কৃষিবিদ মোঃ নূরুল হুদা আল্ মামুন*
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে যতগুলো সৌর্ন্দয্য দিয়ে সুশোভিত করেছেন তার মধ্যে ফুল অন্যতম। ফুলের রাজ্যে এমনি এক অনিন্দ্য সুন্দর, মূল্যবান ফুলের নাম অর্কিড। আকর্ষণীয় রং, বাহারি গড়ন, ফুলদানীতে দীর্ঘ স্থায়ীত্বকাল ও সুগন্ধ এসব মিলে অর্কিড অতি জনপ্রিয়। বাণিজ্যিক ফুল হিসেবে অর্কিডের রয়েছে যথেষ্ট কদর। থাইল্যান্ড, মায়ানমার, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, মেক্সিকো, দক্ষিন আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ার উষ্ণ অঞ্চলে অর্কিড ভাল জন্মে। ঙৎপযরফধপবধব পরিবারের সদস্য অর্কিডের রয়েছে ৩০ হাজারের উপরে জাত। সৌখিন চাষের পাশাপাশি অনেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অর্কিড চাষাবাদের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
চাষ পদ্ধতি ঃ সফলভাবে অর্কিড চাষের জন্য পার্থিব/ভূমিক (ঞবৎৎবংঃৎরধষ) এবং পরাশ্রয়ী (ঊঢ়রঢ়যুঃরপ) পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
এ পদ্ধতিতে অন্যান্য ফুলের ন্যায় মাটিতে চারা লাগানো হয়। সেখান থেকে অর্কিড গাছ খাদ্য ও রস সংগ্রহ করে। এর জন্য উপযুক্ত জাত হলো অরুন্দিনা, ক্যালাছে ইত্যাদি। পার্থিব বা টেরিস্ট্রিয়াল অর্কিড টব, গামলা অথবা ঝুলন্ত বাস্কেটে চাষ করা যায়। প্রথমে এগুলোর যে কোন একটির ভেতরের তলদেশে কয়লা, খোয়া অথবা ঝামার টুকরা স্থাপন করতে হবে। এর উপর নারকেলের ছোবড়ার টুকরা অথবা আম গাছের বাকল ছড়িয়ে দিতে হবে। সবার উপরে কম্পোষ্ট বা পাতা পচা সার ও হাড়েঁর গুড়া মিশ্রিত দোআঁশ মাটি দিয়ে টব ভর্তি করে তার উপর অর্কিডের চারা এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যেন এর শিকড় গুলো ছড়িয়ে থাকে।
২. পরাশ্রয়ী পদ্ধতি ঃ এ পদ্ধতিতে অন্য গাছের কান্ড বা শাখার উপর অর্কিড গাছকে আশ্রয় সৃষ্টি করা হয়। ফলে এ ধরনের অর্কিড থেকে আস্থানিক শিকড় বের হয়। এই শিকড়ের কিছু ব্যবহৃত হয় আশ্রয়দাতা গাছকে আকঁড়ে ধরে রাখার জন্য আর বাকি গুলো বাতাস থেকে খাদ্য ও জলীয় বাষ্প গ্রহণ করে পুষ্টি সাধনে সাহায্য করে। পরাশ্রয়ী অর্কিডের উদাহরণঃ ডেন্ড্রোবিয়াম, ক্যাটলেয়া ইত্যাদি। পরাশ্রয়ী অর্কিড কাঠ বা বিশেষ ধরনের টবে অথবা বাঁশের ঝুড়িতে চাষ করা যায়। কাঠের উপর জন্ম নেয়ার ক্ষেত্রে আম বা জারুলের এক খন্ড কাঠের টুকরার উপর তামার তার দিয়ে অর্কিডের চারাকে বেধেঁ দিতে হবে। এরপর কিছু দিনের মধ্যে অর্কিড নতুন শিকড় উৎপন্ন করে কাঠের টুকরাকে জড়িয়ে ধরে। ঝুলন্ত টব হিসেবে পোড়া মাটির টব অথবা বাঁশের কাঠের ঝুড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে।
টব বা ঝুড়ির তলদেশে এক তৃতীয়াংশ ঝামা বা ইটের খোয়া দিয়ে ভর্তি করে তার উপর অর্কিডের চারা স্থাপন করে শিকড়গুলো ছড়িয়ে দিতে হবে।
এর উপর গাছের বাকল, নারিকেলের ছোবড়া, কাঠ ও বাঁশের চিপস টুকরো টুকরো করে কেটে তার সাথে কিছু কয়লার টুকরা এবং ১০ গ্রাম পরিমাণ হাড়ের চিপস মিশিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে চারার মুখ উম্মুক্ত থাকে। এরপর একটি খুনতি দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে এই মিশ্রণ ঝামা ইটের খোয়ার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে শক্ত করে দিতে হবে।
পরিচর্যা ঃ অর্কিডের রোগাক্রান্ত বা মরা পাতা ও শেকড় কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। টব, ঝামা ইত্যাদি ব্যবহারের আগে ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে। মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকতে লাগানোর পর হালকা সেচ দিতে হবে; যাতে শিকড় গুলো মাটিতে লেগে যায়। ভাইরাস আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ফুলের কুঁড়ির কীড়া দমনের জন্য ডায়াজিনন ৬০ ইসি বা অন্য কোন সিস্টেমিক কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। ভাল ফলন পেতে হলে টবের অর্কিড ফাল্গুন চৈত্র মাসে নতুন টবে বা বাক্সে স্থানান্তর করা যেতে পারে।
সেচ প্রয়োগ ঃ সাধারণতঃ অর্কিড গ্রীষ্ম ও বর্ষায় বাড়ে এবং শীতকালে বিশ্রাম নেয়। তাই গ্রীষ্মকালে দিনে ২বার সকালে ও বিকালে পানি সেচ দিতে হয়। বর্ষাকালে পানি দেবার প্রয়োজন নেই। শীতকালে সপ্তাহে ১বার পানি সেচ দিতে হয়। সেচের পানির সাথে ইউরিয়া ও পটাশিয়াম ফসফেট পাতলা করে গুলে স্প্রে করা যেতে পারে। এব্যবস্থা উৎকৃষ্ট ফুল উৎপাদনের সহায়ক।
সার প্রয়োগ ঃ গাছের বৃদ্ধি ও ভাল ফুল প্রাপ্তির জন্য ইউরিয়া টিএসপি ও এসপি সার ২০:২০:২০ হারে মিশিয়ে পানিতে গুলিয়ে সপ্তাহে ১/২ দিন গাছে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার সময় গাছের পাতা যেন ভালভাবে ভিজে যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
অর্কিড জন্মানোর পরিবেশ ঃ অর্কিড ছায়া পছন্দ করে বিধায় বিশেষভাবে তৈরি ছায়া ঘর অর্কিড জন্মানোর উপযুক্ত স্থান। তবে বাস গৃহের বারান্দায় ও বাগানে অন্য গাছের ছায়ায় অর্কিড সহজে জন্মে। নেট দিয়ে ছায়া তৈরি করে সেখানে অর্কিড চাষ করা যায়। অর্কিড এমন জায়গায় রাখতে হবে যেখানে এগাছ সোজা সোজি রোদ পাবেনা এবং পশ্চিমের রোদ পাবে না। অর্কিড রাখার জন্য এমন জায়গা বেছে নিতে হবে যেখানে প্রচুর বায়ু চলাচল করে।
বংশ বিস্তার ঃ বীজ দ্বারা অধিকাংশ অর্কিড বংশ বিস্তার করা যায়। কিন্তু বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তারে অনেক সময় লাগে তাই অযৌন পদ্ধতি যেমন ঃ শাখা কলম বা গুটি কলম, সাকারের মাধ্যমে বংশবিস্তার সহজ ও লাভজনক। গাছের ফুল কাটার পর প্রতিটি গাছ থেকে পার্শ্চণীয়ভাবে সাকার বের হয়। এই সাকার শিকড়সহ কেটে অন্য টবে বা জমিতে লাগানো যায়। কিছু কিছু কাটিং করেও বংশ বিস্তার করা যায়। এর কান্ড কয়েক টুকরা করে ভেজা বালি বা নারিকেলের ছোবড়ার মধ্যে স্থাপন করতে হবে। সেখান থেকে অস্থানিক মূল বের হলে অন্যত্র লাগানোর উপযোগী হবে। সাধারণত ফেব্র“য়ারি মাসে যখন গাছের বৃদ্ধি নতুন করে শুরু হয় তখন কলম করার উপযুক্ত সময়। এছাড়াও টিসু কালচার করেও অর্কিড চারা উৎপাদন করা যায়।
ফুল সংগ্রহ ঃ সাকার থেকে গাছ লাগানোর ১ বছরের মধ্যেই ফুল আসে। মার্চ এপ্রিল মাসে অর্কিড গাছে ফুল ফোটে। অপরদিকে টিস্যু কালচার থেকে প্রাপ্ত চারা থেকে ফুল পেতে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগে। পূর্ণতাপ্রাপ্ত ফুল সংগ্রহ করতে হবে। খুব সকালে বা বিকালে ফুল কাটা উচিত। বাণিজ্যিক চাষের ক্ষেত্রে ফ্লাওয়ার স্টিকের এক বা দুটি ফুল ফোটার সাথে সাথে কাটতে হবে। ফুল সংগ্রহের পরপরই এর ডাটার গোড়া পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে ফুল সতেজ থাকে।
ফলন ঃ
১ম বছর প্রায় ৮০০ স্টিক হেক্টর প্রতি
২য় বছর প্রায় ১৫,০০০ স্টিক হেক্টর প্রতি
৩য় বছর প্রায় ২৫,০০০ স্টিক হেক্টর প্রতি
এছাড়া প্রতিবছর গাছ থেকে ২-৫টি সাকার সংগ্রহ করা যায়।
—–
কৃষি গবেষক ও পিএইচডি ফেলো