কৃষিবিদ নিয়াজ মুর্শীদ
বাংলাদেশে ফল আর্মিওয়ার্ম :ফল আর্মিওয়ার্ম (স্পোডোপটেরা ফ্রুজিপারডা), লেপিডোপটেরা গোত্রের একটি মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা যার সর্বাধিক ক্ষতিকর স্টেজ হলো “লার্ভা স্টেজ”। এটি ভুট্টা, সরগম, ধান, আখ, তুলা, বাধাকপি সহ প্রায় ৮০ প্রজাতির ফসলের ক্ষতি করে থাকে। পোকাটির উৎপত্তি মূলত আমেরিকার ট্রপিক্যাল ও সাব-ট্রপিক্যাল অঞ্চল থেকে এবং জে ই স্মিথ ১৭৯৭ সালে সর্বপ্রথম এই পোকা নিয়ে আলোচনা করেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ২০১৬ সালে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় এবং ২০১৮ সালে ইয়েমেন ও ভারতে এই পোকা সনাক্ত করে। ২০১৮ সালে ভারতে ভুট্টা ও সরগম ফসলে এই পোকার আক্রমনে প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে ২০ শতাংশ ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ভারতের বিভিন্ন কৃষি সংস্থা ভারত, বাংলাদেশ সহ ভিবিন্ন দেশে এই পোকা দ্রুত ছড়িয়ে পরার সতর্কতা জারি করে। গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর থেকে গত ১৩-০৮-২০১৮ তারিখে সতর্কতা পত্র জারি করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের রংপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া ও যশোরের বাঁধাকপির জমিতে এবং বগুড়া ও চুয়াডাঙ্গায় ভুট্টার জমিতে এই পোকার উপস্থিতি সনাক্ত করা হয়েছে।
ক্ষতিকর এই ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার পুর্নাঙ্গ জীবনকাল প্রায় ৩০-৪৫ দিন যা শীতকালে ৮০-৯০ দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। যার মধ্যে সবথেকে ক্ষতিকর স্টেজ লার্ভার জীবনকাল ১৪-২৮ দিন।
ফল আর্মিওয়ার্মের পুর্নাঙ্গ পুরুষ পোকা দেখতে হালকা সবুজ থেকে বাদামি বর্ণের। সামনের পাখায় হালকা থেকে গাঢ় দাগ রয়েছে এবং প্রত্যেক সামনের পাখায় একটি করে সাদা দাগ রয়েছে। পিছনের পাখা সচ্ছ ও চিকন গাঢ় বাদামি বর্ণের বর্ডার রয়েছে। একটি পুর্নাঙ্গ স্ত্রী পোকা ১৫০০-২০০০ ডিম পারে।
ফল আর্মিওয়ার্মের লার্ভার মাথায় উল্টা ইংরেজি ওয়াই (Y) এর মত দেখতে কালো দাগ রয়েছে এবং পিছনের অংশে চারটি কালো ডট এর মত দাগ রয়েছে। পুর্নাঙ্গ লার্ভা ১.৫-২ ইঞ্চি লম্বা হয়।
লার্ভা গাছের পাতা খেয়ে ক্ষতি করে থাকে। পাতায় ছিদ্র দেখা যায়। ভুট্টার ক্ষেত্রে চারা গাছ, বড় গাছের মাথার কচি অংশ, ভুট্টার মোচা ও দানা খেয়ে ক্ষতি করে থাকে।
দমন পদ্ধতিঃ পোকা মুক্ত থাকতে ফসলের আগাম চাষ করতে হবে। বীজ রোপণের পূর্বে ভালভাবে জমি চাষ করতে হবে, ফলে পোকার ক্রিড়া মারা যাবে। ফসল বিন্যাশ ও ফসল পর্যায় মেনে চাষাবাদ করতে হবে। ফসল কর্তনের পরে অবশিষ্ট অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
মাঠে পোকার ক্রিড়া দেখা গেলে তা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে। ফল আর্মিওয়ার্ম আক্রান্ত মাঠে বন্ধু পোকা বা উপকারি পোকা ট্রাইকোগ্রামা অবমুক্ত করতে হবে। মাঠে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। এনপিভি (নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস) সমৃদ্ধ জৈব বালাইনাশক স্প্রে করেও এই পোকা দমন করা সম্ভব।
ফল আর্মিওয়ার্মের পুর্নাঙ্গ মথ এক রাতে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে। ফলে এটি দ্রুত ছরিয়ে পরার আসংখা করা হচ্ছে। ট্রপিক্যাল ও সাব-ট্রপিক্যাল আবহাওয়া এই পোকার জন্য উপযুক্ত হওয়ায় এবং সারা বছর ব্যাপি ফসলের ক্ষতি করায় পোকাটি বাংলাদেশের কৃষির জন্য হুমকি স্বরূপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই পোকার কার্যকর দমন ব্যাবস্থা নিয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র সহ ভিবিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ইস্পাহানি এগ্রো লিমিটেড ইতিমধ্যে এই পোকা দমনে সর্বাধিক কার্যকরী ব্যাবস্থা সেক্স ফেরমন ফাঁদের গবেষণা অব্যাহত রেখেছে । এ ছাড়াও উক্ত পোকা দমনে কার্যকর ফেরোমন ট্র্যাপ “ফল আর্মিলিউর”, জৈব বালাইনাশক এস-এনপিভি ও বন্ধু পোকা “ব্রাকন হেবিটর” বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইমেইলঃ niaj.mursheed@gmail.com