এম এনামুল হকঃ
সৌদি খেজুর পৃথিবীর সব চেয়ে প্রাচীনতম ফল। প্রধাণত: পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকা দেশগুলোতে এ ফলের চাষ প্রচলন বেশি। অনেকের মতে ইরাক অথবা মিসর খেজুর ফলের আদি স্থান। প্রাচীন কাল থেকে খেজুর ফলের বাগান সৃষ্টি করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত খাদ্য ও ফলের উৎস হিসাবে খেজুর মানুষের জীবন ধারনের অন্যতম অবলম্বন ছিল। আরব দেশগুলোর মরুভূমি এলাকায় যেখানে অন্য কোন গাছ-পালা জন্মানো সহজ হয়না সেখানে খেজুর বাগান সৃষ্টি করে মরুদ্যান সৃষ্টি করা হতো। সৌদি খেজুর যে সব দেশে বেশি চাষ হয় তার মধ্যে মিশর, সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, ওমান, লিবিয়া ও তিউনেশিয়া অন্যতম। অধুনা চীন, ভারত ও আমেরিকার কিছু অংশে সফলভাবে খেজুর চাষ করা হচ্ছে। রমজান মাসে সৌদি খেজুর দিয়ে ইফতারী করার প্রচলন মুসলিম দেশগুলোতে বিরাজমান। বাংলাদেশসহ সকল মুসলিম দেশ প্রচুর খেজুর আমাদনী করে অথবা নিজেদের উৎপাদন থেকে রমজান মাসে প্রচুর খেজুরের চাহিদা পূরন করে থাকে।
বাংলাদেশের বৃহত্তর ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশালসহ সারা দেশে কম-বেশি খেজুর চাষ করা হয়। তবে এ দেশী জাতের খেজুর মূলত: রস ও গুড় তৈরীর কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। দেশী জাতের খেজুর গাছে যে পরিমাণ ফল ধরে তা উন্নত মানের নয়, তাই ফল হিসাবে আহার করার তেমন প্রচলন নেই। এ দেশের আবহাওয়া সৌদি খেজুর চাষ করার যথেষ্ট সম্ভাবনা বিরাজ করছে। গত ১৫-২০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকার কিছু আগ্রহী চাষী সীমিত আকারে খেজুর চাষ করে সফল হয়েছে। তবে তারা কেবল মাত্র তা বীজ থেকে তৈরী বাগান করায় তাতে জাতের গুণাগুণ রক্ষা হয়না। আধুনিক সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও পরাগায়নে সক্ষমতার অভাবে খেজুর গাছ থেকে ফলন কম পেয়ে থাকে। সম্ভাবনাময় এ খেজুর চাষে গবেষণা বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান এতদিন এ ফল চাষে আগ্রহ হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সরকারী ভাবে প্রথম সৌদি দেশ থেকে উন্নত জাতের খেজুর কলম আমদানী করে বিভিন্ন জেলার হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে সৌদি খেজুরের বাগান সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক গাছ ফুল ধরা অবস্থায় এনে ফেব্রুয়ারী-২০১৭ মাসে রোপন করা হয়েছে, তাতে ফল ধরা আরম্ভ করেছে। এ পর্যন্ত মে,২০১৭ মাস পর্যন্ত মোট ৬২৫ টা বিভিন্ন উন্নত ১৫ জাতের খেজুর গাছ আমদানী করে বাংলাদেশের ২৫ টা হর্টিকালচার সেন্টারে এবং ২৫ জন আগ্রহী কৃষকের জমিতে সৌদি খেজুরের চাষ পরিকল্পিত ভাবে শুরু করা হয়েছে। অচিরেই বাংলাদেশ সৌদি খেজুর উৎপাদনে সফলতা অবশ্যই অর্জন করবে।
