অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান
বেগুনী ভূট্টার ভূমিকা
ভূট্টা ফসল বাংলাদেশে দানাদার ফসল হিসেবে ধান ও গমের তুলনায় অনেকটা নতুন। এদেশে ভূট্টা ফসলের প্রবর্তন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৬০ সালের দিকে। মুলতঃ সিমিট (CYMMIT) স্বল্প পরিসরে গবেষণার জন্য ভূট্টা বাংলাদেশে আনে। পরবর্তিতে ভূট্টা ফসলের চাষ শুরু হয় এদেশে ১৯৮৬ সালে। সিমিট কর্তৃক ভূট্টার মুক্ত পরাগী (Open Pollinated) কিছু জাত যেমন- বর্ণালী, শুভ্রা, মোহর ইত্যাদি রিলিজ করার মাধ্যমে। পরবর্তিতে সিমিট ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) আরও কিছু মুক্ত পরাগী ও হাইব্রিড ভূট্টার জাত বের করে। বারি ও অনেক গুলো বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (NGO) এর বদেীলতে ১৯৯০ সাল হতে এদেশে ভূট্টার বানিজ্যিক চাষ শুরু হয় এবং কৃষক পর্যায়ে এ ফসলটি ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ২০১৭ পর্যন্ত বারি কর্তৃক ১৫টি হাইব্রিড ও ৮টি মুক্ত পরাগী ভূট্টার জাত রিলিজ হয়েছে।
ধান ও গমের তুলনায় ভূট্টা চাষে অনেক সুবিধা ও এর বহুমূখী ব্যবহার থাকার কারনে বাংলাদেশে ভূট্টার চাষ কৃষক পর্যায়ে দ্রুত প্রসার লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে চাষের আওতাধীন মোট জমির ৭৫ ভাগই ধানের আওতায় রয়েছে। এর পরেই ভূট্টার (৩%) অবস্থান যদিও কয়েক বছর আগেও এ দ্বিতীয় অবস্থানটি ছিল গমের। ১৯৯০ সালে বানিজ্যিক ভাবে ভূট্টার চাষ শুরু হওয়ার পর প্রতিবছর প্রায় ১৫-২০% হারে এদেশে ভূট্টা চাষের প্রসার লাভ করে। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে এদেশে এর আগের বছরের ২০১৩-১৪ তুলনার ৭% বেশী জমিতে ভূট্টা চাষ প্রসার লাভ করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫-১৬ বছরে এদেশে ভূট্টার উৎপাদন ছিল ২.৭৫ মিলিয়ন টন যা গমের বার্ষিক ফলনের ১.৩৫ মিলিয়ন টন এর দ্বিগুন।
দানার রং ও তার ব্যবহারের দিক থেকে নানা প্রকার ভূট্টা দেখা যায়। যেমন-হলুদ ভূট্টা, সাদা ভূট্টা, খই ভূট্টা, বেবী কর্ণ প্রভৃতি। বাংলাদেশে গো-খাদ্য, মুরগী ও মাছের খাদ্য হিসেবে হলুদ ভূট্টা বেশ পরিচিত। শহর অঞ্চলে বেবি কর্ণ ও খই ভূট্টা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সাদা ভূট্টা সম্পর্কে তেমন কিছু আমরা জানি না। সাদা ভূট্টা এদেশে ১৯৮৬ সালে প্রবর্তন হলেও যথাযথ সম্প্রসারণ ও গবেষণার অভাবে এদেশে প্রসার লাভ করতে পারেনি। যদিও আফ্রিকা, দঃ আমেরিকার অনেক দেশে সাদা ভূট্টা প্রধান দানাদার ফসল হিসেবে অতি সমাদ্ধিত। বাংলাদেশেও এর প্রচুর সম্ভবনা রয়েছে। এসব ভূট্টা ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপান সহ অন্যন্যে দেশে পারপাল বা বেগুনী ভূট্টা নামে আরও একটি ভূট্টা বেশ পরিচিত ও চাষ হয়।
পারপাল বা বেগুনী ভূট্টা অনেক দেশে নীল বা লাল ভূট্টা নামেও পরিচিত। এ ভূট্টার দানা বা কার্ণেল গাঢ় বেগুনী রঙের হওয়ায় একে পারপাল ভূট্টা বলে। পেরু, বলিভিয়া, ইকোয়েডর, চিলি প্রভৃতি দেশে পারপাল ভূট্টা হতে বেগুনী রঙের এক ধরনের জনপ্রিয় ও স্বাস্থ্যকর পানীয় তৈরী হয় যার নাম ছিছিয়া মোরাডা (Chicha Morada)। তাছাড়া পারপাল ভূট্টার আটা হতে তৈরী মাঝা মোরা (Mazamora) পুডিং দক্ষিন আমেরিকায় একটি জনপ্রিয় স্বাস্থ্যকর খাবার।
বেগুনী বা পারপাল ভূট্টার রঙের জন্য দায়ী এক শ্রেনীর পানিতে দ্রবিভূত পলিফেলোলিক জাতীয় ফ্লাভিনায়েড (Flavinoid) শ্রেণীর এন্থোসায়নিন যৌগ যা এ জাতীয় ভূট্টাকে অন্য ভূট্টা হতে স্বতন্ত্র, দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষনীয় ও স্বাস্থ্যকর করেছে। সায়ানিডিন-৩-গ্লুকোসাইড (Cyanidin-3-Glucoside) নামক এক প্রকার রাসয়নিক রঞ্জক বেগুনী ভূট্টার প্রধান উপাদান। গবেষণায় দেখা গেছে ১০০ গ্রাম বেগুনী ভূট্টার আটায় প্রায় ৬২.৭ মি.গ্রা. এন্থোসায়ানিন পাওয়া যায়। যেসব ভূট্টার বীজের আবরন ও এলিয়োরণ (Aleuron) বেগুনী রঙের হয় সে সব ভূট্টাতে অধিক পরিমাণে ১৪১.৭ মি.গ্রামেরও বেশী এন্থোসায়ানিন থাকে। দক্ষিন আমেরিকা মোরাডা নামক বেগুনী ভূট্টার স্থানীয় জাতে প্রতি ১০০ গ্রাম আটাতে ১৬০০ মি.গ্রাম পর্যন্ত এন্থোসায়ানিন পাওয়া গেছে।
উদ্ভিদজাত খাবারের পুষ্টি উপাদানের মধ্যে এন্থোসায়নিন একটি অন্যতম আকর্ষনীয় পুষ্টি উপাদান যার রয়েছে এন্টি-অক্সিডেন্টসহ অনেক স্বাস্থ্যকর গুনাগুন। যার কারনে যুগযুগ ধরে রাজা-বাদশা সহ পুষ্টি সচেতন মানুষেরা বেগুনী, নীল, কমলা, লালসহ নানা রঙের এন্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ খাবার খুজে বেড়ায়। এন্টি-অক্সিডেন্ট ছাড়াও এন্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ খাবারে রয়েছে এন্টি-ইনফ্লামেটোরী, এন্টি-ক্যানসার, এন্টি-মাইক্রোর্বিয়াল, ও এন্টি-এজিং গুনাবলী। এন্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ খাবার শরীরে খারাপ কোলেষ্টেরল (LDL) কমায়, স্থুলতা কমায়, ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রন রাখে, দৃষ্টি শক্তি বাড়ায়, স্নায়ু-ক্ষয় জনিত রোগ কে দমন রাখে, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ও তারুণ্য ধরে রাখে। শরীরে তৈরী হওয়া বিভিন্ন বিক্রিয়ক অক্সিজেন বা মুক্ত মুলকের (Free Radical) ক্ষতিকর প্রভাব হতে এন্থোসায়ানিন জাতীয় খাবার দেহকে রক্ষা করে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও দেহকে দীর্ঘ মেয়াদী রোগ হতে রক্ষা করে।
বেগুনী ভূট্টায় প্রচুর পরিমানে এন্থোসায়ানিন থাকায় পৃথিবীর অনেক দেশে এর চাহিদা ব্যাপক। পেরু, বলিভিয়াতে ইকেডোর ইত্যাদি দেশের মানুষেরা বেগুনী ভূট্টা হতে স্বাস্থ্যকর “চিচিয়া মোরাভা ” পানিয় ও বেগুনী ভূট্টার আটা হতে বেগুনী রঙের রুটি, কেক, পুডিং ইত্যাদি তৈরী করে। তাছাড়া অপরিপক্ক বেগুনী ভূট্টা চিবিয়ে বা সালাদের সাথে খাওয়ার প্রচলন অনেক দেশেই রয়েছে। বেগুনী ভূট্টা হতে সংগ্রহীত এন্থোসায়ানিন বিভিন্ন খাবারে রং করার জন্যও ব্যবহৃত হয়। জাপানে বেগুনী ভূট্টার এন্থোসায়ানিনের রং ফুড এডিটিভ এর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এই রং বিভিন্ন খাবার যেমন-পানীয়, জ্যাম, জেলী, ক্যানডি, চকলেট ইত্যাদি খাবার রং করায় ব্যবহৃত হয়।
আমেরিকার ওহিও স্টেট ইউনির্ভাসিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে যে বেগুনী ভূট্টার এন্থোসায়ানিন অন্যান্য ফসল যেমন-আঙ্গুর, বেগুনী গাজর, চকবেরী হতে সংগ্রহীত এন্থোসায়ানিনের চেয়ে ৫০% ভাগ বেশী ক্যান্সার বৃদ্ধি রোধ করতে পারে। উক্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে বেগুনী ভূট্টার এন্থোসায়ানিন ২০% ক্যান্সারের সেলকে In vitro অবস্থায় মেরে ফেলতে পারে। গবেষণায় তাছাড়া আরও দেখা গেছে বেগুনী ভূট্টার এন্থোসায়ানিন স্থুলতা ও ফুলে যাওয়া (এন্টি-ইনফ্লামেটোরী) প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশের বেগুনী ভূট্টা গবেষণাঃ
বাংলাদেশে বেগুনী ভূট্টা নিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান ২০১৫ সাল হতে বেগুনী ভূট্টার জাত উদ্ভাবনে গবেষণা করে আসছেন। দীর্ঘ গবেষণার ফলস্বরুপ বর্তমানে ড. জামিলুর রহমান বেগুনী ভূট্টার কিছু ফলনশীল অগ্রসারী লাইন উদ্ভাবন করেছেন। এ সমস্ত বেগুনী ভূট্টার দানা গাঢ় বেগুনী রঙের এবং এমনকি সম্পূর্ন ভূট্টা গাছের রঙ গাঢ় বেগুনী বর্ণের হয়। এমনকি ভূট্টার পুরুষ ফুল (টাসেল) এবং স্ত্রী ফুলও (কবস) সম্পূর্ন বেগুনী বর্নের হয়। এ বেগুনী ভূট্টার ফলন ৫-৬ টন/হে: এবং রবিতে ১১০-১১৫ দিনে ও খরিপে ৯০-৯৫ দিনে ভূট্টা সংগ্রহ করা যায়। এ বেগুনী ভূট্টার চাষ প্রণালী অন্য ভূট্টার মতই একই রকম। ড. জামিলুর রহমান আশা করছেন ২০১৯ সালের মধ্যে আগ্রহী কৃষকের মধ্যে এ বেগুনী ভূট্টার বীজ সরবরাহ করতে পারবেন।
বাংলাদেশ অনুন্নয়নশীল দেশের কাতার হতে এখন উন্নয়নশীন দেশের কাতারে। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি এখন পুষ্টি নিরাপত্তার কথা প্রায়শঃ শোনা যায়। ভূট্টা একটি বহুমুখী শস্যে এবং পুষ্টিমানে ভূট্টা অনেক শস্যের চেয়ে বেশী পুষ্টিকর। বেগুনী ভূট্টার খাবার মান বিশেষ করে আমিষ ও এন্থোসায়ানিনের পরিমান বেশী থাকায় জাতীয় পুষ্টি নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যে ভাল ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করা যায়। তাই বেগুনী ভূট্টার উপযুক্ত জাত উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে এর সম্প্রসারণ একান্ত প্রয়োজন।
*লেখকঃ প্রফেসর, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি), ঢাকা-১২০৭