কৃষির সাফল্য
বশিরুল ইসলাম
কৃষির সাফল্য ঃ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মূহুর্তে আনন্দে উল্লসিত মানুষের সে হাসি! সব হারানোর মাঝেও সব কিছু ফিরে পাওয়া মানুষের মুখ- ধ্বংসস্তুপের মাঝেও নতুন করে সব কিছু শুরু করার অফুরান প্রাণশক্তি আমি দেখিনি। কারণ আমার জন্ম ৮৬ তে, দেশ বিজয়ের ১৫ বছর পর। তবে মা-বাবা, গুরুজনদের মুখে বিজয়ে গল্প শুনেছি। শুনেছি সে সময় কৃষির অবস্থা। তবে দেখেছি এবং দেখছি কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের যৌথ প্রয়াসে দেশের কৃষির বিজয়।
ঠিক আজকের কথা বলি, কোথায় আছি আমরা? দেশ বিজয়ের সময় যেখানে লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি আজ সেখানে ১৭ কোটি লোকের বসবাস। এ সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে দেশকে। তখন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হতো। অথচ ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনে এ দেশটিতে কৃষি জমি এক শতাংশও বাড়ছে না। বরং কৃষি জমিতে স্থাপনা, কারখানা রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে। তারপরও ক্ষয়িষ্ণু আবাদি জমি থেকে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। এককথা কৃষি খাতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কৃষির সাফল্য ঃ এশিয়ার গ-ি পার করে বিশ্বে সবজি উৎপাদনে জনবহুল বাংলাদেশ এখন তৃতীয় অবস্থানে। লবণাক্ত, খরা, জলমগ্নতা সহনশীল ও জিংকসমৃদ্ধ ধানসহ ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। যার কারণে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ অবস্থানে। কেবল সবজি আর ধানেই নয় মাছ, ছাগল উৎপাদনেও বিশ্বে আয়তনের দিক থেকে অনেক পেছনে থাকা বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ, আমে সপ্তম ,আলুতে অষ্টম এবং ফলে ১০ ম। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমান ইলিশ উৎপাদন হয়-এ মধ্যে আমাদের দেশেরই উৎপাদন হচ্ছে ৮৬ শতাংশ।
এখন প্রশ্ন থাকতে পারে – এ সাফল্যের রহস্য কি ? একজন কৃষিবিদ হিসেবে মনেকরি, এ সাফল্য অনুঘটক হচ্ছে দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদি শক্তি কৃষি অর্থনীতিতে ধারাবাহিক সাফল্য। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন বাড়ার পেছনে প্রধান উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। তার সঙ্গে বিশেষ অবদান রয়েছে কৃষি বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিবিষ্ট গবেষণায় নতুন নতুন উচ্চফলনশীল, কম সময়ে ঘরে তোলা যায় এমন জাতের কৃষিবীজ উদ্ভাবন। সহজ কিস্তিতে ঋণব্যবস্থার কারণে কৃষিতে কাঙিক্ষত সাফল্য এসেছে। এ ছাড়া দেশে শিক্ষিত কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে কৃষকের ছেলেই কৃষক হবে- এমন ধারণা থেকে আমরা বের হতে পেরেছি। এছাড়া, সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিতের পদক্ষেপ গ্রহণে ফলে কৃষিতে আজ বিশ্ব পরিমন্ডলে যা উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলছে।
এ উজ্জ্বল নক্ষত্র জ্বলার প্রধান কারিগর হচ্ছে এ দেশের কৃষক। কৃষক প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিভিন্ন ধরণের ফসল উৎপাদন করে যেমন দেশবাসীর খাদ্য চাহিদা পূরণ করছে, তেমনি নিজেদের ভাগ্যেরও বদল ঘটাচ্ছে। অর্জন করছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। প্রধান ফসলের পাশাপাশি নানা বিকল্প ফসল উৎপাদনেও তারা সফলতা দেখাচ্ছে। ধান উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা যেমন অর্জন হয়েছে। তার পাশাপাশি মৎস্য, পোল্ট্রি, গরু-ছাগল, আলু, গম, ভূট্টা ও নানা রকম সবিজ উৎপাদনে দেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের অভাবনীয় সাফল্য জাতিকে নতুন দিশা দেখাতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে দেড় টন চাল উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টর প্রতি উৎপাদন হচ্ছে চার টনেরও বেশি। তাছাড়া হেক্টর প্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বে গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পরে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ রফতানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। ব্লাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। বাংলাদেশের ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আম উৎপাদনের বিশ্বে মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উপস্থাপনে। আর আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ দশ দেশের কাতারে এসেছে দেশ। বাংলাদেশ থেকে আলু, সবজি আর আম রফতানি হচ্ছে বিদেশে। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। সরকারের ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশের উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে। চিংড়ি রফতানি থেকে প্রতি বছর আমাদের আয় ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া পুষ্টির অন্যান্য উৎপাদন ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদনও বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে বৃদ্ধি পেয়েছে এসব পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জনপ্রতি প্রাপ্যতা।
এক সময় বলা হতো ‘দুধে ভাতে বাঙালি’ কিংবা বলা হতো ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। বর্তমান সরকার তার সুপ্রসারিত কৃষি নীতিতে শুধু দুধে ভাতে বা মাছে ভাতে সীমিত নয় পুষ্টিতে বাঙালি হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হতে চায়। সে লক্ষে বর্তমান সরকার এগিয়ে চলছে। গ্রহণ করছে নানা প্রদক্ষেপ। এ মধ্যে কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণ সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়ে রূপকল্প-২০২১ এবং রূপকল্প-২০৪১ গ্রহণ করা হয়েছে। এর আলোকে জাতীয় কৃৃষিনীতি সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন ডেল্টাপ্লান-২১০০সহ বেশ কিছু পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানা পদক্ষেপের ফলে কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে এ দেশের অবস্থান এখন ১০ম। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান এখন ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।
আজ আমাদের কৃষির সাফল্য এর পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। তা হচ্ছে, আমাদের কৃষকরা বছরের পর বছর তাদের বহু কষ্টে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। কোনো ভাবে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না কৃষি পণ্যের সঠিক মূল্য। তাছাড়া প্রতি বছর একশতাংশ হারে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে চাষাবাদ তথা খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন হয়তো উন্নতমানের প্রযুক্তি এবং উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার করেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তাহলে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যশস্য আমদানি করতে হবে। এজন্য এখন থেকেই যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে বলে আমি মনে করি।