Site icon

বন্যাত্তোর কৃষি পুনর্বাসন ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা

সবজি চাষীরা ক্ষতির সম্মুখিন


নিতাই চন্দ্র রায়
বন্যাত্তোর কৃষি পুনর্বাসন ঃ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব-খরা, বন্যা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশে কৃষি ও কৃষকের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। বন্যায় মাঠের ফসল তলিয়ে যায়। পানির প্রবল ¯্রােতে ভেসে যায় পুকুরের মাছ। ভেঙ্গে যায় বাড়িঘর । পাহাড়ি ঢল, উজান থেকে নেমে আসা অতিরিক্ত পানি, অতিবৃষ্টি ও পলিপড়ে নদীগুলির তলদেশ ভরাট হওয়ায় ৮থেকে ১০ বছর পরপরই বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যার সাথে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছে এদেশের কৃষক, মৎস্য চাষি এবং দুগ্ধ ও পোল্ট্রি খামারিরা যুগযুগ ধরে।


অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল এবং সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নিচু এলাকায় বন্যা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তরাঞ্চল পেরিয়ে মধ্যাঞ্চলেও বন্যা দেখা দেয়। এবারের বন্যায় ৩১ টি জেলায় কৃষি , মৎস্য ও প্রাণি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ক্ষতি হয় রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের । তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই বন্যায় সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টাকার অংকে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি । বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। মন্ত্রণালয়ের মতে, বন্যায় আদ্যাবধি ৩১ টি জেলায় প্রায় ১ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নষ্ট হয়েছে ৩ লাখ ২৮ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের শস্য। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আউস ধানের। ৯৭ হাজার ১৮৪ জন কৃষকের ৫০ হাজার ৬০২ হেক্টর জমির আউসের ক্ষতি হয়েছে ২৫২ কোটি টাকা। এছাড়া ৯৫ হাজার ৫৭০ জন কৃষকের ২৫৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার পাট ও ৮৮ হাজার ৪০৮ জন কৃষকের ১৫৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকার বোনা আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবারের ভয়াবহ বন্যায়। বন্যায় আমন ধানের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৬ হাজার ৬৫৫ হেক্টর । এতে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯৮৬ জন কৃষকের ক্ষতি হয়েছে ১২৬ কোটি টাকা। এছাড়া গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় ১ লাখ কৃষকের ক্ষতি হয়েছে ২৯০ কোটি টাকা।


এবারে বন্যায় পানি নামছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। একারণে বন্যার প্রভাব আরও দীর্ঘ হতে পারে। ফলে আউস , আমন, পাট ও গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদন বিঘিœত হতে পারে। বন্যায় চিনিকল ও চিনিকল বর্হিভুত এলাকার চরাঞ্চলের আখ ফসলেরও ক্ষতি হয়েছে বেশ। বন্যায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর ও বগুড়া জেলায় কৃষি, মৎস্য , দুগ্ধ ও পোল্ট্রি খামারিদের বেশি ক্ষতি হয়েছ। কুড়িগ্রামে ১৫৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে বন্যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার কৃষক পরিবার। আমন ধানের বীজতলা নষ্ট হওয়াতে সংকট দেখা দিয়েছে আমন চারার। এবারের বন্যায় গাইবান্ধা জেলায় ১৪ হাজার ২১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অংকে এই ক্ষতির পরিমাণ ৯২ কোটি ১ লাখ ১৭ হাজার। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে জেলায় একশ’ একর জমিতে আমন বীজতলা স্থাপন করা হয়েছে। উৎপাদিত চারা বিনা মূল্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। এছাড়া চারা তৈরি করে ধান রোপণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে ৫ কেজি করে আমন ধানের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জে ১৪৩ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় মাছ চাষিদেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বগুড়া জেলায় পাঁচ হাজারের বেশি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। একই সঙ্গে ভেসে গেছে কয়েকটি বিলে চাষ করা মাছ। ভেসে যাওয়া এসব মাছের আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি টাকারও বেশি এবং মৎস্য চাষির সংখ্যা ৪ হাজার ৩৮১ জন। বন্যায় গাইবান্ধা জেলায় মাছ চাষেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার ৭টি উপজেলার ৭ হাজার ৫০টি খামার ও পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ চাষিদের কথাÑ সরকারি অনুদান বা সহযোগিতা না পেলে নতুন করে মাছ চাষ শুরু করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবেনা । এজন্য প্রয়োজন স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে মৎস্য ঋণ।


বন্যার ক্ষতি পোষাতে কৃষকদের প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হবে বলে জানান কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।তিনি বলেন, এবারের বন্যায় তেমন ক্ষতি হয়নি । বন্যার আগেই মূল ফসল কৃষকের ঘরে উঠেছে। এরপরও কৃষির যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হবে। বন্যা পরবর্তীতে কৃষি পুনর্বাসন করার জন্য কৃষককে বিনামূল্যে সার, বীজ প্রদান করা হবে । কৃষি প্রণোদনার জন্য ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে । বন্যার ক্ষতির সাথে কিছু উপকারী দিকও রয়েছে। বন্যার ফলে কৃষি জমিতে প্রচুর পলিমাটি পড়ে এবং বালাইনাশক ও রাসায়নিক সারের বিষাক্ততা হ্রাস পায়। ফলে কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়।এ কারণে বন্যা পরবর্তী সময়ে ফসলের বাম্পার ফলন হয়। বন্যার ফলে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের প্রজনন ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ সময় পাট জাগ দেয়ার জন্য খালে-বিলে প্রচুর পানি পাওয়া যায়।


বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে কৃষকদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে কৃষি উৎপাদন কর্মকা- অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে প্রকৃত চাহিদা ও বাস্তবতার নিরিখে নতুন ঋণ বিতরণের পাশাপাশি পুরোনো ঋণ আদায় স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৪ জুলাই, বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ঋণ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সব তফসিলি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বন্যা পরিস্থির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষি ঋণ আদায় স্থগিত , সহজ কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে ঋণ নিয়মিতকরণ-ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিলপূর্বক ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ সুবিধা প্রদান করতে হবে। নতুন করে কোনো সার্টিফিকেট মামলা না করে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অনাদায়ী ঋণ তামাদি হওয়া প্রতিবিধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দায়েরকৃত সার্টিফিকেট মামলাগুলোর তাগাদা আপতত বন্ধ রেখে সোলেনামার মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক যাতে চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে নতুন ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন এবং ঋণ পেতে কোনো হয়রানির শিকার না হন সে বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদারকি করতে হবে। এছাড়া প্রজ্ঞপনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বসতবাড়ির আঙিনায় হাঁস-মরগি ও গবাদিপশু পালন, গো-খাদ্য উৎপাদন ও ক্রয় এবং অন্যান্য আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডে ঋণ প্রদানের প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।


বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নাবী জাতের বিআর ২২, বিআর ২৩ ব্রিধান ৪৬ ও ব্রিধান ৭৫ জাতের বীজ মধ্য আগষ্টের মধ্যে বপন করে ৩০ থেকে ৪০ দিন বয়সের চারা সর্বশেষ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যা উপদ্রুত এলাকার রোপণ করতে হবে।দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলার যেসব এলাকায় সরু ধানের চাষ হয় সেখানে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বিআর ৫, ব্রিধান ৩৪, ব্রিধান ৩৭ ব্রিধান ৭৫ ও ব্রিধান ৮০ চাষ করা যাবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর বিনাশাইল ও নাইজারশাইল জাতের স্থানীয় জাতের চাষ করতে পারবেন কৃষক। সব সুগন্ধি ও স্থানীয় জাতের ধানের চারা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই রোপণ করতে হবে। এছাড়া স্বল্প সময়ে উৎপাদন হয় এমন শাকসবজি আবাদের ওপর জোর দিতে হবে বন্যা উপদ্রুত এলাকার কৃষকদের।এসব স্বল্প মেয়াদী সবজির মধ্যে রয়েছে লালশাক, পালংশাক, ধনেপাতা, মূলা, মরিচ, গাজর, শিম, লাউ, শসা, ক্ষীরা, করলা ইত্যাদি। পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে সামান্য চাষ ও সার প্রয়োগ করে বুনতে হবে এসব ফসলের উন্নত জাতের বীজ।একই সঙ্গে কৃষক ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন ও টমেটোর চারা প্রস্তুত করতে পারবেন। উঁচু জমির অভাব হলে ভাসমান বীজতলায় এসব ফসলের চারা তৈরি করতে হবে। বন্যায় অনেক কৃষকের পাওয়ার টিলার, অগভীর নলকূপ ও গভীর নলকূপসহ অনেক কৃষিযন্ত্রপাতি বিনষ্ট হয়ে গেছে। এসব কৃষিযন্ত্রপাতি জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে।

বন্যার ফলে অধিকাংশ কৃষক অভাবের তাড়নায় গৃহপালিত পশুপাখি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁদের বিনামূল্যে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলের বাচ্ছা ও খাবার সরবরাহ করতে হবে। সেই সাথে নিশ্চিত করতে হবে গৃহপালিত পশুপাখির চিকিৎসা ও ওষুধ। বন্যার পর কুষকদের দানা শস্যের অভাব পূরণের জন্য ভূট্টা, সরিষা, মাসকলাই , মুসুর ও মুগডালের চাষ করতে হবে। মাসকলাইয়ের গাছ ও ভূষি পশু খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। পশু খাদ্যের জন্য নেপিয়ার ও জাম্বু ঘাসের চাষ করা যেতে পারে। অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় রবি ফসল বিশেষ করে বোরো ধান, গম, আলু, মিষ্টি আলু, শীতকালীন সবজি, তেলবীজ, পেঁয়াজ, রসুনও আখ প্রভৃতি ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে বিনামূল্যে বীজ, সার ও বালাইনাশক সরবরাহের সরকারি কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে ।সেই সঙ্গে ব্যবস্থা করতে হবে পর্যাপ্ত কৃষি ঋণের। যাতে সময় মতো ঋণ গ্রহণ করে কৃষক পুরোদমে কৃষি কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। বন্যায় সর্বস্বান্ত কৃষকের হাতে কোনো নগদ অর্থ নেই। মাঠে নেই বিক্রয়যোগ্য ফসল। তাই নতুন ফসল ঘরে না ওঠা পর্যন্ত বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সকল এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখতে হবে। প্রয়োজনে নতুন ঋণ দিতে হবে। বন্যা উপদ্রুত চিনিকল এলাকায় বন্যার পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথেই আগাম আখ ও আখের সাথে সাথি ফসল চাষের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সার, বালাই নাশক ও নগদ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে যথাসময়ে চিনি কলগুলি চালু এবং আখ ক্রয়ের সাথে সাথে আখের মূল্য প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। যাতে আখ চাষিরা আখ বিক্রি করে বোরো ধান ও রবি ফসলের চাষ করে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পান।


বন্যা এদেশের কৃষকের কাছে নতুন কোনো ঘটনা নয়। ১৯৮৭, ১৯৮৮,১৯৯৮, ২০০৭ ও ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলার বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে দেশের পোনে দুই কোটি সাহসী ও কর্মঠ কৃষকের। তাঁরা জানেন বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়। নদীমার্তৃক বন্যা বিধৌত পলি মাটিতে কীভাবে ফসল ফলাতে হয়? তাই তাঁদেরকে এই মুহুর্তে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ, কৃষিঋণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করলেই, বন্যা বিধ্বস্ত ফসলের মাঠ তাঁরা আবার সবুজ শস্যে ভরে তুলবেন। এতে কৃষি ও কৃষক যেমন বাঁচবে , তেমনি নিশ্চিত হবে দেশের টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা।

লেখক ঃকৃষিবিদ ও কলামিস্ট

Exit mobile version