ড. নিয়াজ পাশা
১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩। বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এ দিনে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের শুভাগমন ঘটেছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সবুজ চত্বরে। ব্রক্ষপুত্র পারের এ সবুজ শ্যামল আঙিনা ঐ দিন মহান নেতার পদ স্পর্শে মুখরিত হয়েছিল। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হ্নদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে বরণ করেছিল তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক মিলন, নৈকট্য লাভ, কৃষিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সাথে তাঁর মত বিনিময়, দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ এবং কর্মব্যস্ততা এ দিনটিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। কর্মব্যস্ত মানুষ বঙ্গবন্ধু, সময় তাঁর অত্যন্ত সীমিত। এ দেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদের সাথে তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। নির্বাচনী ডামাডোলের শত ব্যস্ততার মধ্যেও নাড়ীর এ টানে তাইতো সেদিন তিনি ছুটে গিয়েছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও শেষ সফর। কৃষির প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ও আন্তরিকতা কৃষিবিদদের মায়ারডোরে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাইতো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি ও মানুষ বঙ্গবন্ধুর কথা বলে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইথারে বঙ্গবন্ধুর নিঃশ্বাস। কৃষিবিদ সমাজ ঐতিহাসিক এ দিনটির অপরিসীম গুরুত্ব ও মর্যাদাকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ’কৃষিবিদ দিবস’ হিসাবে পালণ করে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে অপরূপ সাজে সজ্জিত এবং অধুনালুপ্ত সমাবর্তন মন্ডপকে বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছিল। সার্কিট হাউজ থেকে উপাচার্য প্রফেসর ডঃ কাজী ফজলুর রহিম, বাকসুর জি এস আবদূর রাজ্জাক (বর্তমানে খাদ্য ও দুযোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী), ছাত্রলীগ সভাপতি মোঃ রহমতুল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক মোঃ রফিক, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ডঃ শাহান-উদ্দীন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ডঃ আনোয়রুল হক বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সংবর্ধনাস্থলে নিয়ে আসেন। বাকসুর তদানীস্তন ভিপি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও বাকৃবি’র সাবেক রেজিস্ট্রার নজিবুর রহমান মঞ্চ থেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন। এ লাল গালিচা সর্ম্বধনা অনুষ্ঠানটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। সভাস্থলে পৌঁছলে চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সংবর্ধিত প্রধান অতিথিকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। দর্শকবৃন্দ বসেছিলেন, ’জয় বাংলা বাহিনীর’ এক সুসজ্জিত দল বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদাণ করেন। সেই সাথে একদল ছাত্রছাত্রী সমন্বয়ে কবিগুরু ”তোমারী করি নমস্কার যাত্রা করি গুরুৃৃৃ. . . . . ” গানের সাথে সাথে ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নেন। তা বঙ্গবন্ধুকে বিমোহিত করেছিল, যা তিনি পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছিলেন। এখানেই তিনি দিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ। তার পূর্বে বাকসুর ভিপি নজিবুর রহমান (বাকৃবি’র সাবেক রেজিস্ট্রার) বঙ্গবন্ধুকে ”বাংলাদেশের কৃষি” এ আদর্শে প্রতিফলিত একটি কাঠের কাজ এবং ”বাংলার উৎফুল্ল কৃষক” নামে একটি আলোকচিত্র উপহার প্রদাণ করেন। মানপত্র পাঠ ও প্রদান করেন বাকসুর জি এস আব্দুর রাজ্জাক (সাবেক খাদ্য মন্ত্রী) । বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন মহাবিভাগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রদের বোনা একটি কম্বল উপহার দেওয়া হয়। ’বাকসু’ কর্তৃক আলোকচিত্র শিল্পী নাইব উদ্দিন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ফটো এলবাম প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে প্রকাশিত কৃষি ’বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা’র বিশেষ সংখ্যার একটি কপি বঙ্গবন্ধুকে উপহার প্রদান করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অফিসে শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের দ্বারোন্মোচন করেছিলেন। পাঠাগারের বই কেনার জন্য পাঁচ হাজার টাকা, দুটো ট্রাক এবং ছাত্রদের পূনর্বাসনের জন্য নগদ এক লক্ষ টাকা প্রদান করেন। তিনি ছাত্রদের যাতায়াতের সুবিধার্থে দুটি নতুন মডেলের বাস আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি পূর্ণাঙ্গ রেল ষ্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। সবচেয়ে বড় কথা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর আগমনের মধ্য দিয়েই এ দেশে কৃষি শিক্ষা ও কৃষিবিদগণ যথাযথ গুরুত্ব , সামাজিক সম্মান ও প্রথম শ্রেণীর পদ মর্যাদা, কৃষির নতুন অভিযাত্রার সূচণা হয়েছিল। আজ আমরা যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বার প্রান্তে উপসিত হয়েছি, তার বীজ রোপিত হয়েছিল সেদিন। যা পরবর্তিতে বিভিন্ন সময়ে অবনমিত হয়েছে। যথাযথই তিনি ছিলেন রাজনীতির মহাকবি। শক্তিমান কবির লেখনীতে যেমন সৃষ্টি হয় মহাকাব্যের, তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় জাগরিত হয়েছিল এ মহান দেশ, সোনার বাংলাদেশ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভাষনটির গুরুত্ব অনেক। এ বিবেচনায় ভাষনটি প্রকাশ করা হলো।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ভাষণ
মাননীয় উপাচার্য, সংসদের সদস্যবৃন্দ, ভদ্রমন্ডলী ও ভদ্র মহিলাগণ, আমার ছাত্র ভাইয়েরা ও বোনেরা- আমা্র আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আপনারা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন আপনাদের সঙ্গে মেশার। পর্বে আমাকে কয়েকবার এখানে আসার জন্য বলা হয়েছিল, সময়ের অভাবে আর কাজের চাপে আসতে পারি নাই সেজন্য আমি দুঃখিত। অনেক আগেই আমার আসা উচিত ছিল, কিন্তু কেন যে আসতে পারি নাই তা আপনারা ভাল করেই জানেন। সে কৈফিয়ৎ আমি নাই-বা দিলাম। উপাচার্য ও সংসদের নেতৃবৃন্দ কয়েকবারই ঢাকা গিয়েছেন- বলেছেন একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসুন- আমি বলেছি, আমি তো আসতে চাই, সুযোগ খুঁজছি, ময়মনসিংহ যখন যাই, নিশ্চয়ই আসব। সে প্রতিজ্ঞা আমাকে রাখতে হয়েছে আজ সকাল বেলা যদিও আমার আরো অনেক প্রোগ্রাম রয়েছে। আপনাদের সহ-সভাপতি সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানিয়েছেন। আজ আমি স্মরণ করি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সকল ছাত্র-কর্মী-শিক্ষকরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের কথা। তাঁরা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে সশস্র সংগ্রামের মোকাবেলা করেছিলেন। যাঁরা আজ চলে গেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। তাঁরা যে ত্যাগ দেখিয়ে গেছেন সে আদর্শের দিকে নজর রেখে শিক্ষা গ্রহণ করে যেন আমরা আমাদের জীবন পথে অগ্রসর হই।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা, সত্য কথা বলতে কি- বাংলার মাটি, এ উর্বর জমি বার বার দেশ বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষকদের টেনে এনেছে এই বাংলার মাটিতে। এত উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো তবে এতকাল আমাদের পরাধীন থাকতে হতো না। যেখানে মধু থাকে সেখানে মক্ষিকা উড়ে আসে। সোনার বাংলার নাম আজকের সোনার বাংলা নয়-বহু দিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মত মাটি দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায় না- বাংলার সম্পদের মত সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। সে জন্য শোষকের দল বার বার বাংলার উপর আঘাত করেছে এবং তারা তাদের শক্তি দিয়ে বাংলাকে দখল করে রেখেছে। দু’শত বৎসরের ইংরেজ শাসনে আমরা কি দেখতে পেয়েছি? যাঁরা ইতিহাসের ছাত্র আছে তাঁরা জানেন যে, যখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কো¤ানী বাংলাদেশকে দখল করে নেয় তখন কোলকাতাকে ভারতবর্ষের রাজধানী করা হয়েছিল বাংলাকে শোষণ করার জন্য। যখন আপনার মিউজিয়ামে যান বা লাইব্রেরীতে পড়েন তখন দেখতে পারেন-এ বাংলার স¤দ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল বম্বে শহর, মাদ্রাজ, কলকাতা শহর-সে ইতিহাসের দিন চলে গেছে। ইংরেজ ২০০ বৎসর শাসন করেছে, বাংলার সম্পদ বাংলা থেকে চলে গেছে- বাংলার পাট, বাংলার চা, বাংলার চামড়া, বাংলার অন্যান্য সম্পদ লুট হয়েছে, সেই ইতিহাস গেল-তারপর দুর্ভাগ্যের ইতিহাস এলো ২৪ বৎসর আগে।
জানতাম না, বুঝতাম না, তোমাদের মত যুবক ছিলাম, চোংগা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলাম- রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। ১৯৩৮ সালে প্রথম জেলে যাই- সেদিন এ দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলাম- কি স্বাধীনতা ২৫ বৎসর আগে পেলাম-হায়, এখন তা বুঝতে পেরেছি, স্বাধীনতা পেলাম না, গোলামী পেলাম- নতুন গোলামী, সাদা গোলামীর জায়গায় পেলাম কালো গোলামী। বাংলাদেশকে বাজার করা হলো, বাংলার সম্পদকে লুট করা হলো।
১৯৪৭ সালের ইতিহাস যদি আপনারা জানেন – সেদিন যখন ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যের চাপে পশ্চিম পাকিস্তানের লেজুড় হয়েছিল। সেদিন থেকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা যা আয় হতো, তা হতো পাকিস্তানের আয় বাংলাদেশ আয় করতো শতকরা ৭০ ভাগ আর পশ্চিম পাকিস্তান আয় করতো শতকরা ৩০ ভাগ একথা অস্বীকার করবার উপায় আজ তাদের নাই। বহুদিন যাবত এ সত্য গোপন রেখেছিল, কিন্তু আমাদের মত কয়েকজন হতভাগার জন্য তা পারে নাই। ৭০ ভাগ বাংলাদেশ আয় করতো, কিন্তু বাংলাদেশে ব্যয় হতো ৩০ ভাগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো ৭০ ভাগ।
গত ২৫ বৎসর থেকে বাংলাদেশের খাদ্য ঘাটতি কম পক্ষে ১৬ লক্ষ টন। কিন্তু এ খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য অতীতে কোন বন্দোবস্থ করা হয়নি। অনেকে এসেছেন, নতুন কথা বলেছেন- শুধু আমাদের সম্পদকে লুট করা নয়, আমাদের কাঁচামাল বিক্রি করে পশ্চিম পাকিস্তানকে উন্নত করা হলো। বাংলাকে মর্টগেজ রেখে পশ্চিম পাকিস্তানে আমার অর্থে গড়ে উঠলো করাচী, আমার অর্থে গড়ে উঠলো লাহোর, হায়দরাবাদ, ইসলামাবাদ। অর্থ কোথা থেকে এলো, কিভাবে এলো আপনারা জানেন এ ইতিহাস অনেক বলা হয়েছে আমি আর বলতে চাই না। তারপর স্বাধীনতা সংগ্রাম- সে ইতিহাসও আপনারা জানেন। বারবার আঘাত করার চেষ্টা করেছি, বারবার বাংলাদেশে আলবদর-রাজাকার পয়দা হয়েছে অন্যান্য নামে- পারি নাই- ষড়যন্ত্রের আসামী হয়েছি-আঘাত করার চেষ্ট করেছি, প্রত্যাঘাত পেয়েছি; আবার উঠেছি, আবার সংগ্রাম করেছি, দীর্ঘ সংগ্রাম চলেছে। অনেকে সে ইতিহাস জানেন না, সে ইতিহাসের খবর রাখেন না- সময় আসলে সে ইতিহাস আমি লিখব, আপনারা পাবেন এবং কিছু কিছু আপনার বুঝতে পারেন।
আজ বাংলাদেশের অবস্থা বড় শোচনীয়। যাওয়ার পর্বে তারা সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। আমার দুধের বাচাকে হত্যা করেছে, তা নয়। বাংলাদেশের যাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী বলা হয় তাঁদেরকে হত্যা করার বিরাট ষড়যš তারা নেয়। দুনিয়ার কোনদিন কোন ইতিহাসে এরকম দেখা যায় নাই যে, বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। হিটলার পড়েছি, মুসোলিনী পড়েছি, আপনারা অনেক ইতিহাস পড়েছেন। হিটলার বেঁচে থাকলে হয়তো আজকে লজ্জায় মাথা নত করতো। পশ্চিম পাকি পাকিস্তনীরা ১৫০জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তিন দিনের মধ্যে আÍসমর্পনের পর্বে কার্ফু দিয়ে বেছে বেছে হত্যা করেছে। তা পেঁছনে বিরাট ষড়যন্ত্র ছিল, যাতে এদেশ আরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। নৃঃশংসভাবে তাঁদেরকে হত্যা করেছে। গুলি করে হত্যা করত, আঘাত করে হত্যা করত, কোন দুঃখ ছিল না। চোখের ডাক্তারের চোখ উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করেছে, হার্টের ডাক্তারের কলিজা উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করেছে, সাংবাদিকদের হাতের আঙ্গুল কেটে কেটে হত্যা করেছে, বৈজ্ঞানিকদের মাথার মগজ বের করে হত্যা করেছে- মানুষ এমন পশু হতে পারে জানতাম না।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি, কৃষির কথা কিছু বলা যাক। এ পর্যন্ত কোন প্লান-প্রোগ্রাম ছিল না। যে যেভাবে পারে – ফ্রি ষ্টাইলে বাংলার ইকনমি চলেছে। মোনেম খাঁ এলেন, তিনি একটা ষ্টাইল শু্রু করলেন। আর একজন এলেন তিনিও একটি ষ্টাইল শু্রু করলেন। কোন দেশে কোন প্লান সাকসেসফুল হতে পারে না, যদি সেই দেশে কি সমপদ আছে তা না জানা যায়। ২৫ বছরেও বাংলার কি সম্পদ আছে তার কোন সেন্সাস হয় নাই। সেন্সাস ছাড়া আমি যদি প্লানিং কমিশনকে বলি যে তোমারা প্লান করে দাও, তা হলে তারা কি করে প্লান করবে। কত মানুষ আছে, কত গবাদি পশু আছে, কত জমি আছে, সম্পদ যদি না জানা যায়, কিসের ভিত্তিতে প্লান করবে। কোন সেন্সাস আজ আমার সামনে নাই। শুধু এইটুকুই জানি যে, এ ক্ষুদ্র দেশে আল্লাহর মর্জি, সাড়ে সাতকোটি লোক বাস করে। যেভাবে মানুষ বাড়ছে যদি সেভাবে আমাদের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে তবে ২০ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ, বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে কারণেই আমাদের কৃষির দিকে নজর দিতে হবে। কৃষি বিপ্লব বললেই কৃষি বিপ্লব করা যায় না সেদিকে আমাদের নজর দেওয়ার প্রয়োজন। প্লান করতে গেলে-সে প্লান সাকসেসফুল করতে হলে সেন্সাসের প্রয়োজন। সেন্সাস কমিশন করেছি, তাদেরকে বলা হয়েছে পুংখানুপুংখরূপে সব জানতে চাই, তার উপর বেসিস করে প্লান করতে হবে। সেজন্য তো বসে থাকা যাবে না। কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ ’৭০সনের সাইক্লোনে টাইডেল বোর, ’৭১ সনের স্বাধীনতা যুদ্ধ, এইবার বৃষ্টি নাই। গত বছর ২৭ লক্ষ টন খাদ্য আনতে হয়েছে বিদেশ থেকে কিনে, ভিক্ষা করে। এই বৎসর ১২৫ কোটি টাকার খাবার কেনার ব্যবস্থা করেছি বাংলাদেশের সম্পদ থেকে। জানিনা কেউ দেবে কি দেবে না? মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারিনা; তাই ১২৫ কোটি টাকার খাবার কিনতে বাধ্য হয়েছি। দেশের মানুষের অবস্থা খারাপ। ৭ মাস বৃষ্টি হয় নাই। বাংলাদেশে যেমন এখন পানি নাই, আবার যখন বন্যা আসে তখন সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আজ পর্যš ফ্লাড কন্ট্রোল এর কোন বা¯ব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় নাই। শুধু সবুজ বিপ্লবের কথা বলব। কিন্তু সাথে সাথে যে সমস্ত প্রোবলেম আছে সেদিকে চিন্তা না করলে অসুবিধা ভোগ করতে হবে। সেজন্য আজকে ফ্লাড কন্ট্রোল এর দিকে নজর দিতে হবে, তা না দিলে গরীব কৃষকরা অনেক কষ্টে ফসল উৎপাদন করে, আর বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়- অনেক কষ্টে ফসল উৎপাদন করে, পানি থাকে না। এবার পা¤ দিয়ে পানি দেবার বন্দোবস্তু করেছিলাম, জায়গায় জায়গায় কাজ শুরু হয়েছিল। এখন বৃষ্টি নাই, পানি নাই। ছোট ছোট খালগুলি শুকিয়ে যায়। জমিও গেল, পানিও গেল, পা¤ও গেল। আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, উপায় নাই।- এই হলো দেশের অবস্থা। তারপরে ফার্টিলাইজার কোথায় পাব। ফ্যাক্টরী আছে। আরো কিছু দরকার। সেগুলি করতে হবে। আল্লাহর মর্জি, আমার মুসলমান ভাইরা গরু যা খাইছে, আর পাঞ্জাবীরা খাইয়া শেষ কইরা গেছে। গরু কিনার চেষ্টা করছি। কিছু কিছু আনছি। ট্রাক্টরেরও বন্দোবস্তু করতে হবে। কথাটা বললে খারাপ শোনাবে। কিন্তু আমি সত্য কথা বলার মানুষ। বলতে আমাকে হয়, বলা আমার উচিত। এত গরু খাওয়া না কমালে এদেশের চাষীদের বাঁচান যাবে না। আবার কেউ ফতোয়া দিয়ে বলবে যে, মুজিবুর রহমান গরু খাইবার মানা করে গেছে। এমনি আন-ইসলামী হয়ে গেল কথাটা। কিন্তু এদেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে গরু খাওয়া কমাতে হবে, নইলে হাল চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। এত তাড়াতাড়ি ট্রাক্টরের বন্দোবস্তু করা যাবে না। সেদিকে নজর দিতে হবে সকলের।
ভাইয়েরা আমার বোনেরা আমার।
আমি প্রোবলেম আলোচনা করলাম। পোকা মারার কোন ঔষধের কারখানা আমার নাই। বিদেশ থেকে আনতে হয়। বীজ নাই, বীজ আনতে হয়। উইন্টার ক্রপ করতে পারলে কিছুটা উপকার হয়। প¬্যান্ড ওয়েতে আমাদের কাজ করতে হবে। তা যদি করি তবে আমি আশা করি ৫ বৎসরের মধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংস¤র্ণতা লাভ করবে। খাদ্য শুধু চাউল, আটা নয়; মাছ, মাংস, ডিম তরিতরকারীও আছে। কিছু পরিবর্তন আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আপনার নিশ্চয়ই রাগ করবেন না, দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাউল কিনতে পারছি না। চাউল পাওয়া যায় না। যদি চাউল খেতে হয় আপনাদের চাউল পয়দা করে খেতে হবে, না হলে মুজিবুর রহমানকে বেটে খাওয়ালেও হবে না। সেদিকে আপনাদের নজর দিতে হবে। না দিয়ে উপায় নাই। তবে সামনে যে সব অসুবিধা আছে তার মধ্যেই কাজ করতে হবে।
শুধু কাগজে কলমে আর বই পড়েই কৃষি কাজ হয় না। ছোট ভাইয়েরা তোমরা মনে কিছু করবে না। বই পড়ে তোমরা যা শিখ, গ্রামে যারা অর্থাৎ বুড়া কৃষকরা নিজের অভিজ্ঞততায় কম শেখে না। যদি তাঁদের জিজ্ঞেস কর এই জমিতে কি লাগবে, কতটুকু সার লাগবে, সে নির্ভুল বলে দিতে পারবে। তোমরা পাঁচ বছর বই পড়ে যা শিখবে না, তার কাছে দেখ উত্তর সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবো। বই-এর সাথে সাথে একটু প্র্যাক্টিক্যাল কাজ করতে হবে। প্যান্ট-সার্ট কোট একটিু খুলতে হবে। তা না হলে বিপ্লব করা যাবে না। বাংলাদেশে প্যান্ট, কোট ছেড়ে মাঠে না নামলে বিপ্লব করা যাবে না, তা যতই লেখা-পড়া করা যাক, তাতে কোন লাভ হবে না। আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। কেমন করে হাল-চাষ করতে হয়, এ জমিতে কত ফসল হয়, এ জমিতে কেমন করে লাংগল চষে, কেমন করে বীজ বপন করতে হবে, আবার কি করে পাট বাছতে হয়, ধানের কোন সময় নিড়ানী দিতে হয়, কোন সময় আগাছা ফেলতে হয়, পরে ফেললে আবার ধান নষ্ট হয়ে যায়, এগুলো বই পড়লে হবে না। গ্রামে যেয়ে আমার চাষী ভাইদের সাথে বসে প্র্যাক্টিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে। তাহলে আপনারা অনেক শিখতে পারবেন। অনেক আগে কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছি। ৫০০কোটি টাকার ডেভেলপমেন্ট বাজেট করেছিলাম এবং ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য দিয়েছি। ভিক্ষা করে টাকা আমি জোগাড় করেছি।
শতকরা ৯০ জন কৃষক গ্রামে বাস করে। গ্রামের দিকে যেতে হবে। আমার ইকনমি যদি গণমুখী না করতে পারি এবং গ্রামের দিকে যদি না যাওয়া যায়, সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না- কৃষি বিপ্লব হবে না। দেশের মধ্যে বিশৃখলা সৃষ্টি হবে, মানুষ মানুষকে খাবে। কারণ খাবার অভাব হলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। সেজন্য খাওয়ার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেদিকে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আপনাদের সকলের কাজে এগুতে হবে।
আমার ভাইয়েরা যে অভিনন্দন দিয়েছেন, তাতে লেখা হয়েছে, অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তারদের যে মর্যাদা; কৃষি গ্র্যাজুয়েটদেরও সে মর্যাদা দিতে হবে। কোন মর্যাদা দিতে কোন আপত্তি আমার নাই। তবে আমি যে এডমিনিষ্ট্রেটিভ রি-অরগেনাইজেশন কমিশন করেছি, পে-কমিশন করেছি, তাদের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত আমাকে কথা দেওয়া চলবে না। তারপরে আমি কথা দেব। এর আগে আমি কথা দিতে পারব না। এই জন্য যে, এডুকেশন কমিশন করেছি সংগে এডমিনিষ্ট্রেটিভ রি-অরগেনাইজেশন কমিশন করেছি এবং দুই কমিশনের কাজ আরম্ভ হয়েছে। আশা করি ২/৩ মাসের মধ্যে এ কাজ শেষ হয়ে যাবে। যদি তার পরে আপনাদের কোন আপত্তি থাকে তার পরে আমার হাতে কিছু ক্ষমতা থাকতে পারে। তবে আশা করব, কমিশন রিপোর্ট আসা পর্যš আপনারা ধৈর্য ধরে দেরী করবেন। কারণ আপনারা জানেন না যে, এডমিনিষ্ট্রেশন বলে যে পদার্থটি আমাদের কপালে আসিয়া জুটিয়াছে তাকে এডমিনিষ্ট্রেশন বলা চলে না। ১৩৩ ধাপও আছে। ৩৩ ধাপও আছে। ৪৪ ধাপও আছে। লোয়ার ডিভিশন, আপার ডিভিশন, সিনিয়র ডিভিশন, অনেক কিছু। তাই বলছি, সব এক করে ফেল। সাফ করে ফেল। ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭। আমি ৭ পর্যন্ত সাজেশন দিয়েছি। তারা কেউ বলেছেন ১১ দরকার, ১২ দরকার, আমি তাদের উপর বাধা দিতে চাই না। আমি বলেছি আপনারা এক্সপার্ট, আপনারা সেটা চিন্তা করে দেখেন। আপনারা দেখুন কত পর্যন্ত পারেন। একটি রি-অরগেনাইজেশন করা দরকার। তখন বিবেচনা করে দেখা যাবে আমি কথা দিতে পারলাম না সেজন্য দুঃখিত। আপনারা নিশ্চয়ই দুঃখিত হবেন না।
কৃষি বিপ্লবের কথা বলছি। আমাদের নজর গ্রামের দিকে দিতে হবে। কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। আর একটু বলত