জান্নাত ঝুমাঃ
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা সফলতা :গত ১২ সেপ্টেম্বের ২০১৮ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২৯ তম বৈঠক বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) এর সদর দপ্তর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান বাগেরহাট ০২ আসনের সম্মানিত সংসদ সদস্য মীর শওকাত আলী বাদশাহ, এমপি। বৈঠকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব নারায়ন চন্দ্র চন্দ এমপি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মাননীয় সংসদ সদস্য এডভোকেট মুহাম্মদ আলতাফ আলী, এমপি ( বগুড়া-৭),মাননীয় সংসদ সদস্য বেগম শামছুন নাহার (এডভোকেট) এমপি (মহিলা আসন-২৯), মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু, এমপি ( নেত্রকোনা-৩)। বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সম্মানিত সচিব জনাব মো. রইছউল আলম মন্ডল। এছাড়াও মন্ত্রণালয়ের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ,সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা,মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। সভার শুরুতেই ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) এর সার্বিক কার্যক্রমের ওপর পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন।
উল্লেখ্য,বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনার জন্যএকমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ইনস্টিটিউটের সদর দপ্তর ময়মনসিংহে অবস্থিত। ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত ৫টি কেন্দ্র ও ৫টি উপকেন্দ্র হতে পরিচালিত হয়ে থাকে। গবেষণা কেন্দ্রগুলো হচ্ছে- স্বাদুপানি কেন্দ্র, ময়মনসিংহ, নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর, লোনাপানি কেন্দ্র, পাইকগাছা, খুলনা, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, কক্সবাজার এবং চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র,বাগেরহাট। উপকেন্দ্র ৫টি হচ্ছে নদী উপকেন্দ্র, রাঙ্গামাটি, প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র, সান্তাহার, বগুড়া, স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, যশোর, নদী উপকেন্দ্র, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী এবং স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুর, নীলফামারী। ইনস্টিটিউট দেশের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে জাতীয় চাহিদার নিরীখে গবেষণা পরিচালনা করে এ যাবত ৬০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এরমধ্যে ৪৯টি মাছের প্রজনন, জীনপুল সংরক্ষণ, জাত উন্নয়ন ও চাষাবাদ বিষয়ক এবং অপর ১১টি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক। এসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের ফলে দেশে মাছের উৎপাদন উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্ঠি হয়েছে। ২০০৯-১৮ অর্থ বছরে ইনস্টিটিউটের গবেষণা সাফল্যে গুলো নিম্মে তুলে ধরা হলো :
ক) রুই মাছের উন্নত জেনেটিক জাত উদ্ভাবন
ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জেনেটিক গবেষণার মাধ্যমে ২০০৯ সালে দেশীয় রুই মাছের নতুন উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন নদী উৎস থেকে বন্যজাত সংগ্রহ করে ক্রসব্রিডিং পদ্ধতিতে প্রথম প্রজন্মের উন্নত রুইজাত উদ্ভাবন করা হয় যা বিদ্যমান জাত হতে ১৬ ভাগ অধিক উৎপাদনশীল। অধিক উৎপাদনশীল এসব মাছের জাত দেশ ব্যাপী সম্প্রসারণ করা হলে দেশে অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন মাছের উৎপাদন পাওয়া সম্ভব হবে। এ অবদানের জন্য ইনস্টিটিউটকে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০১০ স্বর্ণপদক প্রদান করে।
খ) বিপন্ন প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন ও জীন পুল সংরক্ষণ
স্বাদুপানির ২৬০টি মৎস্য প্রজাতির মধ্যে ৬৪টি প্রজাতি বর্তমানে বিপন্ন। ইনস্টিটিউট এ সকল বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে কৃত্রিম ও নিয়ন্ত্রিত প্রজননের মাধ্যমে আলোচ্য সময়ে টেংরা, গুজি আইড়, চিতল, ফলি, কুচিয়া ও খলিসা মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা লাভ করেছে। ফলে এসব মাছের চাষাবাদ হওয়ায় সম্প্রতিক কালে এদের প্রাপ্যতা বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আছে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন কেন্দ্রে এসব মাছের লাইভ জীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। টেংরা মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের জন্য ইনস্টিটিউট জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০১৭ রৌপপদক লাভ করে।
এছাড়াও, মিঠাপানির বিলুপ্ত প্রায় বরালি, খলিসা এবং উপকূলীয় অঞ্চলের কাইন মাগুর, চিত্রা, দাতিনা এবং তপস্যে মাছের জীনপুল সংরক্ষণের উপর বর্তমান গবেষণা চলমান রয়েছে।
গ) কুচিয়ার পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা
কুচিয়া মাছ অত্যন্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ ও ঔষধি গুণসম্পন্ন। আন্তর্জাতিক বাজারে এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বিগত কয়েক বছর যাবৎ কুচিয়া রপ্তানি করে দেশে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কুচিয়ার যথেষ্ট চাহিদা থাকায় কুচিয়ার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য ইনস্টিটিউট গবেষণা পরিচালনা করছে। ইনস্টিটিউটে ২০১৫ সালে নিয়ন্ত্রিত প্রজননের মাধ্যমে কুচিয়ার পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হয়েছে। কুচিয়ার পোনা উৎপাদনের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কুচিয়ার নির্বিচারে আহরণ হ্রাস পাবে এবং চাষাবাদ সহজতর হবে।
ঘ) কৈ মাছের রোগ নিরাময়ে ভেকসিন তৈরি
দেশে ভিয়েতনামী কৈ মাছের চাষ গত ৪/৫ বছরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। অধিক মুনাফার আশায় কতিপয় চাষী অধিক ঘনত্বে (৪-৫ হাজার/শতক) কৈ মাছ পুকুরে চাষ করে। ফলে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে কৈ মাছের ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়। অত:পর ২০১৪ সাল থেকে পরিচালিত গবেষণায় কৈ মাছের রোগের কারণ হিসেবে Streptococius agalactiae নামক ব্যাকটেরিয়াকে সনাক্ত করা হয় এবং এ জীবাণু দমনে ইনস্টিটিউট থেকে ভেকসিন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ইতোমধ্যে ইনস্টিটিউট থেকে ভেকসিন তৈরিতে সফলতা অর্জিত হয়েছে এবং বর্তমানে তা মাঠ পর্যায়ে চূড়াšত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। শীঘ্রই ভেকসিন চাষীদেও নিকট সহজলভ্য করা সম্ভব হবে। কৈ মাছের ভেকসিন তৈরী দেশ-বিদেশে এটাই প্রথম।
ঙ) মিঠা পানির ঝিনুকে ইমেজ মুক্তা উৎপাদন
ইনস্টিটিউট হতে মিঠাপানির ঝিনুকে ইমেজ মুক্তা তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৭-৮ মাসেই ঝিনুকে ১টি পুর্ণাঙ্গ ইমেজ মুক্তা তৈরী করা সম্ভব। সাধারণত মোম, খোলস, প্লাস্টিক, ষ্টীল ইত্যাদি দিয়ে চাহিদা মাফিক তৈরিকৃত নকশাকে ঝিনুকের ম্যান্টাল টিস্যুর নিচে স্থাপন করে ইমেজ মুক্তা তৈরী করা হয়। ইমেজ মুক্তা উৎপাদনের পাশাপাশি দেশীয় ঝিনুকে (৬০-৭০ গ্রাম) নিউক্লি অপারেশনের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে (৮-৯ মাস) বড় ও গোলাকৃতির মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। অপরদিকে ২০১৬ সালে বিদেশ থেকে সংগৃহীত বড় আকৃতির মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক (৭০০-৮০০ গ্রাম) পুকুরে লালন-পালন করা হচ্ছে এবং প্রজননের মাধ্যমে এর পোনা উৎপাদনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সংগৃহীত বিদেশী ঝিনুকের সংখ্যা বৃদ্ধির পর বড় আকৃতির এই ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।