Site icon

বারি বেল-১ নামে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে মুক্তায়িত হলো বেলের প্রথম বাণিজ্যিক জাত

ড.মোঃ শরফ উদ্দিনঃ

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ দীর্ঘদিন যাবৎ বেলের উপর গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। সারাবছর ফলের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ২০০৬ সালে অপ্রচলিত ফলের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জার্মপ্লাজম সংগ্রহের জন্য ফল মেলার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে ভালোমানের বেলের জার্মপ্লাজম নির্বাচন করা হয়। উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: শরফ উদ্দিনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থান হতে ২২ টি জার্মপ্লাজম সনাক্তকরণ করা হয় ও পরে মাতৃগাছ হতে সায়ন সংগ্রহ করে অত্র কেন্দ্রে জন্মানো রুটস্টকের উপর কলম করা হয় এবং গবেষণা মাঠে স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘ নয় বছরের গবেষণায় পাওয়া গেল উৎকৃষ্টমানের জাতটি। গত ২৪.০১.২০১৬ তারিখে জাতীয় বীজ বোর্ড বারি বেল-১ হিসেবে জাতটি মুক্তায়ন করা হয়। এটিই বাংলাদেশের প্রথম মুক্তায়িত বেলের জাত। একটি কথা আলোচনা করা দরকার, অতীতে বীজের গাছ থেকে জন্মানো চারাগাছ হতে ফলন পেতে ৮-১২ বছর পর্যন্ত সময় লাগতো। ফলে মানুষ বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতো না। এই জাতটি কলমের মাধ্যমে জন্মানো যাবে, যার ফলে মাতৃগাছের গুনাগুন হুবুহু অখুন্ন থাকবে এবং ফল আসতে সময় লাগবে মাত্র ৫ (পাঁচ) বছর। ফলে অন্যান্য ফলের মতো বেলও চাষীরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে পারবে। জাতটির গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্যসমুহ নিম্নে আলোচনা করা হলো।
ফল মাঝারি আকারের, নিয়মিত ফলদানকারী; প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৯০০ গ্রাম, কাঁচা বেলের রং সবুজ। তবে পাকা ফল দেখতে হালকা সবুজ হতে হালকা হলুদ বর্ণের এবং টিএসএস ৩৫%। ফলের খাদ্যেপযোগি অংশ ৭৮ ভাগ। সাত বছর বয়সী গাছ প্রতি গড় ফলের সংখ্যা ৩৮টি এবং গড় ফলন ৩৪ কেজি/গাছ/বছর। প্রতি হেক্টরে ফলন প্রায় ১৪ টনের মতো। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ফলনও বাড়তে থাকে। ফলের সংগ্রহকাল মার্চ মাসের শেষ হতে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। বাংলাদেশের সকল জেলাতেই এই জাতটি চাষাবাদ করা যাবে।
বারি বেল-১ এর ব্যবহার ও পুষ্টিগুন
কাঁচা ও পাকা বেলের রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার। পাকা বেলের শাঁস গাছ থেকে পেড়ে সরাসরি খাওয়া যায়। এছাড়াও পাকা বেলের শাঁস সরবত, জ্যাম, জেলী, চাটনি, স্কোয়াস, বেভারেজ ও বিভিন্ন ধরনের আর্য়ুবেদিক ঔষুধ তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বেলের পাতা ও ডগা সালাদ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বারি বেল-১ পুষ্টিগুনে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা বেলের শাঁসে থাকে আর্দ্রতা ৬৬.৮৯ ভাগ, কার্বোহাইড্রেট ৩০.৮৬ ভাগ, প্রোটিন ১.৭৬ ভাগ, ভিটামিন সি ৮.৬৪ মিলিগ্রাম, ভিটমিন এ (বেটাকেরোটিন) ৫২৮৭ মাইক্রোগ্রাম, শর্করা ৩০.৮৬ ভাগ, ফসফরাস ২০.৯৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১২.৪৩ মিলিগ্রাম এবং লৌহ ০.৩২ মিলিগ্রাম। এমনকি বেল গাছের কান্ড হতে যে আঠা পাওয়া যায় তা গাম তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বেলের রয়েছে বহুবিধ ঔষুধি গুনাগুন। পাকা বেলের সরবত কোষ্ঠকাঠিন্য দুর করে থাকে। অন্য একটি গবেষণার ফলাফল হতে দেখা গেছে, বেল হতে প্রাপ্ত তৈল ২১ প্রজাতির ব্যাকটেরিযার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে।
চাষাবাদ পদ্ধতি
ক্লেফট গ্রাফটিং বা ফাটল কলমের সাহায্যে কলমের চারা তৈরী করা হয়। কলমের চারা সংগ্রহ করে ৫*৫ মিটার দুরুত্বে লাইন-লাইন এবং গাছ-গাছ। সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ৬০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতায় গর্ত করতে হবে। গর্ত করার সময গর্তের উপরের অর্ধেক অংশের মাটি এক পার্শ্বে এবং নিচের অংশের মাটি অন্য পার্শ্বে রাখতে হবে। গর্ত থেকে মাটি উঠানোর ১০ দিন পর্যন্ত গর্তটিকে রৌদ্রে শুকাতে হয়। এরপর প্রতি গর্তে ১০ কেজি গোবর সার ও ১৫০ গ্রাম টি এস টি উপরের অংশের মাটির সাথে মিশিয়ে মাটি উলট-পালট করে গর্ত ভরাট করতে হবে। গর্ত ভরাটের সময় উপরের অর্ধেক অংশের মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট না হলে প্রয়োজনে পার্শ্ব থেকে উপরের মাটি গর্তে দিতে হবে। তবে গর্তের নিচের অংশের মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট না করা উত্তম। এই কলমের চারাটি জুন-জুলাই মাসে নির্ধারিত গর্তে রোপণ করতে হবে। রোপণের পর কলমের চারাটি সোজা করে খুটির সাথে বেধেঁ দিতে হবে এবং বৃষ্টি না হলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমান বাড়তে থাকে। গাছের বয়স ১-২ বছর হলে পচাঁ গোবর সার/ আবর্জনা পচাঁ সার ১৫ কেজি, ইউরিয়া সার ২৫০ গ্রাম, টিএসপি সার ২০০ গ্রাম, এমওপি সার ১৫০ গ্রাম, জিপসাম ১০০ গ্রাম, জিংক সালফেট ২০ এবং বোরিক এসিড বা পাউডার ১৫ গ্রাম প্রতিটি গাছের জন্য বছরে একবার প্রয়োগ করতে হবে। ফল সংগ্রহের পরপরই সার প্রয়োগ করে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ ফল সংগ্রহ করার পরপরই গাছে নতুন পাতা আসবে এবং ফুল আসা শুরু করবে।
আমরা আশাকরছি, দেশের জনগন সুস্বাদু এই জাতিটি চাষ করবেন, নিজে দেশীয় ফল খাবেন এবং অন্যের জন্য উৎপাদন করবেন। দেশ ফল বেশি করে খাবেন এবং বিদেশী ফল পরিহার করবেন তাহলেই আমাদের দেশের অর্থনীতি আরও দৃঢ় ও মজবুত হবে।

Exit mobile version