জেনে নিতে পারেন ফেব্রুয়ারি মাসের কৃষিতে করণীয় কাজ সমূহ

ফেব্রুয়ারি মাসের কৃষিতে
  •  ড. এম এ মান্নান,

      প্রিয় পাঠক, কেমন আছেন wheat fieldসবাই? আশা করি ভাল আছেন।  ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য যাঁরা আত্ম ত্যাগ করেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জানিয়ে শুরু করছি এ সময়ের কৃষি। সুপ্রিয় কৃষক কৃষাণী ভাই বোনেরা কয়েকদিন পরই পৌষের পিঠা খেয়েই পরবর্তী ফসল বোরোর জন্য কাজ শুরু করতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই বীজ তলায় ধানের চারা বড় হচ্ছে। আপনার বীজতলায় প্রয়োজনীয় সেচ দিন। কারণ বীজতলা শুকিয়ে গেলে চারার শিকড় বেশি হয় এবং শিকড়গুলো লম্বা হয়ে যায়। এতে চারা তোলার সময় শিকড় ছিড়ে যেতে পারে। আবার বীজতলায় কোনো কারণে পানি জমে গেলে তা বের করে দিতে হবে। বীজতলার চারা পুষ্টির অভাবে লাল হয়ে গেলে সামান্য ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিন। শীতের প্রাদুর্ভাব বেশি হলে রাতে পলিথিন শিট বা কলাপাতা দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখুন। মনে রাখবেন সুস্থ সবল চারা অধিক ফলনের পূর্বশর্ত। চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে মূল জমিতে চারা রোপণ শুরু করতে পারেন। এ জন্য জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে পানিসহ কাদা করতে হবে। চাষের আগে জমিতে জৈব সার দিতে হবে এবং শেষ চাষের আগে দিতে হবে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য রাসায়নিক সার।

    ধান

    মাঠে বোরো ধান বাড়ন্ত পর্যায়ে থাকবে। তখন বোরো ধানে প্রয়োজন সারের উপরি প্রয়োগ, নিয়মিত সেচ প্রদান, আগাছ দমন, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পরিচর্যা। ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখন। অথবা গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করুন। রোপণের ১ সপ্তাহ পরে দুই লাইনের ১ম চারটি চারার মাঝে একটি এবং ২য় চারটি চারার মাঝে একটি হিসাবে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ভাল হয়। ভালো ফলন পেতে বোরো ক্ষেত্রের নিয়মিত সেচ প্রদান করুন। চারা রোপণের সময় ছিপছিপে পানি, কুশি বের হওয়ার সময় এবং কাঁইচ থোড় আসার সময় ৫-১০ সেন্টিমিটার পানি ক্ষেতে রাখতে হবে। তবে চারা শক্ত হওয়ার পর, সার প্রয়োগের সময় ক্ষেতে পানি রাখা যাবে না।

    এ সময় ধান ক্ষেতে রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। রোগ ও পোকা থেকে ধান গাছকে বাঁচাতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বা আইপিএম পদ্ধতি প্রয়োগ করুন। এ ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, আন্তঃপরিচর্যা, যান্ত্রিক দমন, উপকারী পোকা সংরক্ষণ, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেতে বালাইমুক্ত করতে পারেন। এসব পন্থায় রোগ পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করুন।

    গম

    গমের শীষ বের হওয়ার সময় হচ্ছে। এ অবস্থায় বা গম গাছের বয়স ৫৫-৬০ দিন হলে গম ক্ষেতে একটি সেচ দিতে পারেন। এতে গমের ফলন বৃদ্ধি পাবে। এ সময় গম ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব হয়ে থাকে। ইঁদুরের আক্রমণে গমের ফলন দারুণভাবে ব্যহত হয়। তাই ইঁদুর দমন জরুরি। তবে ইঁদুরের দমনের কাজটি করতে হবে সম্মিলিতভাবে। কারণ এককভাবে ইঁদুর দমণ করলে অন্য ক্ষেতের ইঁদুর আপনার ক্ষেতে আবার আক্রমণ করতে পারে। তাই সবাই মিলে ইঁদুর নিধন করুণ। জমিতে ইঁদুর আক্রমণ দেখা দিলে গর্ত খুঁড়ে, জমির আইল পরিষ্কার করে, গর্তে পানি ঢেলে, ধোঁয়া দিয়ে, ফাঁদ পেতে বা রাসায়নিকভাবে ইঁদুর দমন করুন। তাছাড়া বিড়াল পেঁচা, সাপ, গুইসাপ, বেজি, বাজপাখি সংরক্ষণ করলে প্রাকৃতিক উপায়ে ইঁদুর দমন সম্ভব। কারণ এসব প্রাণী ইঁদুর ধরে খায়।

    ভুট্টা

    আপনার ভুট্টা ক্ষেতের গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিন এবং গোড়ার মাটির সাথে পরিমাণমতো ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিন। সেচ প্রদান করুন এবং গাছের নিচের দিকে মরা পাতা ভেঙে দিন। ভুট্টার সাথে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করুন।

    আলু

    আলুর চারা গাছের উচ্চতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার হলে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করুন। দুই সারির মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিন। তা না হলে গাছ হেলে পড়বে এবং ফলন কমে যাবে এবং মেঘলা আবহাওয়ায় বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে আলুর ‘নাবী ধসা’ রোগ হতে পারে। আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে ফলন খুবই কম হয়। এ জন্য অনুমোদিত ছত্রাকনাশক সঠিক মাত্রায় জমিতে ভালোভাবে স্প্রে ও প্রয়োজনের মালচিং ঠিকমতো করুন। অধিক ফলন পাবেন আশা করি।

    ডাল ও তেল ফসল

    ডাল ও তেল ফসল যেমন- মসুর, ছোলা, মটর, মাসকলাই, মুগ, খেসারি, সরিষা, তিল, তিসি পাকার সময় এখন। পাকার সময় হলে তা সংগ্রহের ব্যবস্থা নিন। সরিষা, তিল, তিসি, বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে তাই এগুলো ৮০% পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিন। আর ডাল ফসল সংগ্রহের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে কেটে নিন। কারণ, ডাল ফসলের শিকড়ে নাইট্রোজেন গুঁটি থাকে যা ইউরিয়া সারের কাজ করে। তাই মাটির উর্বরতা বাড়াতে এসব গুঁটি পরবর্তীতে মাটির সাথে মিশিয়ে দিন। সংগ্রহ করা ডাল ও তেল ফসল শুকিয়ে মাড়াই ঝাড়াই করে সংগ্রহের ব্যবস্থা নিন।

    শাকসবজি

    এখন শাকসবজি পরিপক্ব হওয়ার সময়। তাই শাকসবজি সংগ্রহ করুন। আপনি টমেটো সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে পারেন। এজন্য আদা পাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠাণ্ডা জায়গায় উপুড় করে ঝুলিয়ে রাখুন এবং টমেটোগুলোকে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখুন। পরবর্তীতে ৪/৫ মাস পর্যন্ত অনায়াসে টমেটো খেতে পারবেন।

    তুলা

    জমি থেকে তুলা সংগ্রহের সময় হচ্ছে। জমির ৫০% তুলার বোল পরিপক্ব হলে বা ফাটলে প্রথমবার তুলা সংগ্রহের ব্যবস্থা নিন। অবশিষ্ট তুলা গাছগুলোর অর্ধেক বোল ফাটলে দ্বিতীয়বার এবং বাকি গাছগুলোর বোল ফাটার পর তৃতীয়বার তুলা সংগ্রহ করুন। রোদেলা দিনে বীজ তুলা সংগ্রহ করে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করুন। লক্ষ্য রাখবেন ভালো তুলার সাথে খারাপ তুলা যেন না মেশে।

    আখ

    এ সময় আখ ক্ষেতে পোকার উপদ্রব দেখা যায়। আইপিএম পদ্ধতিতে পোকা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিন। জমির মাটি শুকিয়ে গেলে একটি সেচ দিতে পারেন।

    গাছপালা

    শীতে গাছপালার বিশেষ যতœ নিতে হবে। এ সময় মাটির রস কমে যায় বলে গাছের গোড়ায় নিয়মিত মানি সেচ দিন। গোড়ার মাটি আলগা করে দিন এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিন। গাছের রোগাক্রান্ত ডালপালা কেটে দিন। আমের হপার দমনের লক্ষ্যে গাছে ফুল আসার অনুমোদিত কীটনাশক ডালপালা ও পাতায়  স্প্রে করার ব্যবস্থা নিন।

    পশুসম্পদ

    এ সময় আপনার পশুপাখির বিশেষ যত্ন নিন। শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে চট দিয়ে গরু বাছুরের গা ঢেকে দিন। উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করুন যেমন- কাঁচা ঘাস, ভুট্টা, ডালের ভুসি, ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক এবং ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র। প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিয়ে আপনার পশুপাখিকে সুস্থ সবল রাখুন। চাষিভাইয়েরা, এ সময় গাভী বিশেষ করে দেশীয় গাভীর প্রজনন প্রক্রিয়া বেশি হয়। এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশী গাভীর বেশি দুধ উৎপাদন সংকর জাতের বাছুর উৎপাদনের মাধ্যমে আপনি বেশ লাভবান হতে পারেন। কৃত্রিম প্রজনন এবং অন্য যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে উপজেলা পশুসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করুন।

    মাছ

    এ সময় পুকুরে পানি ও মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন। শীতে মাছের বাড়-বাড়তি কম হয়। তাই পুকুরে জাল টেনে দিন এবং পুকুরে যাতে রোদ পড়ে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখুন। মাছ চাষ সংক্রান্ত যে কোনো প্রয়োজনে উপজেলা মৎস্য অফিসে গিয়ে আপনার চাহিদামাফিক পরামর্শ গ্রহণ করুন।

    প্রিয় পাঠক, সচেতন ও সতর্ক থেকে কৃষিতে নজর দিলে আপনি লাভবান হবেন। কৃষি বিষয়ক যে কোনো সমস্যা সমাধানে বা যে কোনো পরামর্শ জানতে আপনার নিকটস্থ উপসহকারী কৃষি অফিসার বা উপজেলা কৃষি অফিসের বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলুন, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্যোগী হোন। এতে সমৃদ্ধ হবে দেশ, সমৃদ্ধ হবেন আপনি। আজকের মতো এ পর্যন্তই। আবার কথা হবে পরবর্তী সংখ্যার কৃষি নিয়ে।  সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন এই প্রত্যাশা করি।

    কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *