আবদুস সালাম,
বাঁশ বাংলাদেশের একটি অতি মূল্যবান সম্পদ। খাদ্য ও বস্ত্র উৎপন্নকারী শস্য গুলোকে বাদ দিলে বাঁশের মতো এত উপকারী উদ্ভিদ এ দেশে খুব কমই আছে। কেবল এদেশে নয় পৃথিবীর প্রায় সকল গ্রীষ্ম প্রধান দেশে এবং বিশেষ করে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র বাঁশের উৎপাদন ও ব্যবহার সর্বজনীনভাবে প্রচলিত। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে বছরে বিভিন্ন কাজে প্রায় ১০০ মিলিয়ন বাঁশ এবং ৭৫ হাজার টন ছন ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এগুলো ছাড়াও গমের ডাটা, ধানের খর, গোলপাতা, পাটকাঠি ইত্যাদি সবজি ও পান বরজে ব্যবহার করা হয়।
বাঁশসহ এসব দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহারের প্রধান অসুবিধা হচ্ছে এগুলো খুব দ্রুত ছত্রাক, পোকা-মাকড়, উইপোকা ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হওয়ার কারণ হলো, কাঠের মতো এসব দ্রব্য সামগ্রীর মধ্যেও শেতসার জাতীয় বস্তু থাকে। বাঁশের প্রধান উপাদান হলো – সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ এবং লিগনিন। এ ছাড়া রেজিন, টেনিন, ওয়াক্স এবং অজৈব লবন সমূহ অল্প পরিমান আছে। বাঁশের প্রায় সমস্ত সেল ওয়ালের অর্ধেক হচ্ছে সেলুলোজ এবং বাকী অর্ধেক হেমিসেলুলোজ ও লিগনিন প্রায় সমপরিমানে আছে। এই উপাদানগুলোই হচ্ছে পোকা-মাকড় এবং ছত্রাকের খাবার। এ কারণেই বাঁশ এবং কাঠ পোকা-মাকড় ও ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। সবজি ও পান চাষ করার জন্য কৃষকেরা সাধারণত বাঁশের শলা, খুঁটি, কাইম, ছন, ধানের খড়, গোলপাতা ও অন্যান্য উদ্ভিদজাত সামগ্রী ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এ দ্রব্যগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে প্রত্যেক বছরই প্রতিস্থাপন করতে হয় বলে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় অনেকগুন বেড়ে যায়। এতে শুধু অর্থেরই অপচয় হয় না, সাথে সাথে এসব সামগ্রীর ঘাটতিও দেখা দেয়, ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর বেশী চাপ পড়ে। এসব সামগ্রীগুলোকে ছত্রাক ও পোকা-মাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে রাসায়নিক সংরক্ষণী প্রয়োগে প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার করা।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই), চট্টগ্রাম কর্তৃক উদ্ভাবিত রাসায়নিক সংরক্ষণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংরক্ষিত দ্রব্য সামগ্রীর আয়ুস্কাল স্বাভাবিক আয়ুস্কালের চেয়ে ৪-৫ গুন বাড়ানো সম্ভব। এতে উৎপাদন ব্যয় অনেকাংশে কমে যায়। ১০% ঘনত্বের কপার-ক্রোমেট-বোরণ( সিসিবি) দ্রবণ তৈরী করতে ২ঃ২ঃ১ অনুপাতে গৃহীত মোট রাসায়নিক দ্রব্যের নয় গুন পানির সাথে মিশাতে হবে। অর্থাৎ ৪% কপার সালফেট (তুঁতে), ৪% সোডিয়াম ডাইক্রোমেট, ২% বরিক এসিড এর সাথে ৯০% পানি মিশ্রিত করতে হবে। তৈরীকৃত ১০% ঘনত্বের সিসিবি দ্রবণে বাঁশের শলা বা কাইম এবং শুকনা বাঁশ তিনদিন ডুবিয়ে রাখতে হবে। অতপর ছায়ায় শুকানোর পর ব্যবহার করতে হবে। ২.৫% সিসিবি দ্রবণে ছন, ধানের খড়, গোলপাতা ও অন্যান্য উদ্ভিদজাত সামগ্রী আট ঘন্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে। ব্যবহারের পর অবশিষ্ট সংরক্ষণী দ্রবণ প্লাষ্টিকের ড্রামে করে শিশু ও গবাদি পশুর নাগালের বাহিরে রাখতে হবে যা পূনরায় ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার সবজি ও পান চাষীরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে বরিশাল জেলার গৌরনদী , যশোর, গাইবান্ধা, রাজশাহী প্রভৃতি জেলার সবজি ও পান চাষীরা এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। প্রযুক্তিটি ব্যবহারে একদিকে যেমন সবজি ও পান উৎপাদনে কৃষকদের ব্যয় হ্রাস সম্ভব হচ্ছে অন্যদিকে তেমনি বাঁশ ও বাঁশজাত সম্পদ সংরক্ষণে অবদান রাখছে। রাসায়নিক সংরক্ষনী প্রয়োগ করতে স্বাভাবিকের খরচের চেয়ে ৩০% থেকে ৪০% ব্যয় বেশী হবে । তবে প্রাথমিক খরচ কিছুটা বেশী হলেও সর্বোপরি অনেক লাভ। সংরক্ষনী ব্যয় নির্মাণ সামগ্রী এবং রাসায়নিক দ্রব্যের ক্রয় মূল্যের উপর নির্ভরশীল।
——–
লেখকঃ রিসার্চ অফিসার, কাষ্ঠ সংরক্ষণ বিভাগ, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই), চট্টগ্রাম। মোবাইল: ০১৭২৯-৮২২২২৩, টেলিফোন: ০৩১-৬৮১৫৬৮