আবহাওয়া ও মাটি ঃ ট্রপিক্যাল ও সাব ট্রপিক্যাল এলাকার দেশগুলোতে সৌদি খেজুর চাষের জন্য উপযোগী। পর্যাপ্ত রোদ, কম আর্দ্রতা, শুকনা ও কম বৃষ্টিপাত, উষ্ণ আবহাওয়া এ ফল চাষের জন্য উপযোগী। সৌদি খেজুর ১৩০-২৮০ সেলসিয়াস তাপ মাত্রায় ভাল বাড়ে এবং ৫০০ সেলসিয়াম পর্যন্ত গরম তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। বেশি শীত এবং সাময়িক জলাবদ্ধতা ও লবনাক্ত সহিষ্ণু গুণাগুণ এ গাছের আছে। ফুল ফোঁটা ও ফল ধরার সময় বেশি বৃষ্টিপাত ভাল না, ২১০-২৭০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা এ সময় বেশি উপযোগী। একই কারণে এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এবং পার্বত্য জেলাগুলোতে সৌদি খেজুর চাষ সম্প্রসারণ করার সুবিধা বেশি বিরাজমান।
বেলে-দোঁআশ মাটি এ জাতের খেজুর চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে মাটি অনুকূল না হলে রোপনের আগে গর্তের মাপ বড় করে (র্৬দ্ধর্৬ দ্ধর্৩ ) তৈরী করে তাতে প্রচুর জৈব পদার্থ ও বেলে মাটি দিয়ে তা ভরাট করে নিয়ে খুব সহজেই মাটিকে উপযোগী করে নেয়া যায়। পানি নিষ্কাশন সুবিধা আছে এমন অপেক্ষাকৃত উচ্চ জমি এ ফল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে মাটির উপরের স্তরে র্৬ -র্৭ ফুটের মধ্যে হাডপ্যান থাকলে গর্ত তৈরী কালে সাবল দিয়ে তা ভেঙ্গে দিতে হবে।
পুষ্টিমান ঃ খেজুর অতি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফল। এতে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস ও ক্যালোরি সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য হিসাবে খেজুরের জুড়ি নেই। বিশ্বের মুসলমানদের নিকট খেজুর একটা স্বর্গীয় ফল হিসাবে বিবেচিত। এ ফলের ঔষুধীগুণ খুব বেশি। ইহা আহারে হজম শক্তি বাড়ায়। রক্ত স্বল্পতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, এলার্জী ও ক্যানসার রোধক হিসেবে কাজ করে। খেজুর আহারে দেহে শক্তি জোগায়, হার্টকে সুস্থ রাখে, দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি করে, দেহের হাড় ও দাঁতকে মজবুত রাখে। রক্ত শূন্যতা, গলা ব্যাথা, ডায়রিয়া, সুস্থ গর্ভ ধারন ও জন্ম নিয়ন্ত্রণে এ ফল অতি উপকারী।
জাত ঃ পৃথিবীতে প্রায় এক হাজারের বেশি খেজুরের জাত রয়েছে। সৌদি দেশগুলোতেই এ জাতের সংখ্যা চারশতকের বেশি। যেহেতু তাল ও লটকন গাছের ন্যায় খেজুরের পুরুষ-স্ত্রী গাছ আলাদা ভাবে জন্মায়, এ জন্য বীজ থেকে তৈরী গাছে প্রাকৃতিক ভাবে নতুন জাতের সৃষ্টি অহরহ হয়ে থাকে। তবে বীজ থেকে তৈরী চারায় প্রকৃত জাতের গুণাগুণ থাকেনা। ফল ধরতে বেশি সময় লাগে, ফলের পরিমাণ ও মান আশাপদ হয় না। যে সব জাতের খেজুরের জনপ্রিয়তা বেশি এগুলোর মধ্যে বারহি, মেডজল, সামরান, খাতরাই, জাহেদী, খালাস, মরিয়ম, নিমেশি, আনবারাহ, জাম্বেলী, শিশি, লুলু, সুলতানা, আজুয়া, ইয়াবনি, ডিগলিটনূর, আসমাউলহাসনা অন্যতম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর,এ পর্যন্ত ১৭ টা আধুনিক উন্নত জাতের খেজুর কলম আমাদনী করে বিভিন্ন জেলায় বাগান সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
বংশ বিস্তার ঃ আরব দেশগুলো আগে পছন্দমত জাতের কান্ড থেকে গজানো সাকার বা চারা সংগ্রহ করে তা দিয়ে বাগান সৃষ্টি করতেন। এ ছাড়া বীজের চারা দিয়েও খেজুর বাগান সৃষ্টি করার প্রচলন ছিল। তবে অধুনা টিস্যুকালচার পদ্ধতি অবলম্বনে উন্নত জাতগুলোর প্রচুর কলম তৈরী করে তা ব্যবহার জনপ্রিয়তা অত্যাধিক হারে বেড়ে চলেছে। পুরানো পদ্ধতি অবলম্বনে কান্ড থেকে প্রাপ্ত চারা কম পাওয়া যেত। বীজ থেকে তৈরী চারার গাছে ফল দিতে প্রায় ৬ বছর সময় লাগে। খেজুর গাছের কান্ড থেকে প্রাপ্ত চারা এবং টিস্যুকালচারের মাধ্যমে তৈরী চারা রোপনের ৩ বছর পর থেকেই গাছে ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করে। এখন টিস্যুকালচারের মাধ্যমে কোটি কোটি খেজুর চারা উৎপাদন কাজে কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত থাকার কারণে উন্নত জাতের বাগান সৃষ্টি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যান্য দেশগুলোও এর সুফল ভোগ করছে। পরিতাপের বিষয় এদেশে ১৫-২০ বছর ধরে যারা সীমিত আকারে খেজুর চাষ করছে তা বীজের তৈরী চারা দিয়ে এতে ভাল জাতের প্রকৃত গুণাগুণ বজায় থাকে না। ফলের মান ও ফলন ভাল হয়না।
জমি নির্বাচন ও রোপন দূরত্ব ঃ পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত অপেক্ষাকৃত উঁচু প্রচুর আলো-বাতাস পায় এমন জমি খেজুর বাগান স্থাপনের জন্য নির্বাচন করা দরকার। বাগান তৈরীর জন্য ২র্০ দূরত্বে সারি করে ২র্০ ফুট দূরে দূরে (২র্০ দ্ধ২র্০) চারা রোপনের জন্য খেজুর বাগান “লে-আউট” প্লান শুরুতেই তৈরী করে নেয়া প্রয়োজন। কেবল মাত্র এক বা দু’সারি গাছ লাগানোর প্রয়োজনে ১র্৫-১র্৭ ফুট দূরত্ব দিলেই চলবে। বর্ষাকালে ১র্০র্ -১র্২র্ ইঞ্চি পানি জমে থাকে এমন নিচু স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে সার্জন পদ্ধতি অবলম্বনে বাগান সৃষ্টি করা সহজ । এ ক্ষেত্রে দু’ সারির মাঝে র্৭ -র্৮ ফুট চওড়া এবং র্২ -র্৪ ফুট গভীর নালা কেটে উভয় পার্শে¦্ গর্তের মাটি উঠিয়ে দিয়ে ১র্০ -১র্২ ফুট চওড়া উঁচু বেড় তৈরী করে নিয়ে সে বেডে খুব সহজেই সফল ভাবে খেজুর বাগান সৃষ্টি করা যায়। এমন নিচু জমি ভূমি উন্নয়ন খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন হয়না। ইতিমধ্যে বরিশাল জেলাস্থ রহমতপুর হর্টিকালচার সেন্টারে এ পদ্ধতি অবলম্বনে ৭২ টা খেজুর গাছ বিশিষ্ট খেজুর বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। এ বাগানের গাছের বাড়-বাড়ন্ত খুব উৎসাহজনক যা আগামী দিনে উপকূলীয় জেলাগুলোতে সৌদি খেজুর চাষ সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য মডেল হিসাবে কাজ করবে।
