আমন ধানের নতুন জাতঃ বিনাধান-১৭ এর চাষাবাদ করবেন যে ভাবে

বিনাধান-১৭


ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল*

বিনাধান-১৭ আমন মৌসুমের চাষাবাদের উপযোগী নতুন একাটি জাত যা জিন পিরামিডিং মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে। জাতটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রধান গবেষক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম, সিএসও বলেন যে, এটি উচ্চ ফলণশীল, স্বল্প মেয়াদী, খরা সহিষ্ণু (৩০% পানি কম প্রয়োজন), সার কম লাগে (প্রচলিত জাতের তুলনায় ২০-৩০% কম লাগে), আলোক অসংবেদনশীল ও উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন রোপা আমন জাত। গাছ খাট ও শক্ত বলে হেলে পড়ে না । পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ৯৬-৯৮ সেঃমিঃ। পাতা গাঢ় সবুজ ও খাড়া। এটি আগাম পাকে, ব্রি ধান-৩৯ অপেক্ষা প্রায় এক সপ্তাহ আগে ধান কাটা যায় এবং ব্রি ধান-৩৯ অপেক্ষা প্রায় ২০% বেশী ফলন দেয়। জীবন কাল ১১২-১১৮ দিন। । আগাম পাকে বিধায় কাটার পর সহজেই আলু, গম বা রবিশস্য চাষ করা যায়। এটির ধান উজ্জ্বল বংয়ের। ধান ও চাল লম্বা এবং চিকন, খেতে সুস্বাদু। ফলে বাজার মূল্য বেশী ও রপ্তানীর উপযোগী। যথোপযুক্ত পরিচর্যার হেক্টর প্রতি ৬.৮-৭.৫ টন (একরে ৬৮-৭৫) ফলন দেয়। চাউলে এ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৪.৬%। রান্নার পর ভাত ঝরঝরে হয় এবং দীর্ঘক্ষণ রাখলে নষ্ট হয় না। জাতটি বিভিন্ন রোগ যথাঃ পাতা পোড়া, খোল পঁচা ও কান্ড পঁচা ইত্যাদি রোগ তুলনামূলকভাবে বেশী প্রতিরোধ করতে পারে। এছাড়া এই জাতটির প্রায় সব ধরনের পোকার আক্রমন, বিশেষ করে বাদামী গাছ ফড়িং, গলমাছি ও পামরী পোকার আক্রমন প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশী। এটির জীবনকাল কম বিধায় নাবিতেও রোপনের উপযোগী। বিনাধান-১৭ আমন মৌসুমের জন্য আনুমোদিত হলেও জাতটি প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায় অর্থাৎ আউস ও বোরো মৌসুমে চাষ করা যায়।

বিশেষ গুণ: ধান চাষ বৃদ্ধির সাথে সাথে তেল ও ডাল জাতীয় শস্যের জমি কমে যাচ্ছে। ফলে এ দু’টি শস্যের মোট উৎপাদন কমে গেছে। বিনাধান-১৭ উচ্চ ফলনশীল এবং এর জীবনকাল তুলনামুলকভঅবে অনেক কম বলে শস্য নিরিড়তা বাড়ানোর জন্য খুবই কার্যকর। প্রচলিত জাতের তুলনায় ২০-৩০% কম লাগে। আগাম পাকা জাত হিসেবে এ জাতটি চাষ করে সঠিক সময়ে তেল ও ডাল ফসল চাষ করা সম্ভব হবে। এছাাড়া গম ও আলু’র চাষ ও ভাল ভাবে করা যায়। সঠিক সময়ে জাতটির চাষাবাদে কার্ত্তিক মাসের মংগা মোকাবেলায় যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। জাতটি চাষ করে আমনের উচ্চ ফলনসহ আলু, ডাল ও তেল ফসল সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে এবং এসব ফসলের উৎপাদনও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

আঞ্চলিক উপযোগীতা : লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের প্রায় সকল রোপা আমন অঞ্চল বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা এবং রাজশাহীসহ ঢাকা, কুমিল্লা, যশোহর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ ও পার্বত্য অঞ্চলে জাতটির অধিক ফলন পাওয়া যায়।

চাষ উপযোগী জমি: বেলে দো-আঁশ এবং এটেল দো-আশঁ জমি বিনাধান-১৭ চাষের জন্য উপযোগী। বেশি নীচু জমি (যেখানে দীর্ঘদিন পানি জমে থাকে) ব্যতীত প্রায় সব ধরনের জমিতে চাষবাদ করা যায়।

চাষাবাদ পদ্ধতি: জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী রোপা আমন জাতের মতই। তবে এর জীভনকাল কম বিধায় ভাল ফলন পেতে হলে চারার বয়স ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিম্নে জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি দেয়া হ’লঃ
বীজ বাছাই ও শোধন: ভারী, পুষ্ট ও রোগবালাই মুক্ত বীজ বাছাই করুন এবং বপনের আগে বীঝ শোধন করা ভাল।

বীজতলা তৈরী: পাঁচ শতাংশ (২০০ বর্গ মিটার পরিমাণ বীজতলায় ১০ কেজি বীজ ফেলা যায়। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ হতে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ (আষাঢ়ের ২য় সপ্তাহ হতে শেষ সপ্তাহ) পর্যন্ত বীজতলা তৈরী করে ২০-২৫ দিনের চারা রোপন করলে ভাল ফসল পাওয়া যায়। তবে জুলাইয়ের শেষ (শ্রাবণের দ্বিতীয়) সপ্তাহ পর্যন্তও বীজতলা করা যায়।

চারার বয়স ও রোপন পদ্ধতি: জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ হতে আগষ্টের শেষ সপ্তাহ অর্থাৎ শ্রাবণ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে শুরু করে ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ২০-২৫ দিন বয়সের চারা রোপন কলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। বেশী বয়সের চারা লাগালে ফলন কমে যায়, তাই ৪ সপ্তাহের বেশী বয়সের চারা রোপন করা কোন অবস্থাতেই উচিৎ নয়। বীজতলায় চারা করার পর লাইন করে চারা রোপন করলে ফলন বেশি হয়। ২-৩ টি সুস্থ-সবল চারা একত্রে এক গুছিতে রোপন করতে হবে। সারি হতে সারির দূরত ২০ সেঃমিঃ ( ৮ ইঞ্চি) এবং সারিতে গুছির দূরত্ব ১৫ সেঃমিঃ ( ৬ ইঞ্চি) থাকা ভাল।

সার প্রয়োগ
সার বীজ তলার জন্য                                                          রোপা ক্ষেতের জন্য
প্রতি হেক্টরে      প্রতি একরে    প্রতি শতাংশে    প্রতি হেক্টরে    প্রতি একরে   প্রতি শতাংশে
ইউরিয়া (কেজি)      ৮০-১০০     ৩২-৪০               ০.৩-০.৪         ১২০-১৫০        ৪৮-৬০               ২০-২৪
টিএসপি (কেজি)     ৮০-৯০      ২৪-৩২               ০.২-০.৩          ৮০-১০০          ৩২-৪০                ১৫-১৭
এমপি (কেজি)        ২৫-৪০      ১০-১৬                 ০.১-০.২           ৩০-৫০           ১২-২০                  ৭-১০
জিপসাম                  ২০-২৫       ৮-১০                  ০.০৮-০.১         ২৫-৩৫          ১০-১৪                   ৩-৫

রোপন জন্য জমি তৈরীর শেষ চাষের আগে সম্পূর্ণ টিএসপি এবং এমপি জমিতে সমভাবে ছিটিয়ে চাষের মাধ্যমে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক পরিমাণ চারা রোপণের ৭-৮ দিন পর এবং বাঁকী অর্ধেক ৩০-৩৫ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে অথবা এক তৃতীয়াংশ চারা রোপনের ৭-৮ দিন পর, এক তৃতীয়াংশ চারা রোপনের ১৮-২০ দিন পর এবং শেষ তৃতীয়াংশ চারা রোপনের ৩০-৩৫ দিন পর জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে প্রয়োগ করতে হবে। অনুর্বর জমিতে হেক্টর প্রতি জিপসাম ২৫-৩০ কেজি (একর প্রতি ১০-১২ কেজি) এবং দস্তা সার ৩ কেজি (একর প্রতি ১.২৬ কেজি) হারে দেয়া যেতে পারে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের ২/১ দিন আগে জমির অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে এবং প্রয়োজন হলে আগাছা দমন করতে হবে। জমির উর্বরতা ও ফসলের অবস্থায় উপর নির্ভর করে ইউরিয়া সার প্রয়োগ মাত্রার তারতম্য করা যেতে পারে।

পরিচর্যা : এই জাতের ধানের পরিচর্যা অন্যান্য উফশী জাতের মতই। হবে এর জীবনকাল কম বিধায় চারা রোপণের পর আগাছা দেখা দিলে দ্রুত নিড়ানী যন্ত্র বা হাতের সাহায্যে আগাছা পরিস্কার ও মাটি নরম করতে হবে। বর্ষা মৌসুমের শেষে ফসল পাকার কিছু দিন পূর্বে পানির অভাব দেখা দিলে সেচের প্রয়োজন হতে পারে তবে ধান পাকার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি শুকিয়ে ফেলা ভাল।

রোগ ও পোকা – মাকড় দমন : রোগ বালাই ও কীট পতঙ্গের আক্রমণ দেখা দিলে নিকটস্থ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার উপদেশ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা নিলে প্রচলিত তরল বা আনাদার কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া খোলা ঝলসানো, ব্যাক্টেরিয়াল লিফব্লাইট বা পাতা ঝলসানো ও অন্যান্য রোগ দেখা দিলে উপযুক্ত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। খোল ঝলসানো, কান্ড পচাঁ রোগ দেখা দিলে বেনলেট, হোমাই, বেভিষ্টিন বা টপসিন মিথাইল মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োাগ করা যেতে পারে।

======

  • লেখক ঃপ্রিন্সিপাল সায়িন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইলঃ ০১৭১৬৭৪৯৪২৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *