মোঃ মোশারফ হোসেন, নকলা (শেরপুর):
চীনাবাদাম এদেশে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তৈলবীজ ফসল। চাষের অনুকূল অবস্থা থাকা স্বত্ত্বেও বাংলাদেশে খুব অল্প পরিমাণ জমিতেই চীনাবাদাম চাষ করা হয়। যদিও খাদ্য-পুষ্টি, তেল, পশুখাদ্য, খইল, সার, শিল্পের কাঁচামাল প্রভৃতি বিবিধ উদ্দেশ্যে চীনাবাদাম ব্যবহৃত হয়। অনাবাদি জমিতে, কম পরিশ্রমে, বেশি উৎপাদন হওয়ায় ও দাম চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ায় কৃষকরা চীনাাদাম চাষ করে খুশি। আর তাইতো শেরপুরের নকলায় দিন দিন বাড়ছে বাদাম চাষের পরিমাণ ও চাষির সংখ্যা। বাদাম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন উপজেলার চরঅষ্টধর, পাঠাকাটা, চন্দ্রকোণা, টালকী ও বানেশ্বরদী ইউনিয়নের চাষি। নদীর তীরবর্তী অনুর্বর পতিতি জমিতে অন্যকোন ফসল ভালো না হলেও বাদামের ফলন ও লাভ বেশি হওয়ায় এ ফসল চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৫০ থেকে ৫৫ হেক্টর (১২৫ থেকে ১৩৭ একর) জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে- যা গেল বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গতবছর ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ ছিল। এখানকার বাদাম স্থানীয় চাহিদা মিটানোর পরে পাশ্ববর্তী জেলা জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় বড় শহরে সরবরাহ করা হয়।
স্থানীয় চাষীরা জানান, বাদাম চাষে শুধুই লাভ। বেলে দো-আঁশ মাটিতে অধিক তাপমাত্রা, পর্যাপ্ত সূর্য্যরে আলো ও মাঝারি বৃষ্টিপাত পেলে চীনাবাদামের ফলন ভালো হয়। এখানে বিভিন্ন দেশি বিদেশী জাতের বাদাম চাষ হলেও মাইজচর বাদাম (ঢাকা-১), বাসন্তী বাদাম (ডিজি-২), ঝিংগাবাদাম (এসসি-১২), বারিবাদাম-৮, ডিএম-১ এর ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা এজাত গুলোই চাষ করেন। জানকীপুরের বাদামচাষি আয়নাল, চানু, আলমগীর, হাসেম, ইসমাইল, জলিলসহ ধুকুড়িয়ার মানিক, বানেশ্বরদীর মতিন, পোলাদেশীর আকালু, ভূরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন, কামালরা জানান, যে জমিতে অন্যকোন ফসল উৎপাদন হয়না, সেই জমিতেই ধানের চেয়েও ভালো দামের ফসল চীনাবাদাম উৎপাদন করছেন তারা। প্রতি একরে ধান উৎপাদন হয় ৪৫ থেকে ৫৫ মন, যার বাজার মূল্য ৩৬ হাজার ৪৪ হাজার টাকা। পক্ষান্তরে চীনাবাদাম হয় প্রতি একরে ১৫ থেকে ২০ মন, যার বাজার মূল্য ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। তাই ধান সহ অন্যান্য ফসলের তুলনায় দিন দিন বাড়ছে বাদামের চাষ। তারা জানান, বাদাম ক্ষেতে প্রয়োজনে প্রতি একরে ইউরিয়া ৩০-৪০ কেজি, টি এস পি ৮০-৮৫ কেজি, এমপি ৩৫-৪৫কেজি, জিপসাম ৪৫-৫৫ কেজি প্রয়োগ করতে হয়। জমিতে ঘাস হলে জমির ‘জো’ বুঝে দুই একটি নিড়ানি ও জমির প্রকার ভেদে দুই তিনটি সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
প্রবাল আয়ুর্বেদ এন্ড ইউনানী ক্লিনিকের মালিক কবিরাজ জাহাঙ্গীর হোসেন আহমেদ বলেন, চীনাবাদমে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ ভোজ্য তেল পাওয়া যায়। এটি তৈলবীজ হিসেবে সুপরিচিত হলেও এর যথেষ্ট ঔষধি গুন রয়েছে। এতে শতকরা ২৫-৩৩ ভাগ প্রোটিন, ৪০-৫০ ভাগ চর্বি, ১০-২০ ভাগ কার্বোহাইড্রেট, ২-৩ ভাগ আঁশ, ৭-৮ ভাগ পানি, চুন, ফসফরাস, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ পাওয়া যায়। তাছাড়া এর খইলে ৪২ ভাগ ক্রুড প্রোটিন, ৭ ভাগ চর্বি, ২০ ভাগ কার্কোহাইড্রেট, ৭-৮ ভাগ নাইট্রোজেন, ১.৫ ভাগ ফসফরিক এসিড এবং ১-২ ভাগ পটাশ থাকে। তাই গবাদি পশু ও মুরগীর জন্য এই খইল উৎকৃষ্ট খাদ্য। তাছাড়া বনস্পতি প্রস্তুত, সাবান, সুগন্ধি দ্রব্য, মোম ও বিভিন্ন ঔষুধ তৈরিতে বাদাম বীজ ব্যবহার করা হয়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর বলেন, উপজেলায় ১ হাজার ৭৫০ একর (৭০০ হেক্টর) জমি অনাবাদি রয়েছে। তার মধ্যে কিছু আছে যেখানে চীনাবাদাম চাষ করা সম্ভব। ওইসব জমিতে বাদাম চাষ করতে পারলে কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। সে লক্ষে নদীর তীরবর্তী ,অনাবাদি জমি ও চর এলাকার কৃষকদের বাদাম চাষ করে অনাবাদি জমিকে কাজে লাগাতে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। দিন দিন চাষের পরিমাণ বাড়ায় স্থানীয় বাজারের বাদাম ফেরিরা বলেন আগে দূর দুরান্ত থেকে বাদাম কিনে আনতে হতো। এখন আমরা নিজের উপজেলা থেকেই কিরতে পারছি। তাতে লাভের পরিমান বেড়েছে। স্থানীয় ভাবে বিক্রি করতে পারায় পরিবহন খরচ বেচেঁ যাচ্ছে, ফলে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরাও। আগামীতে চাষির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেক কৃষক।