গর্ত তৈরী ও তা ভরাটকরণ ঃ রোপিত গাছের শিকড় যেন ঠিকমত ছড়াতে পারে এ জন্য র্৬ ফুট চওড়া ও র্৩ ফুট গভীর (র্৬ দ্ধর্৬দ্ধ র্৩ ) করে গর্ত তৈরী করে নিয়ে তা এক সপ্তাহ রোদ খাওয়ানোর পর, এ গর্ত সার ও মাটি দিয়ে পুনরায় ভরাট করে নেয়া প্রয়োজন। তৈরীকৃত গর্তে খড়কুটা দিয়ে ভরাট করে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হলে গর্তের মাটি অনেকটা শোধন করা যাবে। খেজুর চারা রোপনের আগে গর্ত ভরাট করার জন্য যে সব সার ও উপাদান মিশানো প্রয়োজন তা হলো ঃ মোটা বালু (সিলেট স্যান্ড) ৩০%, পচা গোবর বা আবর্জনা পঁচা সার ৪০% এবং ভিটে মাটি বা বেলে দোঁআশ মাটি ৩০%, এ ছাড়াও এতে আরও মেশাতে হবে ১০-১৫ কেজি কোকোডাষ্ট বা নারিকেলের ছোবড়ার গুড়া, সমপরিমাণ কেঁচো সার। এতে আরও মেশাতে হবে ঃ হাড়ের গুঁড়া- ১ কেজি, রাসায়নিক সার ঃ ইউরিয়া- ৩০০ গ্রাম, টিএসপি- ৪০০ গ্রাম, এমওপি- ৫০০ গ্রাম। এছাড়া জিঙ্ক সালফেট, ম্যাগ সালফেট এবং বোরন- প্রতিটা ১০০ গ্রাম করে মোট ৩০০ গ্রাম মেশানো প্রয়োজন। রোগ বালাই প্রতিহত করার জন্য উপযোগী ছত্রাক নাশক ও দানাদার কীট নাশক ১০০ গ্রাম করে মোট ২০০ গ্রাম এতে মেশাতে হবে। এ সব একত্রে মিশেয়ে তৈরীকৃত গর্ত ভরাট করে পানি দিয়ে কয়েক দিন ভিজিয়ে রাখতে হবে। এ ভাবে গর্ত ভরাট করার দু’সপ্তাহ পর তা গাছ রোপনের জন্য উপযোগী হবে।
চারা রোপন প্রণালী ঃ খেজুরের চারা সরেজমিন থেকে এক ফুট উপরে রোপন করতে হবে। এ জন্য গর্ত ভরাট করা মাটি উঠিয়ে মধ্যভাগ উঁচু করে নিতে হবে। অর্থ্যাৎ চাড়ি বা গামলাকে উল্টিয়ে স্থাপন করা হলে যে রকম মধ্য ভাগ উঁচু হবে তেমন ভাবে উঁচু করে মাঝ খানে চারা রোপন করতে হবে। এরপর ক্রমান্বয়ে তা বাইরের দিক ঢালু করে নালা বরাবর মিলাতে হবে। গাছ রোপন করা হলে গাছের গোড়া থেকে ২১/২ ফুট দূরে সার্কেল (বৃত্তাকার) করে ১র্০র্ -১র্২র্ ইঞ্চি চওড়া ও ১র্২র্ ইঞ্চি গভীর নালা তৈরী করে এ নালার মাটি বাইরের দিক সুন্দর ভাবে বৃত্তাকারে উঁচু আইল বেঁধে দিতে হবে। গাছ রোপন শেষে এ নালায় ৮-১০ দিনের ব্যবধানে পানি দিয়ে নালা ভর্তি করে দিতে হবে। গাছ পরোক্ষভাবে প্রয়োজনীয় এ নালার পানি শুষে নিবে। গাছ রোপন কালে খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রতিটা গাছ সমান লেবেল বা উচ্চতায় থাকে।
পানি নিষ্কাশন ও সেচ ঃ বর্ষাকলে যেন বাগানে কোন মতেই পানি না জমে এ জন্য পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখতে হবে। খরা মৌসুমে নিয়মিত গাছের গোড়ার চারধারে পানি সেচ দিয়ে ভাল ভাবে ভেজাতে হবে। মাটিতে রসের অবস্থা বুঝে ৭-১৫ দিনের ব্যবধানে নালা ভর্তি করে পানি সেচ দিয়ে গাছের প্রয়োজনীয় রসের অভাব দূর করতে হবে। ভালভাবে গাছের বৃদ্ধি, বেশি উন্নত মানের ফল প্রাপ্তি, প্রয়োজনীয় পানি সেচ ও নিস্কাশন ব্যবস্থার উপর অনেকটা নির্ভর করে। বয়স্ক খেজুর গাছের শিকড় গোড়া থেকে প্রায় ৪-৫ ফুট বৃত্তাকারে চারদিকে র্৩-র্৪ ফুট গভীরতায় প্রবেশ করে। এ জন্য শুকনা মৌসুমে এ শিকড় ছড়ানো এলাকায় রসের অভাব দূরীকরণের ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।
মালচিং ঃ শুকনা মৌসুমে গাছের গোড়ার চারধারে র্২-র্৩ ফুট দূর পর্যন্ত বৃত্তাকারে খড়, লতা-পাতা বা কচুরী পানা দিয়ে মালচিং দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হয়। তাতে মাটির রস সংরক্ষিত থাকে এবং খেজুর গাছে ঘন ঘন সেচ দেয়ার প্রয়োজন হবেনা। মালচিং দেয়ার ফলে গাছের গোড়ার চারদিক আগাছামুক্ত থাকবে, পরিবেশ অনুকূল হবে, পরবর্তীতে এসব লতা-পাতা পঁচে জৈব সার হিসাবে কাজ করবে।
ট্রেনিং-প্রুনিং ঃ গাছ বড় হলে উপরি উর্দ্ধমূখী গাছের পাতা রেখে নি¤েœ ঝুলে পড়া পুরাতন মরা পাতা গুলো কান্ডের গোড়া থেকে র্৭র্ -র্৮র্ ইঞ্চি ছেড়ে ধারালো দা দিয়ে ছেঁটে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়াও উপরের দিকের অফলন্ত ফলের ছড়া ও ফুল-ফলের শক্ত ঢাকনা সাবধানে অপসারণ করতে হবে। সংগে সংগে কর্তিত অংশে ছত্রাক নাশক/বোর্দ মিক্সার পেষ্ট দিয়ে প্রলেপ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ছত্রাকের উপদ্রব না ঘটে।
পরিচর্যাঃ গাছ রোপন করে তা কাঁঠি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে সম্ভাব্য সোজা রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে এবং রোপিত গাছ হেলে পড়া রোধ করতে হবে। প্রথম কয়েক বছর কেবল মাত্র পাতা শুকালে তা ধারালো ছুরি বা সিকেচার দিয়ে অপসারণ করতে হবে। কোন মতেই গাছের কাঁচা পাতা অপসারণ করা উচিত হবে না। তবে বছরে একবার ফল সংগ্রহ শেষে নীচের দিকে ঝুলে পড়া বয়স্ক অপ্রয়োজনীয় পাতা অপসারণ করে গাছের জন্য আলো-বাতাস প্রাপ্তির সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। গাছের গোড়া ও কান্ড থেকে গজানো শাখা বাড়তে দিলে গাছে ফলদান ক্ষমতা কমে যাবে। তবে চারা সংগ্রহের প্রয়োজনে গোড়ার কাছাকাছি গজানো কিছু সংখ্যক সাকার রেখে অবশিষ্ট সাকারগুলো নিয়মিত ছেঁটে দিতে হবে।
সংগৃহীত চারা বেশি ছায়ায় সংরক্ষিত থাকার কারণে চারা রোপনের পর সূর্য্যরে তাপে খেজুর চারা ঝলসে না যায় এ জন্য রোপনের প্রথম ১০-১৫ দিন উত্তর-পূর্ব দিক উন্মুক্ত রেখে পাতলা ছালা দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ভালভাবে ঢেকে দিয়ে গাছকে হালকা ছায়া দেয়া প্রয়োজন হবে। বিকল্প ব্যবস্থায় গাছগুলোকে ১র্৮র্ বিশিষ্ট মাটির টবে উপযোগী পটিং মিডিয়া দিয়ে আধা ছায়ায় ২-৩ মাস সংরক্ষণ করে পরে সেগুলো বাগানে রোপন উপযোগী হবে।
সার প্রয়োগ ঃ সৌদি খেজুর গাছে ৪ মাসের ব্যবধানে নিয়মিত সার প্রয়োগ করা জরুরী। তাতে গাছ ভালভাবে বাড়বে, বেশি ফল দানে সক্ষম হবে। নারিকেল, সুপারীর মত এটা পামী গোত্রীয় “পটাশ লাভিং” গাছ। কাজেই এ গাছে তুলনায় পটাশ সার বেশি প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়। প্রতিটা বিভিন্ন বয়সের গাছে যে পরিমাণ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন তা হলো:
ক্রঃ নং সারের প্রকার গাছের বয়স
১ম বছর ২য় বছর ও তৃতীয় বছর ৪র্থ ও ৫ম বছর ৬ বছরের উর্দ্ধে
১। গোবর/আবর্জনা পাঁচা সার (কেজি) ১০-১৫ ২০-২৫ ৩০-৪০ ৫০-৬০
২। হাঁড়ের গুড়া ( কেজি) ১-১১/২ ২-২১/২ ৩-৩১/২ ৪-৪১/২
৩। ইউরিয়া ( গ্রাম) ৫০০-৭০০ ৮০০-১০০০ ১২০০-১৫০০ ২০০০-২৫০০
৪। টিএসপি ( গ্রাম) ৪০০-৫০০ ৬০০-৭০০ ৮০০-৯০০ ১০০০-১২০০
৫। এমওপি ( গ্রাম) ৭৫০-৮০০ ১০০০-১৫০০ ১৭০০-২০০০ ২০০০-৩০০০
প্রতি বছরের জন্য সুপারিশকৃত সারগুলো ৩ ভাগে ভাগ করে নিয়ে প্রতি ডোজ মে-জুন মাসে এক বার এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ও ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে আরও দু’বার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়াও অনু খাদ্যগুলো বিশেষ করে জিঙ্কসালফেট, ম্যাগ সালফেট, বোরন বছরে এক বার করে গাছের বয়স বিবেচনায় প্রতিটা অনুখাদ্য ২০০-৩০০ গ্রাম করে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। সার প্রয়োগ করার পরপরই ভালভাবে সেচ দিয়ে গাছের গোড়ার চারধারের মাটি ভালভাবে ভেজাতে হবে। গাছের গোড়া ছেড়ে যে অংশে শিকড় ছড়ায় সে অংশে সার প্রয়োগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন সার প্রয়োগ কালে গাছের শিকড় কম আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ইদানিং ঘচক বা ঘচকঝ মিশ্র সার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ভাল ব্যান্ডের এ ধরনের মিশ্র সার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে গাছের প্রথম অবস্থায় তুলনায় নাইট্রোজেন জাতীয় সার প্রয়োগ কিছু বেশি প্রয়োজন হয়। ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করলে পটাশ ও ফসফরাসের পরিমাণ বাড়াতে হবে। অনেকে অনুখাদ্য সমৃদ্ধ কোন কোন সার পানিতে গুলে যায় এমন সার প্রয়োগ করে গাছকে সুস্থ রাখে। এ ভাবে ফলিয়ার সার প্রয়োগ করা হলে কয়েক ঘন্টা পর গাছে পানি স্প্রে করে গাছকে ধুয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয়।
পোকা ও রোগ দমন ঃ নারিকেল, তাল ও খেজুর গাছের শিকড়ের অগ্রভাগ নরম ও মিষ্টি যা উই পোকাসহ মাটিতে অবস্থানকারী বিভিন্ন পোকা ও নিমাটোডকে আকৃষ্ট করে। এ জন্য মাটিতে ব্যবহার উপযোগী দানাদার কীটনাশক ও তরল কীটনাশক (ইমিডাক্লোরোপিড/ডার্সবান) দু’তিন মাসের ব্যবধানে নিয়মিত ব্যবহার করে মাটিতে অবস্থান কারী পোকা দমন ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া নারিকেল গাছের মত খেজুর গাছেও রাইনো বিটেল (গন্ডার পোকা), রেড উইভিল স্কেল পোকার উপদ্রব বেশি দেখা যায়। এ জন্য বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ইমিডাক্লোরোপিড অথবা ক্লোরোপাইরীফস দলীয় কীটনাশক দিয়ে ২-৩ সপ্তাহের ব্যবধানে কচি পাতা ও পাতার গোড়ার অংশ ভালভাবে স্প্রে করে ভেজানো হলে এ সব পোকার উপদ্রব থেকে গাছকে রক্ষা করা যাবে। খেজুর গাছে মাইটের উপদ্রব মাঝে মাঝে দেখা যায়। এ জন্য ২-৩ সপ্তাহের ব্যবধানে মাইট নাশক ব্যবহার করে গাছকে সুস্থ রাখা উচিত হবে।
রোগ ঃ মাটিতে অবস্থানকারী ছত্রাক, প্রুনিং করার কারণে ক্ষত স্থানে রোগ এবং গজানো পাতার সমগ্র অংশে কাল/বাদামী দাগ পড়া রোগের আক্রমণ খেজুর গাছে বেশি দেখা যায়। এ জন্য ম্যানকোজেভ/ কার্বোন্ডাজিম দলীয় বা বোর্দর্ মিক্সচার দিয়ে ছত্রাক নাশক দিয়ে ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে নিয়মিত পাতা,কান্ড ও মাটিতে স্প্রে করে গাছকে সুস্থ রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।
খেজুর গাছে পরাগায়ন ঃ তাল, লটকন ফল গাছের মত খেজুর গাছের পুরুষ ও স্ত্রী গাছ আলাদা ভাবে জন্মে (ডায়োয়সিয়াস)। এ জন্য সুস্থ, বড় ও ভাল মানের খেজুর ফল প্রাপ্তির লক্ষ্যে সময়মত ফুটন্ত স্ত্রী ফুলের ছড়া বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ গাছ থেকে সংগৃহীত পরাগ রেনু দিয়ে সময় মত পরাগায়ন করা অত্যাবশ্যক। প্রথমত: সুস্থ সবল বড় আকারের পুরুষ গাছ ফুল দানে সক্ষম এমন গাছ থেকে পুরুষ ফুল সংগ্রহ করে সাধারণ ফ্রিজে (২০-৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায়) সংরক্ষণ করা হলে তা দু’ বছর পর্যন্ত পরাগায়নের কাজে ব্যবহার করা হয। সৌদি খেজুর গাছে প্রধাণত: জানুয়ারী-মার্চ মাসে ফুল ফুটে। উভয় প্রকার ফুলের কাঁদি একটা শক্ত আবরণ দিয়ে সুন্দর ভাবে ঢাকা থাকে। শুরু থেকে ফুল ফোটার স্তরে পৌঁছতে প্রায় এক মাস সময় লাগে। আবরণের ভিতরে ফুল বড় হয়ে পরাগায়নের উপযোগী হলে বাইরের আবরণটা আস্তে আস্তে ফাটা শুরু হয়। এ অবস্থায় পুরুষ ফুলের কাদিটা ধারালো ছুরি বা সিকেচার দিয়ে অপসারণ করে নিয়ে খুব সাবধানে হালকা রোদে শুকিয়ে নিয়ে এ পরাগ রেনু (পাউডারের মত অতি ক্ষুদ্র কণা) সাবধানে আলাদা করে নিয়ে কাগজে মুড়িয়ে তা পলিথিন কভার দিয়ে ফ্রিজের নরমাল চেম্বারে সংরক্ষণ করতে হয়।
এরপর স্ত্রী খেজুর গাছের ফুলের কাঁদি বড় হয়ে বাইরের শক্ত আবরণে ফাটল ধরা আরম্ভ করলে তা পরাগায়ন করার উপযোগী হয়। এ সময় ফাটল ধরা শক্ত আবরণ ধারালো ছুরি দিয়ে অপসারণ করে ছড়ার ভিতরের অংশ বের করে দামী নরম তুলি বা ব্রাশ দিয়ে সামান্য পরিমাণ পাউডারী পরাগ রেনু দিয়ে পরম আদরে স্ত্রী ফুলে এ পরাগ রেনু হালকা ভাবে ছুয়ে বা ঝেড়ে দিতে হয়। এছাড়া পুরুষ ফুলের দু’একটা ছাড়া স্ত্রী ফুলের আগায় বেধে রাখতে হয়। পরে ৫-৭ দিনের ব্যবধানে আরও দু’এক বার এ পরাগায়ন কাজ অব্যাহত রাখতে হয়। পরাগায়ন করা ফুলের ছড়া পাতলা ব্রাউন কাগজের ঠোঙ্গা দিয়ে হালকা ভাবে ঢেকে দিতে হয়। এর ৩-৪ সপ্তাহ পর আবরণটা সরিয়ে ফেলতে হয়। পরাগায়ন কালে ছড়ার কাছাকাছি খেজুরের ছুঁচালো কাঁটাগুলো সিকেচার দিয়ে অপসারণ করে নিলে কাঁটার আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কয়েক দশক আগে কৃত্রিম উপায়ে পরাগায়ন করার প্রচলন খুব কম ছিল। বাগানে আনুমানিক হারে (প্রতি ১৫-২০ টা স্ত্রী গাছের জন্য একটা করে) পুরুষ গাছ রাখার কারণে বাতাসের ও মৌমাছি বা উপকারী কীট পতঙ্গের মাধ্যমে পরাগায়ন কাজ সমধা হতো। এতে ৬০-৮০ % ফল ধরানো সম্ভব হত।
ফল সংগ্রহ ঃ পরাগায়ন করার ৩-৪ মাস পর খেজুর ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়। কতগুলো জাতের পুষ্ট কাঁচা-পাকা ফল উভয় অবস্থায় খাওয়া যায়। অন্য জাতের ফল পরিপক্ক অবস্থায় বাদামী গাঢ় বাদামী/কাল রং ধারন করলে তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার বা বাজারজাত করা হয়। একটা সুস্থ সবল গাছ থেকে বছরে জাত ভেদে ৭০-১৫০ কেজি খেজুর ফল পাওয়া যায়। পরাগায়নের পর ৭-৯ টা সুস্থ সবল কাঁদি রেখে অবশিষ্ট কাঁদিগুলো শুরুতেই অপসারণ করা দরকার। এ ব্যবস্থায় অবশিষ্ট কাঁদিগুলো থেকে বেশি আকর্ষণীয় বড় আকারের ফল পাওয়া নিশ্চিত হবে। খেজুর ফল ধীরে ধীরে বড় হওয়া আরম্ভ করলে তা ফলের ভারে ঝুলে পড়ে। এ ফলন্ত ছড়া পাতার ডগায় বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে ফল বড় হতে বাধা সৃষ্টি করে, তাতে ফলন কমে যায়। খেজুর ফলের থোকা যেন অবাধে আংশিক ভাবে ঝুলতে পারে এ জন্য কাঁটা পরিষ্কার করে দিয়ে ফলকে অবাধে বাড়তে দেয়া দরকার। খেজুরের ভারে একেকটা কাঁদি যেন ভেঙ্গে না পড়ে এ জন্য কাঁদির ফুল ধরা শুরু অংশে হালকা ভাবে দড়ি বেঁধে দিয়ে ফলের কাঁদিকে ভেঙ্গে যাওয়া বা বেশি ঝুলে পড়া রোধ ব্যবস্থা নিতে হয়। ফল কিছুটা বড় হলে এক ধরনের মাছি পোকা ও পাখির উপদ্রব বাড়তে থাকে। এ জন্য ঘন মশারী দিয়ে ঢিলা ব্যাগ তৈরী করে ফলগুলোকে সুন্দরভাবে ঢেকে দিতে হয়।
সরকারী ভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের সহায়তায় আরব দেশ থেকে উন্নত জাতের খেজুর কলম সংগ্রহ করে আধুনিক প্রযুক্তি অবলম্বনে এ জাতের খেজুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন বিভিন্ন হর্টিকালচার সেন্টারে ও আগ্রহী কৃষক পর্যায়ে বাগান সৃষ্টির যে মহতি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার সফলতা বয়ে আনুক এবং এ দেশে হাইভ্যালু অতি লাভজনক খেজুর ফল চাষ সম্প্রসারনের গতি বেগবান হউক পরিশেষে এটাই একান্ত ভাবে কাম্য।
—
লেখকঃ মহাপরিচালক (অব:), ডিএই
এবং
ন্যাশনাল কনসালটেন্ট (হর্টিকালচার)
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নন প্রকল্প
মোবাইল নং- ০১৯১৭০৫৫২০৫