কৃষিবিদ ড. এম. এ. মান্নান
বাংলার সকল কৃষক কিষাণী ভাই বোনদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি এ সময়ের কৃষি। বাংলা নববর্ষের সূচনা মধ্য মার্চ থেকে। এ মাস দিয়েই শুরু হয় ষড়ঋতুর প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মে সূর্ষের প্রখর তাপে তেতে যায় মাটি। মাঝে মাঝে দুরন্ত গতিতে ধেয়ে আসে কালবোশেখী ঝড়। ঝড়ের তান্ডবে ঝরে পড়ে গাছের কচি আম। উল্লাসে মেতে ওঠে কিশোর-কিশোরী। ঝড়ের দিনে আম কুড়িয়ে আনন্দ পায় তারা। আর কৃষক তখন আল্লার কাছে দোয়া করে তার ধান গুলো যেন নষ্ট হয়ে না যায়। প্রিয় কৃষক কিষাণী ভাই বোনেরা আপনাদের সবাইকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানায়ে শুরু করছি এসময়ের কৃষি। চলুন প্রথমেই আলোচনা করি ধান নিয়ে।
ধান
বোরো ধান ক্ষেতে এখন থোড় আসার সময়। আপনার ক্ষেতের ধান গাছে থোড় আসা শুরু হলে জমিতে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। আবার ধানের দানা শক্ত হয়ে গেলে জমির পানি বের করে দিন। বৈশাখ মাসে বোরো ধান ক্ষেতে মাজরা পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িং, গান্ধি পোকা, লেদা পোকা, শিষ কাটা লেদা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ হতে পারে। তাছাড়া বাদামি দাগ রোগ, ব্লাস্ট রোগ, পাতা ঝলসানো রোগসহ অন্যান্য রোগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। পরিমিত সার ব্যবস্থাপনা, সেচ, সমম্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম), আন্তঃপরিচর্যা অবলম্বন করে ফসল রক্ষা করুন। রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত না হলে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করুন। বোনা আউশ ও বোনা আমন ক্ষেতের আগাছা পরিস্কার করুন এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য যতœ নিন।
পাট
এখন তোষা পাট বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। পাট চাষ করতে চাইলে ভালো জাতের বীজ সংগ্রহ করুন। তোষা পাটের উন্নত জাত হলো ও-৪ এবং ফাল্গুনী তোষা। দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে তোষা পাটের উৎপাদন ভালো হয়। তোষা পাট চাষের জন্য বীজ বপনের আগে বীজ শোধন করে নিন। প্রতি কেজি বীজে ৪ গ্রাম ভিটাভেক্স বা ১৫০ গ্রাম রসুন পিষে বীজের সাথে মিশেয়ে নিন এবং রোদে শুকিয়ে জমিতে বপন করুন। বীজ সারিতে বা ছিটিয়ে বপন করতে পারেন। সারিতে বুনলে এক হেক্টর জমির জন্য ৪-৫ কেজি এবং ছিটিয়ে বুনলে ৬-৮ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তোষা পাট চাষের জন্য প্রতি হেক্টর জমিতে ১০০ কেজি এমওপি প্রয়োগ করুন। এ ছাড়া জমি চাষের সময় বা তার আগে হেক্টরপ্রতি ৪-৫ টন গোবর বা আবর্জনা পচা সার প্রয়োগ করুন।
গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি
ইতোমধ্যে অনেকেই গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষ শুরু করেছেন। সবজি চাষ শুরু না করলে এখনই গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষের উদ্যোগ নিন। চিচিঙা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, করলা, মিষ্টিকমড়া, চালকুমড়াসহ অন্যান্য সবজির জন্য মাদা তৈরি করুন। মাদার মাটির সাথে ১০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি এবং পরিমাণমত জৈব সার ভালো করে মিশিয়ে নিন এবং সপ্তাহ খানেক পরে মাদায় বীজ বা চারা রোপণ করুন। গ্রীষ্মকালীন এ সব সবজি লতানো বলে মাছা তৈরি করে তাতে উঠিয়ে দিন।
কুমড়া জাতীয় সবজিতে কৃত্রিম পরাগায়নের প্রয়োজন হয়। এতে ফলন বেশি পাওয়া যায়। আবার এসব ফসলে মাছি পোকার উপদ্রব দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার করে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। একশত গ্রাম পাকা মিষ্টিকুমড়া থেঁতলিয়ে তাতে আধা গ্রাম ডিপটেরেক্স-৮০ বা আধা মিলিলিটার ডিডিভিপি বা ১০ ফোঁটা ডারসবান মিশিয়ে একটি বাটিতে রেখে মাঁচায় ঝুলিয়ে দিন। ২/৩ দিন পর পর বিষটোপ বদলিয়ে দিন। এক হেক্টর জমিতে ৩৫-৪০ টি বিষটোপ ফাঁদ প্রয়োজন হয়।
