মো. বশিরুল ইসলাম
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়লেও সে তুলনা বাড়েনি কৃষি বাজেট। ফলে বাজেটে কৃষি খাত অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা না গেলেও আগামীতে কৃষিতেই শুধু নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিসহ জনজীবন বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। দেশের প্রধান এ উন্নয়ন খাতে বাজেটে কেন বিমাতাসুলভ বৈষম্য করা হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়।
চলতি বছরের হাওরাঞ্চলে অকাল বন্যার, রোরে ধানে ব্লাস্ট আক্রমন কারনে কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। এমনকি পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা কৃষি থেকে দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অথচ বাজেটে এসব দিকে কোনো নজরই দেওয়া হয়নি। শুধু কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার কৃষককে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৭০ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারপরও এ কথাটি প্রাসঙ্গিক যে একটা বড় প্রাপ্তির আশা নিয়ে এ বাজেট পেশ করা হয়েছে। সরকারকে এ জন্য সাধুবাদ জানাই। গতানুগতিকভাবে বিগত ক’বছরের মতো করে কৃষিতে বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কৃষিতে মন্দের ভালো এই বাজেট বরাদ্দ আমাদের কৃষক ও কৃষিকে কতটুকু আশান্বিত করেছে, কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কতটুকু প্রত্যয় রয়েছে এতে সেটাই আজ ভাবনার বিষয়।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন মিলে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ খাত কৃষির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যা মোট প্রস্তাবিত বাজেটের ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে অনুন্নয়ন খাতে ১১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা এবং ১ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে মোট ১৩ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল। যার মধ্যে অনুন্নয়ন খাতে ১১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ১ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। এই হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৭৬ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। যদিও আগের বছরের সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী কৃষি খাতের বরাদ্দ কমে শেষপর্যন্ত ছিল ১০ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। ফলে বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের ক্রমহ্রাসমান ধারা বজায় থাকল। তবে ভর্তুকি বাড়ছে ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি রাখা হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি।
কৃষিখাতের উন্নতিতে বিভিন্ন ধরনের চারাগাছের পরিচর্যা ও গ্রিনহাউজ প্রযুক্তিতে ব্যবহূত উপকরণের ওপর শুল্কহার কমানো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ফলে কৃষিপণ্যের বেশকিছু পণ্যের দাম কমতে পারে। একই সঙ্গে কৃষির অন্যতম উপখাত মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি শিল্পের খাদ্যসামগ্রী ও নানাবিধ উপকরণ আমদানিতে প্রয়োজনীয় কতিপয় পণ্যে প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশক আমদানিতে শূন্য শুল্কহার বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়া কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আমদানিকৃত চালের ওপর সর্বোচ্চ শুল্কহার অব্যাহত রাখা হয়েছে। স্টার্চজাতীয় পণ্য ও অয়েল কেকের আমদানিতে শুল্কহার যৌক্তিকীকরণ করা হয়েছে। আর কৃষিকাজে যন্ত্রের আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে ও স্থানীয়ভাবে কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদন করতে যন্ত্রপাতি তৈরির উপকরণে ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক ধার্য করা হয়েছে। তামাক ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদন নিরুৎসাহিত করতে তামাকজাতীয় সব পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। আশার কথা হল, সেচযন্ত্রে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের ওপর ২০ শতাংশ হারে ছাড় প্রদান করা হযেছে।
এদেশের কৃষকরা ঘামঝরা পরিশ্রম করে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য জোগান দিয়ে চলছে। কিন্তু তাদের ঘামঝরা পরিশ্রম থেকে যতটুকু উৎপাদন ও আয় হওয়া উচিত তা তারা পাচ্ছে না। এমনকি ফল-ফসলের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে কৃষকরা হারাচ্ছে তাদের উৎপাদিত ফসলের বিশাল অংশ। তাই, সঠিক সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ নিশ্চিত করতে দরকার গবেষণা ও অবকাঠামো উন্নয়ন। লাভজনক ফসল উৎপাদন, বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য দরকার সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা। কৃষকের স্বার্থে উদ্বৃত্ত খাদ্য থেকে সঠিক মুনাফা লাভের জন্য বৈদেশিক বাজার তৈরি করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও লাভজনক করার জন্য কৃষিবিদ, কৃষি বিজ্ঞানী, পলিসি বিশেষজ্ঞ, সম্প্রসারণকর্মীসহ সকলকে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর জন্য চাই সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা।
আমরা দেখেছি কৃষির উন্নয়ন ঘটলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বা নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। বেকারত্বের সংখ্যা কমে এবং দারিদ্রও কমে আসে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কৃষিখাতের উন্নয়ন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিরাট সফলতা এনেছে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এমনকি বিদেশে খাদ্য রপ্তানিও করছে। কৃষি খাতে যদি বাজেট বরাদ্দ বেশি থাকতো তাহলে আমরা মানুষের কল্যাণ সাধন বা উন্নত জীবন যাপনে আরও সফলতা দেখতে পেতাম। দাতাদেশগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও বর্তমান সরকার কৃষি খাতে ভর্তুকি ও অনুদান দিয়ে যাচ্ছে।
আমরা যতি বিগত বছরের বাজেট দেখি, কোথাও বা একটু বাড়ে, কোথাও বা একটু কমে। যেহেতু বাজেট প্রণয়নে আমলারা প্রধান ভূমিকা পালন করে, সেহেতু তারা তাদের স্বার্থের বাইরে বিন্দুমাত্র যেতে চায় না। সুতরাং ব্যবসায়ীদের সন্তুষ্ট রাখা এবং রাজনৈতিক সরকারের ভাগ্য নিয়ন্ত্রন তারাই করে থাকে। সংসদে বাজেট উপস্থাপনের সময় কোন কোন বিষয়ের ওপর অতিরিক্ত কর বসিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করা এবং বাজেট পাশের সময় আবার কর প্রত্যাহার বা হ্রাস করে ফেলে। এতে কারো কারো ভাগ্যোন্নয়ন ঘটে। জনগণও সেই দ্রব্যটির বাড়তি মূল্য দিয়ে চলে। কর প্রত্যাহার বা হ্রাস পেলেও সেই দ্রব্যটির মূল্য কমে না। এই অর্থ খায় কে? আর শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে সামনে রেখে বাজেট তৈরি করা মানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সঙ্গে প্রতারণা করা। অথচ আমার ক্ষেতমজুর ও বর্গাচাষীরা যে পশ্চাদপদ জীবনযাপন করে সেখান থেকে বেরুতে পারার উপায় খুঁজে পায় না। এই অমানবিক বৈষম্য আর কতদিন সহ্য করতে হবে?
প্রতি বছর বাজেটে কৃষি খাতকে অবহেলা কার হচ্ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় বর্ধিত জনসংখ্যা ও খাদ্য সংকট মোকাবিলা সরকারে জন্য কঠিন হবে। এ বাস্তবতাকে মাথার রেখে প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ বাজেটের ওপর পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ, সংযোজন-বিয়োজনের করে অর্থনীতির মুক্তির সোপান কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হোক।