নিতাই চন্দ্র রায়
কৃষির মূল চালিকা ঃ ‘ সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের’ শিরোনামে গত ১৩ জুন, দেশের ৪৮ তম বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। ওই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হলো ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বেড়ে হয়েছে ৬৬৬ গুণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে জনকল্যাণমুখী বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুমানা হক। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব বিষয় ছিল, সেগুলোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো, তা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ নেই এই বাজেটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের মতে, আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা মাথায় রেখেই সরকার বাজেট ঘোষণা করেছে। এই বাজেটের সঙ্গে নির্বাচনী ইশতেহারের মিল রয়েছে। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বাজেট বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর এক সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিনের মতে, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে নুতন কিছু নেই। এটি একটি গতানুগতিক বাজেট। কেউ কেউ বলেন, এবারের বাজেট বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর বাজেট।
এবার বোরো মৌসুমে কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পায়নি। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তাঁরা।এব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ( সিপিডি) বলছে, কম মূল্যে ধান বিক্রিতে কৃষকের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে দিতে দেশের প্রতিটি কৃষককে ৫ হাজার টাকা করে সরকারের নগত সহায়তা দেওয়া দরকার। এ কারণে ১ কোটি ৮০ লাখ কৃষকের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রাখা উচিত। বাংলাদেশের কমুনিষ্ট পার্টি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, অর্থমন্ত্রী যখন সংসদে বাজেট পড়ছেন, তখন কৃষকেরা বাধ্য হয়ে তাঁদের ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন উৎপাদন ব্যয়ের অর্ধেক দামে। সরকারের খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য গুদামের অভাব দেখিয়ে কৃষকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্যশস্য ক্রয় করছেন না। প্রতিটি ইউনিয়নে স্বল্পকাল মজুদের উপযোগী একটি করে শস্য গুদাম তৈরির জন্য বর্তমান কাজেটে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের আহবান জানায় দলটি, যা প্রস্তাবিত বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, কৃষি ক্ষেত্রে বিদ্যুত চালিত সেচ যন্ত্রের ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ বিলে ওপর ২০ শতাংশ রিবেট প্রদান অব্যাহত থাকবে। দেশের বিদ্যুৎ চালিত সেচ যন্ত্রের মালিকেরা ব্যবসার ভিত্তিতে সেচ যন্ত্রগুলি চালান। প্রতি বিঘা জমিতে বোরো মৌসুমে সেচ বিল হিসেবে তাঁরা কৃষকের কাছ থেকে এলাকা ভেদে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। সেচ যন্ত্রের বিদ্যুৎ বিলের ওপর এই রিবেট সুবিধা ধান উৎপাদনকারী কৃষক নয়, সেচ যন্ত্রের মালিকেরা একচেটিয়াভাবে ভোগ করেন। দেশের ৮২ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক, যারা কৃষির মূল চালিকা শক্তি, তাঁরা এথেকে বিন্দুমাত্র সুবিধা পান না। তাই তাঁদের দাবি- সেচ যন্ত্রের ওপর বিদ্যুৎ বিলের এই রিবেট সুবিধা সেচ যন্ত্রের মালিকদের প্রদান না করে ধান উৎপাদনকারী কৃষকদের প্রদান করা হোক।এতে ধানের উৎপাদন খরচ কিছুটা হলেও কমবে এবং লাভবান হবেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক।
সেচ যন্ত্রের ওপর বিদ্যুৎ বিলের রিবেট ছাড়াও কৃষির উন্নয়নের জন্য স্বাভাবিক বিনিয়োগের অতিরিক্ত হিসেবে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে এই বাজেটে। নতুন অর্থবছরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় প্রয়োগিত গবেষণার মাধ্যমে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও অধিক তাপমাত্রা সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন কার্যক্রম জোরদার করা হবে। শস্যের বহুমুখীকরণ কার্যক্রম জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জনপ্রিয়করণ, ও খামার যান্ত্রিকীকরণ জোরদার করা হবে। কৃষি শ্রমিকের অত্যাধিক মজুরি বৃদ্ধি বাংলাদেশে কৃষি জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেছে- ধানের চারা রোপণ, আগাছা দমন, ধানকাটা , মাড়াই ও শুকানো কাজেই উৎপাদন ব্যয়ের একটা বড় অংশ ব্যয় করতে হয় কৃষকে। এসব ক্ষেত্রে যদি কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে কৃষকের উৎপাদন খরচ অনেক হ্রাস পাবে , সময় সাশ্রয় হবে এবং ফলনও বৃদ্ধি পাবে। তাই কৃষিকে বাঁচিয়ে লাখতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দিতে হবে প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তা। পরিবেশের ভারসম্যা রক্ষা এবং নিরাপদ খাদ্যশস্য, শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্য রাাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের পরিবর্তে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত। আমদানি খরচ যাই হোক না কেন আগামী বছরেও রাসায়নিক সারের বিক্রয় মূল্য অপরিবর্তিত রাখা হবে ও কৃষি প্রণোদনা অপরিবর্তিত থাকবে বলে বাজেটে বলা হয়। এজন্য কৃষি খাতের প্রধান উপকরণ সমূহ বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি আমদানিতে শূণ্য শুল্ক হার অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে রেয়াতি শুল্ক হারও অব্যাহত রাখা হয়েছে।
এবারের বাজেটে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষি খাতে। সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে জন প্রশাসন খাতে। এখাতে বরাদ্দের পরিমাণ মোট বাজেটের ১৮. ৫%। এর পর সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে, যার পরিমাণ মোট বাজেটের ১৫.২ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অপর দিকে প্রস্তাবিত বাজেটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন খাতে গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বাজেটের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই খাতে গত বছর বাজেট বরাদ্দ ছিল ৮৮৪ কোটি টাকা। এ বছর তা দ্বিগুণ করে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ উন্নয়ন খাতে পরিচালন এবং উন্নয়নে মোট ২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছর এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা । বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে গবেষণার মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট চারটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তর এবং পিপিআর রোগ দমনে কার্যকর মডেলের সম্প্রসারণ, প্রাণী খাদ্য সংরক্ষণে ডোল পদ্ধতির সম্প্রসারণ, বিভিন্ন বিষয়ে ৩৫ টি গবেষণা বাস্তবায়নসহ আঞ্চলিক কেন্দ্রে ল্যাবরেটরি স্থাপন ও প্রশিক্ষণ প্রদানের কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।
পাবনা, রাজশাহী , নাটোর ও যশোরের অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক দীর্ঘ জলাবদ্ধতার কারণে ফসলের কাঙ্খিত ফলন থেকে বঞ্চিত হন। এসব এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্যও বাজেটে সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকা উচিত। এবারের বাজেটে নদী ভাঙ্গন ও নদীর নাব্যতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হলেও জলাবদ্ধতা নিরসনের মতো কৃষির একটি গুরুত্বপূর্র্ণ বিষয়ের ওপর বাজেট বরাদ্দের কোনো সুখবরের কথা আমাদের জানা নেই। নদীমার্তৃক বাংলাদেশে নদী ভাঙ্গণ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।কিন্তু সেই ঘটনায় যদি মানুষ কৃষি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। বাস্তুচ্যুত হয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন, তা হলে তাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করার কোনো সংগত কারণ নেই। এটা ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রাম। প্রতি বছরই নদী ভাঙ্গনে বিপুল সংখ্যক মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তাই নদীভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বাজেটে এবার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।এটা বাজেটের একটা ভাল দিক। পাশাপাশি নদীর নাব্যতা বাড়ানো, ভাঙ্গন হ্রাস, শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০২২ সালের মধ্যে ৫১০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিংসহ সেচ সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে বাজেটে জাননো হয়।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় কৃষকের জন্য আলাদা ‘কৃষি বাজার’ প্রতিষ্ঠা, কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে হিমাগার ও খাদ্যগুদাম নির্মাণের ব্যাপারেও বাজেটে দিক নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল। এছাড়া ক্রমবর্ধমান নগরবাসীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি নগরে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়েও কোনো দিক নির্দেশনা নেই এই বাজেটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষকদের বাঁচানোর জন্য এবারের বাজেটে পরীক্ষামূলকভাবে শস্যবিমা চালুর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সরকারের গবাদিপশু বিমা চালু করারও পরিকল্পনা আছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের কৃষিযন্ত্রে স্থানীয় ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া এবং ফসল মাড়াই যন্ত্রের কর কমানোর কথাও বলা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়।
সরকার প্রতিবছর কৃষি খাতে সার ,সেচ ও বিদ্যুতে ভুর্তকি ,নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। ব্যয়িত অর্থের সিংহভাগই খরচ হয় প্রভাবশালী ও রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বড় কৃষকদের পেছনে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক সব সময় সরকারের এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। থাকেন উপেক্ষিত । দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককেরাই পারিবারিক শ্রম ও নিজস্ব মেধা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কৃষিকে। তাঁদের একর প্রতি ফলন বেশি। তাঁরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী এবং কৃষির মূল চালিকা শক্তি । তাই কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারে -এসব ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সরকারি ভর্তুকি ও প্রণোদনার সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।