বৈশাখ মাসে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষের উদ্যোগ নিন। এ ক্ষেত্রে বারি টমেটো-৪, বারি টমেটো-৫, বারি টমেটো-৬, বারি টমেটো-১১, বিনা টমেটো-১, বিনা টমেটো-২ জাতের চাষ করতে পারেন।
এসময় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চারা মূল জমিতে রোপণের উদ্যোগ নিতে পারেন। এতে পেঁয়াজের চাষ থেকে অধিক লাভ পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের উন্নতজাত হলো বারি পেঁয়াজ-২ এবং বারি পেঁয়াজ-৩।
ভূট্টা
এসময় ভুট্টা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সময়। ভূট্টার মোচা সংগ্রহ করে ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করুন অথবা বিক্রির ব্যবস্থা নিন। খরিফ মৌসুমে অনেকেই হয়তো ভূট্টা চাষ করেছেন। খরিফ ভূট্টার বয়স ২০-২৫ দিন হলে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করুন। মাটিতে রস কম থাকলে সেচ দেবার ব্যবস্থা নিন। একই সাথে আগাছা পরিষ্কার করুন এবং গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিন।শ
গাছপালা
এ সময় নরিকেলের চারা রোপণ করতে পারেন। আলো বাতাসপূর্ণ উঁচু স্থানে নারকেলের চারা রোপণ করুন। রোপণের সময় লম্বা জাতের জন্য ৮ মিটার এবং খাটো জাতের জন্য ৬ মিটার দুরে দুরে চারা রোপণ করুন। চারা রোপণের আগে এক মিটার চওড়া ও এক মিটার গভীর গর্ত করে গর্তের মাটিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৭৫০ গ্রাম টিএসপি, ৫০০ গ্রাম জিপসাম এবং ১২০ গ্রাম দস্তা সার প্রয়োগ করুন। আমের উইভিল পোকা, মাছি পোকা, পাতা কাটা উইভিল, গল মাছি, লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকা, কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে সঠিক বালাইনাশক অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করুন।
মাছ চাষ
বৈশাখ মাস পুকুরে মাছ ছাড়ার উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে পুকুর তৈরি করে নিন প্রথমে। এজন্য আপনাকে পুকুর শুকিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং চুন প্রয়োগ করতে হবে। অতঃপর পানি দিয়ে চাষের জন্য ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা সুস্থ সবল পোনা ছাড়–ন। এজন্য আপনার পোনা লাগবে ৩০-৪০টি। পানির তিন স্তরে থাকে এমন মাছ ছাড়ুন পুকুরে। যেমন- তেলাপিয়া, সরপুঁটি, নাইলোটিকা, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, বিগহেড কার্প, রুই, কাতলা, মৃগেল, কালো বাউস এসব। এরপর নিয়মিত পুকুরে তদারকি করুন, মাছের খাবার সরবরাহ করুন এবং স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখুন। মাছ চাষের যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করুন।
পশু পালন
গবাদিপশুর খাবার সরবরাহ করতে নেপিয়ার, প্যারা, ভূট্টা, ইপিল ইপিল চাষ করুন এখন। তাছাড়া ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক বা ইউরিয়া মোলসেস খড় তৈরি করে গবাদিপশুকে খেতে দিন। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিয়ে দিন। যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা পশুসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করুন। প্রিয় পাঠক, বাংলা নতুন বছরে আপনার কৃষি হয়ে উঠুক নতুন নতুন প্রযুক্তিতে ভরপুর। নিজের সমৃদ্ধি এবং দেশের স্বনির্ভরতায় আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির বিকল্প নেই। এ জন্য কথা বলুন আপনার পাশের কৃষি কর্মীর সাথে। পরামর্শমতো কাজ করলে আপনি, দেশ এবং দেশের জনগন লাভবান হবে । আবার কথা হবে মে মাসের কৃষি নিয়ে। সে পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন এ কামনায় আজ এ পর্যন্তই।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম