বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের নানা দিক ও সাফল্য গাঁথা

বিটি বেগুন চাষের নানা দিক

ড. মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন*

বিটি বেগুন চাষের নানা দিক
বাংলাদেশে যত সবজি চাষাবাদ হয় তার একটি বড় জায়গা দখল করে আছে বেগুন। এ দেশে বেগুন প্রধানতঃ দু’মৌসুমে যেমন রবি ও খরিপ মৌসুমে চাষাবাদ করা হয়। রবি ফসলের চাষাবাদ শুরু হয় অক্টোবর মাস থেকে, আর খরিপের চাষ শুরু হয় এপ্রিল মাস থেকে। তবে বেগুন প্রধান মৌসুম হলো রবি মৌসুম। রবি মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৩২০০০ হেক্টর জমিতে বেগুনের চাষ হয়, আর খরিপে মাত্র ১৮০০০ হাজার হেক্টর। হেক্টর প্রতি ফলন রবি মৌসুমে প্রায় ৩০-৩৫ টন এবং খরিপ মৌসুমে মাত্র ২০-২২ টন। রবি মৌসুমের তুলনায় খরিপ মৌসুমে বেগুনের চাষাবাদ অনেক ঝামেলাপূর্ণ। খরিপ মৌসুমে প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কারণে বেগুনের চাষাবাদ দারুনভাবে ব্যাহত হয়। অন্যদিকে রবি মৌসুমে বেগুনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক কম। ফলে ফলনও অনেক বেশি। খরিপ মৌসুমে একমাত্র মাঝারী উচু থেকে উচু জমিতে বেগুনের চাষাবাদ করা হয়। বাংলাদেশে বেগুন তরকারী হিসাবে ব্যবহার করে না এমন পরিবার পাওয়া কঠিন। বাংলাদেশে নানান জাত, নানান সাইজ ও রংগের বেগুন পাওয়া যায়। তবে পুষ্টির দিক দিকে বড় ধরনের তারতম্য নেই।

পুষ্টিমানের দিক দিয়ে বেগুনের অবস্থার অন্যান্য সবজির তুলনায় বেশ ভাল। বেগুনের ব্যবহার অন্যান্য সবজি থেকে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে। যেমন: রমজান মাসের ইফতারীতে বেগুনী ভাজা সব খাবারকে উতরীয়ে যায়। বেগুন যেমনি সহজলভ্য তেমনি সহজপেচ্য। বেগুন ব্যবহারকারীদের অভিযোগ একটাই যে বেগুনের ভিতর পোকার কিরা পাওয়া যায়। অনেক সময় উপর দিয়ে নজরে পড়ে না। কিন্তু কাটলে পরে ভিতরে কিরা পাওয়া যায়। এটি মূলত: বেগুনের সবচেয়ে বড় শত্রু। এটি হলো ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। এ পোকা গাছের ডগা নষ্ট করে দেয়। আবার ফল ছিদ্র করে ফলনের ক্ষতি করে। বেগুনের আরো অন্যান্য ক্ষতিকর পোকা আছে যেমন, জাবপোকা, জেসিড, সাদা মাছি, মাইট ইত্যাদি। এ সকল পোকা পাতা ও গাছের কান্ড থেকে রস চুষে খায় এবং এক পর্যায়ে গাছটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ফলে ফলন দারুনভাবে কমে যায়। এদের আক্রমণে কখনও কখনও গাছ মারা যায। শুধু পোকার হাত থেকে ফলন বাঁচানোর জন্য বেগুন চাষীরা বেগুন গাছে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে থাকে। বেগুন চাষীদের সাথে আলাপ করে জানা যায় একমাত্র পোকার আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচাতে মোট উৎপাদন খরচের প্রায় ৫০% রাসায়নিক দ্রব্য ছিটাতে ব্যয় করেন। এরমধ্যে প্রধান হলো ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। পৃথিবীতে বেগুন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। পৃথিবীর অনেক দেশেই বেগুনের চাষাবাদ হয় এবং ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমন সর্বত্র বিদ্যমান। শুধু এ পোকার আক্রমনের দারুন বেগুন চাষীরা দারুনভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন।

বাংলাদেশের অনেক বেগুন চাষী প্রতিদিন সকাল-বিকাল ২ বার বেগুন গাছে রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে থাকে। এমন চিত্রও বিরল নয় যে রাসায়নিক দ্রব্য ছিটানোর এক ঘন্টার মধ্যে বেগুন ভোক্তার হাতে চলে যাচ্ছে এবং খাবারের টেবিলেও চলে আসছে। এক ভয়াবহ বিষয়। রাসায়নিক দ্রব্য সরাসরি খেয়ে ফেলা হচ্ছে। এই ভয়াবহ চিত্র অনুধাবনকল্পে এবং বেগুন ফসলকে পোকার আক্রমন থেকে রক্ষা করতে বহু গবেষণার ফসল হলো বিটি বেগুন। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এমন একটি পন্থা বের করছেন যাতে বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমন থেকে কৃষকের মূল্যমান বেগুন ফসলকে রক্ষা করা যায়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে আমেরিকার কর্নেল বিশ^বিদ্যালয় এবং ইন্ডিয়ার মাহিকোর সহযোগিতায় ইঃ বেগুনের উপর গবেষণা শুরু করে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৪টি বেগুনের জাতকে ইঃ বেগুন জাত হিসাবে কৃষকের মাঠে চাষাবাদের জন্য অবমুক্তি দেওয়া হয়। এরপর থেকে এ চারটি ইঃ বেগুনের জাত কৃষকের মাঠে চাষের জন্য বীজ উৎপাদন কার্যক্রম বারি হাতে নেয় এবং সাথে সাথে বারি’র তত্ত্ববধানে কৃষকের মাঠে চাষাবাদ শুরু করে। সরেজমিন বিভাগ মাঠে BT বেগুন চাষের বিষয়টি পরিচালনা ও তদারকি করার দায়িত্ব নিয়ে ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ সালে পর পর চার বছর কৃষকের মাঠে BT বেগুন চাষাবাদে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। চার বছরে মোট ১১০টি জিলায় মোট ১৪৩৯ জন কৃষকে BT বেগুন চাষাবাদ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেছে। এ কার্যক্রমের আওতায় কৃষকের মাঠ থেকে বহু তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

২০১৬-২০১৭ সালে বিটি বেগুন-৪, ২১ টি জিলায় কৃষকের মাঠে লাগানো হয়। এর মধ্যে বেশীর ভাগ জিলাতে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমন দেখা যায়নি। মোট ৫টি জিলাতে এ আক্রমন দেখা গেছে, যার সর্বোচ্চ মান ছিল ফেনিতে, মাত্র ২.৯০% ডগা এবং ২.০% ফল। অন্যদিকে, প্রচলিত বেগুন জাতে এর মাত্রা ছিল যথাক্রমে ১০.৫৫% ডগা, ২৭.৬৯% ফল (সংখ্যা) ও ৪৫.৭৬% ফল (ওজনে)। এ থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, ওজন হিসাবে প্রচলিত জাতে ফলন প্রায় অর্ধেক কম। ফলনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, BT বেগুন ফসলের সর্বোচ্চ ফলন রাজশাহী বরেন্দ্র এলাকায়, ৩৬.২৪ টন প্রতি হেক্টরে। যে কোন ফসলের ফলনের মাত্রা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তাই জিলা ভিত্তিক ফলনে এত তারতম্য। গড় ফলনে দেখা যায় BT বেগুনের ফলন যেখানে হেক্টর প্রতি ২২.০৮টন সেখানে নন বিটি বেগুনের ফলন মাত্র ১৪.৮৬ টন। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায়, ইঃ বেগুন ও নন-বিটি বেগুনের চাষাবাদ খরচ প্রায় সমান, যথাক্রমে হেক্টর প্রতি টা: ১২০৭১৮.০০ এবং টা: ১১৯৬৭৮.০০ মাত্র।

জিলা ভিত্তিক চাষাবাদ খরচের তারতম্য আছে। তারমধ্যে অন্যান্য পোকার আক্রমন, ঘাসের উপদ্রপ, শ্রমিক খরচ, ইত্যাদি। তাতে অনেকটাই হেরফের দেখা যায়। বেগুনের বাজার বিবেচনায়, BT বেগুনের চাহিদা প্রচলিত বেগুনের তুলনায় অনেক বেশী। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, পোকার আক্রমন হেতু বাজারে বেগুন বাছাই করতে হয় না। এতে করে কৃষকের কষ্ট কম হয় এবং পাইকারদেরও প্ররিশ্রম করে বাছতে হয় না। জয়পুরহাটে একজন BT বেগুন কৃষকের সাথে আলাপ করে জানা যায় যে, বেগুনের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং এ পোকার আক্রমণ থেকে বেগুন ফসল বাঁচাতে মোট উৎপাদন খরচের প্রায় ৫০% খরচ হয় কিটনাশক ছিটাতে। তারপরও পোকা আক্রান্ত বেগুন মাঠ থেকে তুলতে হয়। শুধু তাই নয়, এ সকল কীটনাশক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরুপ। তার উপর পরিবেশ দূষনতো আছেই। অর্থনৈতিক বিবেচনায়, BT বেগুনের অবস্থান নন-বিটি বেগুনের চেয়ে অনেক ভাল। এদের উৎপাদন খরচ হেক্টর প্রতি সমান হলেও, আয়ের ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য। BT বেগুনের ক্ষেত্রে গড়ে হেক্টর প্রতি আয় টা: ৩,৯০,৮৮০.০০, অন্যদিকে নন-বিটির ক্ষেত্রে মাত্র টা: ২,১১,৩৪২.০০। এতে নীট আয় যথাক্রমে টা: ২৭০১৬১.০০ এবং ৯১৬৬৪.০০। এ থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, বেগুনের জন্য ১০০ টাকা খরচ করে ৩২৩ টাকা পাওয়া যায়। লাভ শতকরা ২২৩.০০টাকা। অন্যদিকে, নন-বিটি চাষে ১০০.০০ টাকা খরচ করে ১৭৬ টাকা পাওয়া যাবে। লাভ শতকরা ৭৬.০০ টাকা। উপরের চিত্র থেকে BT বেগুন চাষে উপকারীতা ও অর্থনৈতিক সাফল্যতার একটি ভাল চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।

*লেখকঃসাবেক পরিচালক,বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট,গাজীপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *