কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
‘ছেলেবেলা থেকেই গাছের সঙ্গে আমার সখ্য। আর সে কারণে প্রায় ছয় বছর আগে গাজীপুরের শ্রীপুরের লোহাগাছার ‘কাশবন নার্সারি’ থেকে চার হাজার টাকায় একটি মালটার চারা কিনে এনে আমার বাউকুল বাগানে লাগাই। পরের বছরই ওই চারা গাছে ৫-৬টি মালটা ধরে। আর তা থেকেই মালটা বাগান করার প্রতি আগ্রহ জন্মে আমার। শখের বশে লাগানো সেই মালটার একটি চারা থেকেই কলম পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন শুরু করি। প্রথম দফায় প্রায় ৫০টি চারা উৎপাদন করে বাউকুল বাগানে লাগাই। পরের বছর সেই ৫০টি চারা থেকে আরো চারা উৎপাদন করে একই বাগানে লাগাই। পরে নিজেই অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাণিজ্যিকভাবে মালটা চাষের সীদ্ধান্ত নেই।’ কথাগুলো মালটা চাষী মনমথ সরকারের। তার মালটা বাগানটি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ডাকাতিয়া ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামে।
মনমথ সরকার জানান, তার বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার বড়খাপন গ্রামে। পল্লী বিদ্যুতের স্টেকিং প্রকৌশলী হিসেবে ঘুরেফিরে ভালুকাতে প্রায় ২১ বছর চাকরি করেছেন তিনি। দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে এ উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামের মাটি ও মানুষের সঙ্গে এক রকম ভালোবাসা গড়ে উঠে। আর সেই ভালোবাসা থেকেই ১০ বছরের জন্য উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামে একেবারেই কিছু অনাবাদি জমি লিজ নেন। ২০০৭ সালে প্রথমে বাউকুল এবং এর সঙ্গে আম, লিচুসহ নানা জাতের ফলের চাষ শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ওই বাউকুল বাগানে শখের বশে কিনে আনা এক মালটা চারা থেকেই শুরু হয় তার বাণিজ্যিক মালটা চাষ।
উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামে মনমথ সরকারের মালটা বাগানে গিয়ে দেখা যায়, নিতান্ত পাড়াগাঁয়ে এবং একটি মনোরম পরিবেশে ৮০শতাংশ জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বাগানটি। জিআই তারের বেস্টনির ভেতরের ওই বাগানের প্রায় প্রতিটি গাছের ডালে পাতার আড়ালে ঝুলছে মালটা। জানা যায়, ওই বাগানের মালটা যথেষ্ট মিষ্টি, বাজারে রয়েছে প্রচুর চাহিদা। ভালুকার স্থানীয় ফল ব্যবসায়ীরা ওই বাগানের মালটার জন্য প্রায় তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। এ বছর চার হাজার টাকা মন দরে ইতোমধ্যে এক লাখ ২০ হাজার টাকার মালটা বিক্রি করেছেন তিনি। দফায় দফায় বিক্রির পরও প্রতিটি গাছে এখনো রয়েছে যথেষ্ট মালটা। ওই বাগান থেকে এ বছর দুই লাখ টাকার মালটা বিক্রি করার আশা করছেন বাগান মালিক।
মনমথ সরকার জানান, মালটা চাষের জন্য নিজের ও স্ত্রীর চাকরির আয় এবং ব্যাংক ঋণ মিলিয়ে ১৮লাখ টাকায় উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামে ৮০ শতাংশ জমি কিনেন তিনি। পরে প্রায় তিন বছর আগে নিজের বাউকুল বাগানে কলম পদ্ধতিতে উৎপাদিত প্রায় পাঁচ শত চারা এনে রোপণ করে ওই জমিতে বাণিজ্যিকভাবে মালটার চাষ শুরু করেন। মালটা বাগানের চারদিকে লাগানো হয় বিভিন্ন প্রজাতির আমের চারা। প্রায় তিন বছর আগে লাগানো ওই বাগানের ৫০-৬০টি গাছে গত বছরই মালটা ধরতে শুরু করে। গত বছর ওই বাগান থেকে প্রায় ৫০হাজার টাকার মালটা বিক্রি হয়। এ বছর বাগানের প্রায় তিন শত গাছে মালটা ধরেছে। বাগানের চারদিকে নিরাপত্তা বেড়া তৈরী থেকে চারা রোপণ, সার, কীটনাশক, ছত্রাক নাশক প্রয়োগ, সেচ, শ্রমিক ও পরিচর্যা বাবদ গত তিন বছরে তার ব্যয় হয়েছে তিন লাখ টাকা। গত তিন বছরে ওই বাগান থেকে আয় হয়েছে প্রায় ২লাখ ৫০ হাজার টাকা। তিনি জানান, বাগানে মূল বিনিয়োগ শেষ। এখন শুধু সার, কীটনাশক, ছত্রাক নাশক প্রয়োগ, সেচ ও পরিচর্যা বাবদ বছরে গড়ে ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। তার দাবি, আগামী বছর থেকে তিনি লাভের মুখ দেখা শুরু করবেন। তাছাড়া তার মালটা বাগান দেখে এলাকার অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন মালটা চাষে, কিনে নিচ্ছেন চারা। মালটার একেকটি ছোট চারা ২০০টাকা এবং বড় চারা বিক্রি করছেন এক হাজার টাকায়।
কমপক্ষে চার মিটার দূরত্বে চারা রোপণের পর বছরে দুইবার আশ্বিন-কার্তিক ও বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে প্রয়োজন মত টিএসপি, পটাশ, ইউরিয়া, জীপসাম, বোরন, দস্তা ও জৈব সার প্রয়োগ এবং শুকনো দিনে ১৫-২০দিন পরপর সেচ দিতে হয় মলটা বাগানে। প্রতিটি গাছে বছরে একবার করে মালটা ধরে। মার্চ মাসে ফুল আসতে শুরু করে, পরে গুটি এবং সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে খাওয়া ও বিক্রির উপযোগী হয় মালটা। তবে সম্পুর্ন মালটা হলুদ বর্ণ ধারণ করে নভেম্বর মাসে।
স্থানীয় আফতাব উদ্দিন চানু জানান, মনমথ বাবুর অনুপ্রেরণায় নিজের ২০ কাঠা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে মালটার চাষ শুরু করেছেন তিনি। স্থানীয়রা জানান, মনমথ বাবু সন্তান ¯েœহে লালন করে বড় করেছেন তার মালটা বাগানের প্রতিটি চারা। আর এখন তিনি তার পরিশ্রমের সুফল পাচ্ছেন। স্থানীয় ব্লকের উপসহাকরী কৃষি কর্মকর্তা মফিজ উদ্দিন জানান, চারা লাগানোর তিন বছর পর গাছে মালটা আসতে শুরু করে এবং মালটা গাছের আয়ুস্কাল ২৫ থেকে ৩০ বছর। তবে ফলন নির্ভর করে মালটা বাগান পরিচর্যার ওপর।
ভালুকা বাজারের ফল বিক্রেতা তোফাজ্জল হোসেন জানান, বাইরে থেকে আসা মালটা টক। ভালুকার মালটা মিষ্টি। বাজারে এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল আজম খান জানান, মনমথ সরকারের মালটা বাগানটি তিনি একাধিকবার পরিদর্শন করেছেন। সুনিস্কাশিত, উচুঁ, হালকা দোআঁশ ও অম্ল ভাবাপন্ন মাটি মালটা চাষের উপযোগী। সে হিসেবে ভালুকার শতকরা ৪০ ভাগ এলাকার মাটিই মালটা চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। এখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মালটা চাষে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
মনমথ সরকার জানান, আগে প্রায় প্রতিদিনই অফিস শুরুর আগে এবং শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচর্যা করতে ছুটে যেতেন মালটা বাগানে। এখন চাকরির অবসরের সবটকু সময়ই ব্যয় করেছেন ওই বাগানের পেছনে। তখন অফিসের সহকর্মীরা তাকে ‘মালটা ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে উপহাস করতেন। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এখন পাল্টে গেছে তাদের সুর।
ফলেছে আভোকাডো
ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ী ব্যাপ্টিষ্ট সংঘে (মিশন) অযতœ ও অবহেলায় বেড়ে উঠা গাছে ফলছে মূল্যবান ফল আভোকাডো (অঠঙঈঅউঙ)। অত্যন্ত পুষ্টিগুন সম্পন্ন আভোকাডো উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিখ্যাত ফল মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে পরিচিত। প্রায় ছয় বছর আগে মাইকেল কেসপার নামের একজন জার্মান নাগরিক ঢাকার গুলশান থেকে আভোকাডো গাছের দুটি চারা সংগ্রহ করে লাগিয়ে দিয়ে ছিলেন দেয়াল ঘেরা ওই ব্যাপ্টিষ্ট সংঘের (মিশন) ভিতরে। একেবারেই অনাদর ও অবহেলায় বেড়ে উঠা ওই চারা গাছ এখন আকার আকৃতিতে যথেষ্ট বড় হয়েছে। গাছগুলোতে কয়েক বছর ধরে ফল আসেতে শুরু করেছে। এবছর একেকটি গাছে ৫০-৬০টি করে ফল ধরেছে। তাছাড়া, বিগত দিনে ওই দুটি আভোকাডো গাছের ফলের বীজ থেকে বেশ কিছু চারাও উৎপন্ন করা হয়েছে। কয়েটি চারা লাগানো হয়েছে ওই ব্যাপ্টিষ্ট সংঘেই, আর কিছু বিতরণ করা হয়েছে আশপাশের চাষিদের মাঝে।
উপজেলা কৃষি অফিসসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিখ্যাত ফল আভোকাডো অত্যন্ত পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ ফল। কোলেস্টেরলমুক্ত উচ্চ চর্বি সমৃদ্ধ হওয়ায় বাংলায় এটিকে মাখন ফলও বলা হয়। যথেষ্ট ওষুধী গুন সম্পন্ন ও পুষ্টিকর হওয়ায় ফলটিকে ধরা হয় মায়ের দুধের বিকল্প। চিনির পরিমান কম হওয়ায় ফলটি অনায়েসে খেতে পারেন ডায়েবেটিস রোগীরাও। এটি ক্যান্সার প্রতিরোধীও। এছাড়া ভিটামিন বি কে সি ও ই এর সবগুলো উপাদানই রয়েছে আভোকাডোয়। আভোকাডো দেখতে অনেকটা লেবুর মত এবং অত্যন্ত মাংসাসী ফল। কাঁচা আভোকাডো রান্নায় মাংসে সবজী এবং খাবার টেবিলে সালাদ অথবা শরবত হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া পাকা আভোকাডো ফলের খোসা ছাড়িয়ে সরাসরি মাখনের মতও খাওয়া যায়। আভোকাডো বিদেশে পরিচিত সুপার ফ্রুট হিসেবে। বড় বড় ফাইভস্টার হোটেলগুলোতে মূল্যবান এই ফলটির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।
মল্লিকবাড়ী ব্যাপ্টিষ্ট সংঘের প্রজেক্ট ইনচার্জ পল বোস জানান, জার্মান নাগরিক মাইকেল কেসপার ঢাকার গুলশান থেকে প্রায় ছয় বছর আগে ওই গাছের দুটি চারা কিনে এনে এখানে লাগিয়ে ছিলেন। তখন গুনাগুন জানা না থাকায় কোন পরিচর্যাই করা হয়নি ওই চারা দুটিতে। মাটি ও আবহাওয়ার গুনে একেবারেই অনাদর ও অবহেলায় বেড়ে উঠা ওই দুটি চারা এখন গাছে রূপান্তরিত হয়েছে। মার্চ-এপ্রিলে আভোকাডো গাছে ফুল আসে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গাছের ফল খাওয়ার উপযোগী হয়। তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের জানা ছিলনা এই ফলটি এতটাই মূল্যবান। পরে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে আমরা ফলটির নাম ও গুনাগুন সর্ম্পকে জানতে পারি। এখন আমারা আমাদের এনজিওর মাধ্যমে ওই গাছের চারা গ্রামের আগ্রহী চাষীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করছি। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে এই ফল চাষের পরিকল্পনা করছেন স্থানীয় অনেকেই।
ভালুকা উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্ভিদ সংরক্ষক এনামুল হক জানান, অ্যাভোকাডো ফলটি অত্যন্ত মূলবান ও পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের উঁচু জায়গায় এর চাষ করা যাবে। বাণিজ্যিকভাবে এই ফলের চাষ বাংলাদেশে আছে কি-না তা জানা নেই। সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে ভালুকায় ওই বিদেশী ফলটির বাগান গড়ে তোলা সম্ভব বলে তিনি দাবি করেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল আজম খান জানান, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিখ্যাত ফল আভোকাডো অত্যন্ত পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ ফল। কোলেস্টেরলমুক্ত উচ্চ চর্বি সমৃদ্ধ হওয়ায় বাংলায় এটিকে মাখন ফলও বলা হয়। যথেষ্ট ওষুধি গুন সম্পন্ন ও পুষ্টিকর হওয়ায় ফলটিকে ধরা হয় মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে। চিনির পরিমান কম হওয়ায় ফলটি ডায়েবেটিস রোগীরা খেতে পারেন এবং ক্যান্সার ও ডায়াবেটিকসহ অনেক রোগের প্রতিষেধক হিসাবেও ফলটির যথেষ্ট গুরুত্ত্ব রয়েছে। ভালুকার মাটি ও আবহাওয়া অভোকাডো উপযোগী হওয়ায় স্থানীয়ভাবে এটির সম্প্রসারণ কাজও চলছে। তিনি জানান, তার জানামতে সারাদেশে ১৪টি আভোকাডো গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ভালুকার মল্লিকবাড়িতে ২টি, চাপাইনবাবগঞ্জে ১০টি ও মধুপুরে ২টি গাছ রয়েছে। তিনি জানান, চারা উৎপাদনের জন্য ফল খাওয়ার পর ভেজা অবস্থাতেই আভোকাডোর বীজ রোপণ করতে হয়। কারণ শুকিয়ে যাওয়া বীজ থেকে চারা হয় না।
বিশিষ্ট উদ্ভিদতত্ত্ব বিজ্ঞানী ও কৃষি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক কামরুজ্জামান জানান, বিশিষ্ট ফল বিজ্ঞানী প্রপেনের মতে, মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষের জন্য পৃথিবীতে যত নিয়ামত দিয়েছেন এর মধ্য আভোকাডো সবচেয়ে উত্তম। তিনি জানান, অত্যন্ত পুষ্টি ও ওষুধী গুন সম্পন্ন আভোকাডো মানবদেহ থেকে খারাপ চর্বি দূর করে দেয়। বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
বর্তমান সরকার আভোকাডো চাষে মানুষকে বিভিন্নভাবে উৎসাহী করছে। কামরুজ্জামানের মতে, দেশে ব্যাপক হারে আভোকাডোর চাষ বাড়লে দ্রুত পরিবর্তন ঘটবে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার এবং ওই ফল খাওয়ার মাধ্যমে মানুষ নিরাপদ ও নিরোগ স্বাস্থ্য নিয়ে আরো বেশী দিন বেঁেচ থাকতে পারবে বলে তার ধারণা।
পাহাড়েও ‘মাল্টা স্বপ্ন’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষকদের কাছে বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করেছে মাল্টা। মূলত: অনুকূল জলবায়ু ও আবহাওয়া কারনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মাল্টা চাষ। বারি মাল্টায় বাজার ভরে উঠায় এবার বিদেশি মাল্টা জায়গা করে নিতে পারেনি। এ কারনে কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা সাশ্রয়ের আশা করছেন।
খাগড়াছড়ি পাহাড়ী কৃষি গবেষনা কেন্দ্র উদ্ভাবিত মাল্টার নতুন জাত বারি মাল্টা-১ পাহাড়ে কৃষক ও বানিজ্যিক পর্যায়ে চাষাবাদ আগের তুলনায় বেড়েছে। খাগড়াছড়ি সদর ছাড়াও পানছড়ি, দীঘিনালাসহ জেলার প্রায় সব উপজেলায় এবারও মাল্টার চাষাবাদ করেছেন বহু কৃষক। ঘরের আঙ্গিনায়ও মাল্টার চাষ হচ্ছে। এ বছর অনেকে বানিজ্যিকভাবে এই সুস্বাদু ফলটির বাগান করে লাভের মুখ দেখেছেন।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী এ ফলটি এই অঞ্চলে খুবই সম্ভাবনাময়। ফলে কৃষকদের কাছে বারি মাল্টা-১ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গাজীপুর হর্টিকালচার রিচার্স সেন্টারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মদন গোপাল সাহা জানান, রোগবালাই এবং ঝরে পড়া কম হওয়ায় কৃষকদের কাছে এর বানিজ্যিক চাহিদাও বাড়ছে। মাল্টার উন্নত জাত বারি মাল্টা-১, ২০০৪ সালে খাগড়াছড়ি পাহাড়ী কৃষি গবেষনা কেন্দ্রে কৃষি বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছিলেন। ২০০৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড ফলটি সম্প্রসারণ পর্যায়ের জন্যে মুক্তায়ন করে।
খাগড়াছড়ির কৃষি গবেষনা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মনোরঞ্জন ধর জানিয়েছেন, খাগড়াছড়িতে মাল্টার অন্তত ২০০ টি বানিজ্যিক বাগান গড়ে উঠেছে। ফলে বাজার ছেয়ে গেছে বারি মাল্টায়। বিদেশি মাল্টার পরিবর্তে সবুজাভ মাল্টার প্রতিই সাধারন মানুষের আগ্রহ বেশি। প্রতি কেজি মাল্টা স্থানীয় বাজারে ৮০/১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
হর্টিকালচার রিচার্স সেন্টারের সাইট্রাস উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. আজমত উল্লাহ বারি মাল্টার উৎপাদন ও মিষ্টতায় নিজেও উৎফুল্ল হয়েছেন। তিনি বলেন, এই ফলের চাষাবাদ করে পাহাড়ের কৃষকরা কেবল অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে না; তাদের পুষ্টি নিরাপত্তায়ও অবদান রাখবে। সম্ভাবনাময় ফলটির বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও উৎপাদন কলাকৌশল কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে পারলে একদিকে কৃষক আর্থ-সামাজিকভাবে লাভবান হবে এবং অন্যদিকে মাল্টার আমদানি জিরোতে নামিয়ে এনে বৈদেশিক মূদ্রাও সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
ফল গবেষনা কর্মকর্তারা জানান, স্বল্প সময়ের মধ্যেই মাল্টার ফলন আসে। সর্বোচ্চ ৩ বছরের মধ্যে একজন কৃষক চাইলেই লাখপতি হয়ে যেতে পারেন। তারা এক্ষেত্রে কৃষি গবেষনার বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ বিভাগের কৃষিবিদদেরকে একযোগে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা কৃষকদেরকে সুখবর দিয়ে বলেছেন, খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষনা কেন্দ্রে মানসম্মত মাল্টার চারা কলম পাওয়া যায়।
স্থানীয় কৃষিবিদ ও সচেতন কৃষকরা মনে করেন, স্থানীয় মানুষদের মাল্টা খেতে অভ্যস্থ করার পাশাপাশি এর বানিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে মাল্টা চাষ পাহাড়ি এলাকার মানুষের কাছে একটি বিকল্প আয়ের উৎস হতে পারে।
তিন বছরেই লাখপতি মনপুদি: খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের আড়াই মাইল এলাকায় পাহাড়ি কৃষানী মনপুদি চাকমা মাল্টার ছোট্ট বাগান করে তাক লাগিয়েছেন। ২০১২ সালে মাত্র ১ বিঘা জমিতে ২০০টি মাল্টার চারা লাগিয়েছিলেন। তিন বছরের মাথায় এবার তিনি অন্তত লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করেছেন। জুমিয়া কৃষানী মনপুদি চাকমা এবার মাল্টা চাষ করেই স্বপ্ন দেখছেন জীবন বদলের। তার মত আরো অনেকেই মাল্টা বাগানে আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন। আরেক মাল্টা বাগানী উষাতন চাকমা বলেন, ‘মাল্টার ব্যাপারে ধারনাই পাল্টে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যে এত লাভবান হবো ভাবতেই পারিনি আগে। তা দেখে অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছেন।’ সম্প্রতি কৃষি সচিব শ্যামল কান্তি ঘোষ মনপুদি চাকমার মাল্টা বাগান পরিদর্শন করেছেন।
লেখকঃ মফস্বল সম্পাদক, কালের কণ্ঠ
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম