Site icon

বিপন্ন প্রজাতির টেংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন

বিপন্ন প্রজাতির টেংরা

বিপন্ন প্রজাতির টেংরা

কৃষি সংবাদ ডেস্ক

বিপন্ন প্রজাতির টেংরা ঃ মিঠা পানির জলাশয়ে বিশেষ করে পুকুর, নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদি জলাশয়ে যে মাছগুলো পাওয়া যায় তাদের মধ্যে টেংরা অন্যতম। মাছটি খুবই সুস্বাদু, মানব দেহের জন্য উপকারী অণুপুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং কাটা কম বিধায় সকলের নিকট প্রিয়। এক সময় অভ্যন্তরিণ জলাশয়ে মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত কিন্তু শস্য ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় এ মাছের প্রাচুর্যতা ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে যার ফলশ্রুতিতে এটি আইইউসিএন (২০১০) এর বিপন্ন প্রজাতির মাছ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে টেংরার কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারী ব্যবস্থাপনা ও চাষের কলাকৌশল উদ্ভাবন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রজাতিটির সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুরে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে মাছটির কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও পোনা প্রতিপালন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সাফলতা লাভ করেছেন।

খরা প্রবণ রংপুর অঞ্চলে বেশিরভাগ জলাশয়ে ৫-৬ মাস পানি থাকে এবং এ অঞ্চলে মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে টেংরা পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে মৌসুমে জলাশয়ে চাষের আওতায় অন্যান্য মাছের বিকল্প হিসেবে মজুদ করতে পারলে এ অঞ্চলে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে।

টেংরা মাছের ব্র“ড প্রতিপালন, কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশলের জন্য নিম্মের পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করতে হয় ঃ

পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি– ব্র“ড প্রতিপালন পুকুরের আয়তন ৮-১০ শতাংশ ও গড় গভীরতা ১.০ মিটার রাখা হয়। ব্র“ড মাছ ছাড়ার আগে পুকুর শুকিয়ে প্রথমে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগের ৫ দিন পর শতাংশে ইউরিয়া ১০০ গ্রাম, টিএসপি ৭৫ গ্রাম ও গোবর ৪ কেজি ব্যবহার করা হয়। ব্র“ড প্রতিপালন পুকুরের চারপাশে জালের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা দিতে হবে।

টেংরা মাছের ব্র“ড মজুদ– বছরের এপ্রিল থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত টেংরা মাছের প্রজননকাল হিসেবে স্বীকৃত। প্রজনন মৌসুমের পূর্বেই অর্থাৎ জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত ৮-১০ গ্রাম ওজনের টেংরা মাছ সংগ্রহ করার পর প্রস্তুতকৃত পুকুরে প্রতি শতাংশে ৮০-১০০টি টেংরা মজুদ করে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্র“ড তৈরী করা হয়।

খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যা– ব্র“ড মাছের পরিপক্কতার জন্য প্রতিদিন দুইবার করে খাবার হিসেবে চালের কুঁড়া ২৫%, ফিসমিল ৩০%, সরিষার খৈল ২০%, মিট এন্ড বোন মিল ২৫% হারে মিশিয়ে প্রয়োগ করা হয়। মাছের দৈহিক ওজনের ৮-৫% হারে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। মজুদের ২ মাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর জাল টেনে ব্র“ড মাছের দেহের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। নিয়মিত পানির গুণাগুণ যেমন তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া ও মোট ক্ষারত্বের পরিমাণ পর্যবেক্ষন করতে হবে।

কৃত্রিম প্রজনন কৌশল– প্রজনন মৌসুমের পূর্বে পরিপক্ক পুরুষ ও স্ত্রী ব্র“ডের প্রতিপালন পুকুর থেকে সিস্টার্নে স্থানান্তর করা হয়। পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে যথাক্রমে ২ঃ১ অনুপাতে মসৃণ জর্জেট হাপায় স্থানান্তর করা হয়। সিস্টার্নে অক্সিজেন নিশ্চিত করতে কৃত্রিম ঝর্ণা ব্যবহার করা হয়। স্ত্রী মাছের ক্ষেত্রে কেজি প্রতি ৩০-৪০ মিগ্রা. ও পুরুষের ক্ষেত্রে কেজি প্রতি ১৫-২০ মিগ্রা. হারে পিজি এর দ্রবণ টেংরা মাছের বক্ষ পাখনার নিচে ইনজেকশন হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করার ৮-৯ ঘন্টা পর স্ত্রী টেংরা ডিম ছাড়ে। ডিম আঠালো অবস্থায় হাপার চারপাশে লেগে যায়। ডিম দেয়ার পর হাপা থেকে ব্র“ডগুলো সরিয়ে নিতে হবে। ডিম ছাড়ার ২০ থেকে ২২ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণু বের হয়। রেণুর ডিম্বথলি নি:শেষিত হওয়ার পর রেণুকে খাবার দিতে হবে। রেণু পোনাকে সেদ্ধ ডিমের কুসুমের দ্রবণ দিনে ৬ ঘন্টা পর পর ৪ বার দেয়া হয়। হাপাতে রেণু পোনাকে এভাবে ৮-১০ দিন রাখার পর নার্সারী পুকুরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

টেংরা মাছের নার্সারী ব্যবস্থাপনা

নার্সারী পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি– পোনা প্রতিপালন পুকুরের আয়তন ৪-৮ শতাংশ, গড় গভীরতা ১.০ মিটার রাখা হয়। পুকুর প্রস্তুতির জন্য পুকুর শুকিয়ে প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন দেওয়া হয় । এরপর শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৭৫ গ্রাম টিএসপি ও ৬-৮ কেজি গোবর সার ব্যবহার করা হয়। পুকুরের চারপাশে নাইলন নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।

পোনা সংগ্রহ ও নার্সারী পুকুরে মজুদ– হ্যাচারিতে উৎপাদিত ৮-১০ দিন বয়সের রেণু পোনা প্রতি শতাংশে ৮,০০০-১২,০০০টি হারে মজুদ করা যায়। নার্সারী পুকুরে মজুদের সময় পোনাকে পুকুরর পানির তাপমাত্রার সঙ্গে ভালভাবে খাপ খাওয়ানোর পর ছাড়তে হবে।

নার্সারী পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ- খাবার হিসেবে পুকুরে শতাংশে ২টি সেদ্ধ ডিমের কুসুম পানিতে মিশিয়ে পর পর ৩ দিন দিনে ৩ বার করে প্রয়োগ করতে হবে। এরপর ৪-৭ দিন ৫০ গ্রাম হারে ময়দার দ্রবণ প্রতি শতাংশে দিনে ৩ বার করে সরবরাহ করা হয়। ৮-১৫ দিন দিনে ৩ বার করে ১০০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হয়। ১৬-২৩ দিন দিনে ৩ বার করে ১৫০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৩২-৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হয় । ২৪-৩০ দিন দিনে ৩ বার করে ৩০০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৩২-৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হয়। ৩১-৪৫ দিন দিনে ৩ বার করে ৪৫০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৩২-৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হয়। ৪৬-৬০ দিন দিনে ৩ বার করে ৬০০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৩০-৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হয়। রেনু পোনা ছাড়ার ৫৫-৬০ দিন পর আঙ্গুলে পোনায় পরিণত হয়, যা চাষের পুকুরে মজুদের জন্য উপযোগী।

ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা– পোনা মজুদের ১৫ দিন পর থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছের দেহের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নিয়মিত পানির গুণাগুণ যেমন তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া ও মোট ক্ষারত্বের পরিমান নির্ণয় করতে হবে।

পোনা উৎপাদন ও আহরণ– উল্লেখিত পদ্ধতি অনুসরন করে নার্সারী পুকুরে পোনা মজুদের ৫৫-৬০ দিন পর পুকুর সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ৬-৭ সেমি. আকারের ট্যাংরা মাছের পোনা পাওয়া যায়।

ইনস্টিটিউট কর্তৃক গবেষণালদ্ধ কৌশল অনুসরণ করলে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি মৎস্য হ্যাচারিসমূহে টেংরা মাছের পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। টেংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ করা গেলে চাষের মাধ্যমে এতদাঞ্চল তথা দেশে প্রজাতিটির উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে এবং বিপদাপন্ন অবস্থা থেকে এ প্রজাতির উত্তরণ ঘটবে বলে আশা করা যায়।

Exit mobile version