগের গবেষণা মাঠে গবেষণা চলছে।
পাতা সংগ্রহের পর ডালপালা সহ রোদে শুকাতে হবে। মোটামুটি (৩০-৩৫) ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ২-৩ দিন শুকালেই পাতা গ্রহণের উপযোগী হয়ে যাবে। অতঃপর মোটা ও শক্ত ডালগুলো ফেলে দিতে হবে এবং পাতাগুলো মাঝারি রকম গুঁড়া করে ব্যবহার করা যাবে। শুকনো পাতার গুঁড়া করে গরম পানিতে ৩-৪ মিনিট রাখলেই পাতা মিষ্টি পানিতে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে এবং এ মিষ্টি পানি ব্যবহার করা যাবে।
শেষ কথা ঃ দেশে এ যাবৎ স্টেভিয়া নিয়ে তেমন গবেষণা না হলেও বর্তমানে যথেষ্ট গবেষণা চলছে। আমাদের দেশের মাটিতে স্টেভিয়া চাষের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের চিনির চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করা সম্ভব হবে। আর এ জন্য সরকারী মহল থেকে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম