মো. মোশারফ হোসেন, শেরপুর :
ভাসমান বীজতলা
শেরপুরের নকলা উপজেলায় জলাশয়ে শাকসবজি চাষ করাসহ ধানের বীজতলা তৈরী করে সুফল পাচ্ছেন খাল, বিল ও নদীর তীরবর্তী এলাকার কৃষক। ভাসমান পদ্ধতিতে চাষে শ্রম ও অর্থ সাশ্রয় হওয়াসহ রাসায়নিক সার মুক্ত শাকসবজি ও সুস্থ্য সবল ধানের চারা পাওয়ায় তারা লাভবান হচ্ছেন। একদিকে দেশের মোট আয়তনের সুষ্ঠু ব্যবহার বাড়ছে, অন্যদিকে আসছে টাকা, কমছে শ্রম ও ক্ষতির আশঙ্কা। তাই বদ্ধ জলাশয় ও খাল, বিল ও নদীর তীরবর্তী এলাকার কৃষকরা ভাসমান পদ্ধতিতে স্বল্প কালীন শাকসবজি ও ধানের বীজতলা তৈরীর দিকে ঝুঁকছেন। এ পদ্ধতিতে ধানের বীজতলা ও শাকসবজি চাষ করলে ঝুঁকি অনেকাংশই কম থাকে। সাধারণত কোন প্রকার রাসায়নিক সার বা কীট নাশক ব্যবহারের প্রয়োজন কম হয়। পানিতে ভাসমান থাকায় সার এবং ক্ষতিকর পশু পাখির ও কীট পতঙ্গের অত্যাচার পোহাতে হয়না।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, নকলায় তুলনামুলক খালের পরিমাণ কম থাকলেও ১১টি বিল, ১১টি জল মহাল, উপজেলার উপর দিয়ে ভয়ে যাওয়া ৫টি নদী, ৪হাজার ১২০টি পুকুর রয়েছে। তাছাড়া ১হাজার ৬৬৪ হেক্টর নিচু জমি রয়েছে ওই সব নিচু জমিবর্ষা কালে পানিতে তলিয়ে থাকে। ফলে কোন একসময় আমন বীজ তলা তৈরী করা সম্ভব হতো না। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির এযুগে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্ভাবিত বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করার অংশ হিসেবে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদে আশাতীত সফলতা দেখা দিয়েছে। উপজেলার সর্বত্র না হলেও নদী, বিল ও জলাবদ্ধ নিচু এলাকার পানিতে ভাসমান বেডে বীজতলা ও শাকসবজি করা হচ্ছে।
উপজেলার গনপদ্দী ব্লকের দক্ষিণ গনপদ্দী এলাকার ফয়েজুর রহমান, জাহের উদ্দিন, ফরিদুর ইসলাম, আমিনুল ইসলাম; গনপদ্দী এলাকার মুখছেদুর মুমিন, নজরুল ইসলাম, মঞ্জুরুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম, পাইশকা গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া, কুর্শাবাদাগৈড় এলাকার লিয়াকত আলী, লয়খা এলাকার আব্দুল লতিফ ও রেজাউল তালুকদরের আরও অনেকেই ভাসমান পদ্ধতিতে স্বল্প কালীন শাকসবজি ও ধানের বীজতলা করে সফলতা পেয়েছেন। এই সফলতা দেখে ভূরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার ২৫ জন সদস্য সবাই জানান, আগামীতে তারা সবাই চায়ড়া ও বোরডুবি বিলে ভাসমান পদ্ধতিতে বীজতলা ও শাক-সবজীর চাষ করবেন।
কৃষক ফয়েজুর জানান, ভাসমান পদ্ধতিতে বিভিন্ন শাকসবজি ও ধানের চারা উৎপাদন করে তারা বশে লাভবান হয়েছেন। সে ওই ভাসমান বেডে প্রথমে ধানের বীজ বপন করেন, পরে ধানের চারা অন্যত্র নিয়ে লাগানোর পরে ওই বেডে মিষ্টি লাউ, শীত লাউ (কদু), ঝিঙ্গা, কুমড়া, ঢেড়স, লাল শাক, কলমি শাকসহ বেশ কিছু শাকসবজি চাষ করে লাভবান হয়ে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও এই চাষ পদ্ধতিতে শাকসবজি উৎপাদনে আগ্রহী হয়েছেন। তিনি আরও জানান, এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা অন্য চারার তুলনায় অনেক বেশি সুস্থ-সবল হয়। এই চারার উৎপাদন ক্ষমতাও অন্য চারার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। তাছাড়া সরকারি পরিত্যক্ত জলমহাল বা জলাবদ্ধ খাস জমি গুলোতেও এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা সম্ভব।
বেশ কয়েকজন কৃষকের দেয়া তথ্যমতে, ভাসমান পদ্ধতিতে প্রতিটি বেডের দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ২০ ফুট এবং প্রস্থ ৬ ফুট হওয়া উত্তম। প্রতিটি বেডে ৫ থেকে ৮ কেজি ধানের বীজ বপণ করা যায়। ভাসমান বেড তৈরী করতে প্রথমে বাঁশ, কলাগাছ, পচাঁনো কচুরিপানা ইত্যাদি দিয়ে ভাসমান মাচা তৈরী করা হয়। মাচার নিচে ২ ফুট এবং উপরে ২ থেকে আড়াই ফুট উঁচু করে পচাঁনো কচুরিপানা দিতে হয়। তার উপরে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি উঁচু করে মাটি দিয়ে তার উপরে ধানের বীজতলা ও শাকসবজির বীজ বপণ করতে হয়। এ পদ্ধতিতে ধানের বীজতলা তৈরী করতে ভিজা মাটিই ব্যবহার করা যায়। এতে সাধারণত কোন প্রকার রাসায়নিক সার বা কীট নাশক ব্যবহারের প্রয়োজন কম হয়। পানিতে ভাসমান থাকায় সার এবং ক্ষতিকর পশু পাখির ও কীট পতঙ্গের অত্যাচার পোহাতে হয়না। ফলে প্রায় বিনা খরচেই ভালো চারা ও নিরাপদ শাকসবজি পাচ্ছেন তারা। বদ্ধ জলাশয়ে বেড তৈরী করলে তেমন কোন কিছুই দরকার হয়না, তবে বহমান পানিতে বেড তৈরী করলে রশি দিয়ে বেধে বা খুঁটি দিয়ে আটকে রাখতে হয়। অন্য এক চাষি লিয়াকত জানান, ভাসমান প্রতি বেডের ধানের চারা দিয়ে ১০ শতাংশ জমি লাগানো সম্ভব এবং প্রতিটি বেড হতে উৎপাদিত শাক ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা বিক্রি করা সম্ভব; আর বিভিন্ন সবজি চাষে লাভ আরও বেশি হয়; কিন্তু খরচ নেই বললেই চলে।
ভূরদী গ্রামের কৃষক ছাইয়েদুল হক জানান, ৫ শতাংশ জমির বীজতলায় চাষ দেওয়া, বীজ ধান, সার, জমির লীজ মূল্যসহ কমপক্ষে একহাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু জলাশয়ে ভাসমান বেডে বীজ তলা করলে সর্বোচ্চ খরচ হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তাছাড়া শাকসবজি হতেও বাড়তি আয় কার যায়। এই হিসাবে নকলা উপজেলার সব জলাশয়ে ভাসমান শাকসবজি ও ধানের বীজ তলা তৈরী করতে পারলে কৃষকের বছরে কয়েক কোটি টাকা বেঁেচ যাবে বলে তিনি আশা করেন। ভূরদী ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন, পাইষকা ব্লকে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ কয়েক জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা ভাসমান পদ্ধতিতে বেডকরে শাকসবজি ও বীজতলা তৈরী করতে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের নিয়মিত উদ্বুদ্ধ করছেন। ইতোমধ্যে অনেক কৃষক এই পদ্ধতিতে বীজতলা ও শাকসবজি ফলানো শুরু করেছেন। আগামিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষির সংখ্যা ও পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়বে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাগন।
এবিষয়ে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ ও উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আতিকুর রহমান জানান, এবছর গনপদ্দী ব্লকে ১২টি, পাইশকা ব্লকে ৫টি এবং উরফা ব্লকে ৩টি ভাসমান বীজ তলা করা হয়েছে। তারমধ্যে অনেক বীজ তলার চারা তুলে রোপন করা হয়েছে। পরে ওইসব ভাসমান বেডে লালশাক, কলমি শাকসহ বিভিন্ন শাক সবজী চাষ করা হয়েছে। ভাসমান বীজ তলা তৈরী ও বেডের মাধ্যমে শাকসবজি চাষা করলে পরিত্যক্ত ও সরকারি জলাশয়ে বাড়তি কৃষিপণ্য উৎপাদন করা সম্ভব। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ূন কবীর বলেন, সারা দেশব্যাপী ভাসমান পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরী ও শাক সবজি চাষাবাদ শুরু করতে পারলে কৃষি অর্থনীতি দ্রুত সমৃদ্ধ হবে। মাঠ পর্যায়ে এই চাষ পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ সেবা দেওয়ায় কৃষকরা ভাসমান পদ্ধতিতে চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।