নিতাই চন্দ্র রায়
বিশ্ব বন দিবস ঃ মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের পাশাপাশি প্রয়োজন সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ। পরিবেশ সুরক্ষায় বনের গুরুত্ব অপরিসীম। বনের বৃক্ষ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে। ছায়া দেয়। ফল দেয়। ফুল দেয়।বন্য প্রাণীদের খাবার ও আশ্রয় দেয়।বৃক্ষ ভূমিক্ষয় রোধ করে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বজ্রপাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে।‘ বন ও শিক্ষা’ এ স্লোগান উচ্চারণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সম্প্রতি (২১ মার্চ) পালিত হয় বিশ্ব বন দিবস। দিবসটি উপলক্ষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে সারা পৃথিবীতেই বনভূমির পরিমাণ কমে আসছে। কমে আসছে গাছপালা ও সবুজ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণও।সেই সাথে বিপন্ন হচ্ছে জীবজন্তু ও বন্যপ্রাণী। ক্ষয়িষ্ণু পরিবেশের প্রভাবে বিপন্ন হচ্ছে বন। এমন এক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ‘ বসবাসের জন্য নগরকে অধিকতর সবুজ ও স্বাস্থ্যকর করে গড়ে তুলতে হবে’-এ আহবান জানিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন দিবস। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলে রিও ঘোষণায় বন সৃজন ও রক্ষার্থে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২১ মার্চকে বিশ্ব বন দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পৃথিবীর মানুষ ক্ষুদ্র স্বার্থে বনভূমি ধ্বংস করে নিজেরাই নিজেদের কবর রচনা করছে। নরকে রূপান্তর করছে ইট পাথরের তপ্ত নগরগুলিকে। যেখানে বিশুদ্ধ বাতাস নেই। সুপেয় পানি নেই। সবুজ ছায়া নেই। পাখিডাকা ভোর নেই। নদীর কলকল ধ্বনী নেই। খাল-বিলে স্বচ্ছ জলের প্রবাহ নেই।জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ নেই। পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে এক শতাংশ ক্রান্তীয় বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে মানুষের নিষ্ঠুর নগ্ন হাতে। বিগত ৭০ বছরে পৃথিবীর মোট ক্রান্তীয় বনভূমির প্রায় ৫০ শতাংশ উজার হয়ে গেছে।স্যটেলাইট চিত্রে বিরান হয়ে যাওয়া বনভূমির যে চিত্র পাওয়া যায়, তা বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে যে, প্রতিবছর পৃথিবী থেকে পোনে দুই থেকে দুই কোটি হেক্টর বনভূমি মানুষের অবিবেচনা প্রসূত কর্মকা-ে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে শুধু বনভূমিই নয়; এর সাথে বনে বসবাসকারী হাজার প্রজাতির কোটি কোটি জীব-জন্তুর জীবনও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। বাসস্থান হারিয়ে এদের অনেকেই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব বন দিবসের উদ্দেশ্য হলো দেশের প্রতিটি নাগরিককে বনভূমি ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রত্যেককে সাধ্যমত বৃক্ষ রোপণে সক্রিয় করা। একইভাবে বন আইন অনুযায়ী একটি গাছ কাটতে হলে তার বিপরীতে ১০টি গাছ লাগানো এবং প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া গাছের যতœ নেয়া। এ আইন যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না, তা দায়িত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করা এবং আইনের ব্যত্যয় ঘটলে তার প্রতিকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটাই দৃশ্যমান হচ্ছে পৃথিবীতে। প্রকৃত চিত্র হলো গত দুই যুগে সারা পৃথিবীতে যে সংখ্যক গাছ কাটা হয়েছে, রোপণ করা হয়েছে তার মাত্র এক শতাংশ।
বর্তমান বিশ্বে শিল্পায়নের ফলে বায়ুম-লে কার্বন নিঃসরনের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। এর ফলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।আইলা, সিডর ও মহাসেনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছে মানুষ।অন্যদিকে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা, যার ফলে উপকূলীয় অঞ্চল লোনা পানিতে ডুবে গিয়ে সৃষ্ট হচ্ছে নানা রকমের সমস্যা। মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। হচ্ছে সুপেয় পানির অভাব।অসময়ে বন্যা , বৃষ্টিপাত ও নদী ভাঙ্গনের কারণে ফসলের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছে শহরের বস্তিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে হলে বনভূমি সুরক্ষা, নতুন বন সৃজন ,বসতবাড়ির আশেপাশে, রাস্তার ধারে, বাঁধের দু’ধারে, কলকারখানা, স্কুল ,কলেজ, অফিস আদা লতের অব্যবহৃত জায়গা, শহরাঞ্চলের বাড়ির ছাদ, বারান্দা ও বেলকোনিতে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের কোনো বিকল্প নেই।বিকল্প নেই বনায়নের জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির।
কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশটির মোট ভূমির ২৫ শতাংশে বনভূমি থাকা আবশ্যক। কিন্তু বাংলদেশে সরকারির হিসেবে শতকরা ১৭ ভাগ জমিতে বনভূমি রয়েছে। আর বেসরকারি হিসেবে বনভূমির পরিমাণ আরও অনেক কম। বাংলাদেশের প্রধান বনভূমি সুন্দরবন দেশের মোট বনভূমির ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া আছে চট্টগ্রামের পাহাড়ী বনাঞ্চল এবং মধুপুর, গাজীপুর, শ্রীপুর , ভালুকা ও দিনাজপুরের শালবনসহ কিছু বনাঞ্চল, যার সবই সরকারি বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন। বন বিভাগের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি ও লোভ-লালসার কারণে এসব সরকারি বনভূমি আজ হুমকির সম্মুখীন। এছাড়া এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের অতি লোভের কারণে ঢাকার ফুসফুস হিসেবে খ্যাত ভাওয়ালের গজারিবন আজ ধ্বসের পথে।শুধু গাছই নয়; বন্য প্রাণীরা ও রেহাই পাচ্ছেনা এদের হাত থেকে। গত বছর জাতীয় সংসদে সাবেক পরিবশে ও বন মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের পরিবেশিত এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ২৬ লাখ হেক্টর এবং এর মধ্যে ২ লাখ ৬৮ হাজার একর সরকারি বনভূমি বেদখলে রয়েছে( ইত্তেফাক ১৯ জুন, ২০১৮)। বনভূমি উজার হওয়ার কারণে বাঘসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিপুল সংখ্যক প্রাণি আজ বিলুপ্তির হুমকির মুখে। এসব প্রাণির মধ্যে রয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, মায়া হরিণ, সজারু, মেছো বাঘ, বন বিড়াল, গুই সাপ, বাগডাস, ইরাবতি ডলফিন, লবণ পানির কুমির, সজারু, ভোদর, লাল মাছ রাঙ্গা, খয়েরি মাছ রাঙ্গা ,জলপাই,কচ্ছপ, অজগর,সঙ্খচূর সাপ ও শুশুক ।
অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনের কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র। ধ্বংস হয়েছে ৬ হাজার ১৬৩ একর বনভূমি।এ ছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে উখিয়া ও টেকনাফের বন্যাঞ্চল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বনবিভাগ। বনবিভাগ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি ও প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয ব্যবস্থা নিতেও অনুরোধ করা হয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানির ব্যবস্থা করতে না পারায় বনভূমির ওপর চাপ বাড়ছে।পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের ৬ হাজার ৮ ০০ টন জ্বালানির প্রয়োজন হয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হলেও রান্নার জন্য কোনো জ্বালানি সরবরাহ করা হয় না।ফলে প্রতিদিনই তারা বনাঞ্চল থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করছে। বনবিভাগ তাদের পাঠানো প্রতিবেদনে বলছে, ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্য বন থেকে প্রচুর পরিমাণে কাঠ ও বাঁশ সংগ্রহ করছে রোহিঙ্গারা। পাহাড় কেটে মাটি সমান করে ঘরবাড়ি তৈরি করছে তারা। কক্সবাজার জেলার পাহাড়গুলো প্রধানত নরম ও দোআঁশ মাটির হওয়ায় মাটির কাঠিন্য ও দৃঢ়তা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে টানা কয়েক দিন বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা বেড়ে যায়। গত বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে অনেক ক্ষতি হয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড় ও বনভূুমি কেটে অপরিকল্পিত রোহিঙ্গা বসতি, রাস্তাসহ অনান্য স্থাপনা তৈরি করায় এবং গাছ কাটার কারণে মাটি উন্মুক্ত হয়ে গেছ। এতে বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গা বসতি এলাকায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে। বন বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ নিয়ন্ত্রাধীন উখিয়া ও টেকনাফে ২ হাজার ২৭ একর সৃজিত বনভূমি এবং ৪ হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে গেছে। এপর্যন্ত ৮ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ জন রোহিঙ্গা বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭ টি গোসলখানা, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০ টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক একটি অবকাঠামো তৈরি করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বনভূমি ও বনজ সম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলেও জায়গা জবর দখল হয়ে যেতে পারে এবং স্থানগুলো অপসারণ করে বনায়ন করাও কঠিন হয়ে পড়বে।
কৃষি ও শিল্পের বিকাশের জন্য বনভূমি ধ্বংস করতে হবে-এ কথা আমারা বিশ্বাস করি না। মালয়েশিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ বনভূমি সুরক্ষা করেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছে।মালয়েশিয়ায় এখনও বনাঞ্চলের পরিমাণ দেশের মোট আয়তনের ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ । দক্ষিণ কোরিয়ায় এই হার ৬৭ দশমিক ৬ এবং জাপানে ৬৩ শতাংশ। আর আমরা শিল্প ও কৃষি উন্নয়নের অজুহাতে গাজীপুরের মতো জায়গায় গত এক দশকে ৭৯ শতাংশ বনাঞ্চল কী নির্মমভাবে ধ্বংস করেছি। ২০০৬ থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত উজার হওয়া বনের ৪০ শতাংশ কৃষি জমিতে রূপান্তর করেছি। পরিবেশ ধ্বংস করে যে উন্নয়ন টেকসই হয় না- এটা এখন সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত সত্য।
এ অবস্থায় বিশ্ব বন দিবসে আমাদের অঙ্গিকার হোক- বাংলাদেশের বনভূমি ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান ।প্রয়োজনে বনবিভাগকে ঢেলে সাজানো । বন রক্ষায় বনবিভাগ এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও সক্রীয় করে তোলা। দখলকৃত বনভূমি উদ্বার করে সেখানে নতুন করে বন সৃজন । বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণী হত্যা এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে ব্যবস্থা গ্রহণ ।বন সুরক্ষাকে একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করা। বনের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা ও ভালোবাস সৃষ্টি । কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার নামে বনভূমি ধ্বংস না করা।বনভূমির আশেপাশে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো শিল্প কারখান বা ইটভাটা স্থাপন না করা। এছাড়া বাংলাদেশের বনভূমি রক্ষা তথা দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশের সাড়ে ষোল কোটি মানুষের জীবনজীবিকা রক্ষা করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হবে না।সম্ভব হবে না ২০৩১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশের স্বপ্নের সঠিক বাস্তবায়ন।
…
লেখকঃ সাবেক মহাব্যস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ
গোপালপুর , নাটোর